তৈরি হচ্ছে ঋণখেলাপিদের তালিকা, বাধাপ্রাপ্ত হবে বিদেশ যাত্রা ও লাইসেন্স ইস্যু

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১১:৫১ |  আপডেট  : ১৮ মে ২০২৪, ১০:১৬

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে স্বীকৃত কোনো ব্যক্তি বিদেশ যেতে পারবেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে তাদের নামে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননার জন্য যোগ্য হবেন না। গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও তারা বাধার মুখে পড়বেন। এ বিষয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতিটি ব্যাংকে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। কোনো গ্রাহক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সে ইচ্ছাকৃত খেলাপি কিনা তা শনাক্ত করতে হবে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দিচ্ছেন না, এমন গ্রাহকদের চিহ্নিত করতে গত বছর ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ সংশোধন করা হয়। আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে আইনে বর্ণিত সে সংজ্ঞাটিই উদ্ধৃত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘কোনো ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি তখনই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হবেন, যখন নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ কিংবা এর ওপর আরোপিত সুদ অথবা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করেন না। যদি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। কোনো ব্যাংক থেকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছিল, সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ওই ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা কিংবা এর অংশ ব্যবহার করলে। ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ প্রদানকারী কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত হস্তান্তর বা স্থানান্তর করলে সে গ্রাহকও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবেন।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরকেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে তালিকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ারও যোগ্য হবেন না। ইচ্ছাকৃত খেলাপির গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছেও তালিকা পাঠানো হবে, যাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। 

কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় কারো নাম এলে ঋণ পরিশোধ করে তালিকা থেকে অব্যাহতির পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কোনো পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তার পরিচালক পদ বাতিল হবে। কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার পর তালিকার বিরুদ্ধে আপিল না করলে বা আপিলের পর নামঞ্জুর হলে তাকে দুই মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধে জন্য নোটিস দেয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে খেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট ঋণ, অগ্রিম বা পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থ ঋণ আদালতের কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হবে না।

প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি ত্রৈমাসিকে ব্যাংকের অডিট কমিটির সভায় উপস্থাপন করতে হবে। অডিট কমিটি ওই প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি পর্যালোচনান্তে গুরুত্ব বিবেচনায় এ বিষয়ে তাদের মতামত বা সিদ্ধান্ত পরবর্তী পর্ষদ সভাকে অবহিত করবে। ব্যাংক পরিচালিত নিয়মিত বা বিশেষ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার বিষয়ে পর্যালোচনাসহ একটি আলাদা অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তা নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে টিকা আকারে প্রকাশ করতে হবে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাবের বিপরীতে আরোপিত বা অনারোপিত কোনো সুদ মওকুফ করা যাবে না এবং পুনঃতফসিলও করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাবটি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টেকওভার করা যাবে না। ওই ঋণ সম্পূর্ণ আদায় বা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবেই বিবেচিত হবেন।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে ব্যাংকের এমডি ও সিইওর দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তার অধীনে প্রধান কার্যালয়ে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি কমিটি তা শনাক্ত করবে। এরপর শনাক্তকরণের কারণ উল্লেখ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে তার বক্তব্য দেয়ার জন্য ১৪ কর্মদিবস সময় দেবে। ওই সময়ের মধ্যে বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হলে অথবা তার বক্তব্য যথাযথ বিবেচিত না হলে কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হবে। তবে জাতীয় শিল্প নীতিতে বর্ণিত সংজ্ঞানুযায়ী ‘বৃহৎ শিল্প’ খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, ‘মাঝারি শিল্প’ খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতিসম্পন্ন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির বা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চূড়ান্তকরণের পর সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতাকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে।

কোনো ব্যাংক এসব নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ণিত নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিবেচিত হলে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে অন্যূন ৫০ লাখ টাকা এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। এর পরও যদি ওই লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রথম দিনের পর প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত