জন্মদিনে তাজউদ্দিন আহমদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ০৯:২৬ | আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩৩
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সফল নায়ক মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদের জন্মদিন আজ (২৩ জুলাই)। জন্মদিনে এই মহান নেতার প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় সময় ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় অবস্থান করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটকহয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জীবন কাটান।মূল নেতার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় শীর্ষনেতার ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে। সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দিন আহমদ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু বাসা ছেড়ে যাবেন না -এটা নিশ্চিত হয়ে তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর লক্ষ্য স্থির করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর নোটে লিখেছেন,‘আমি মন ঠিক করে ফেলেছি, যেতে আমাকে হবেই। বাংলাদেশ ও জাতির এই চরম দুর্যোগের মোকাবিলা করতেই হবে। আমি বেরিয়ে পড়ব, এমন সময় ব্যারিস্টার আমীর -উল- ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এলেন। তাঁরা বললেন, শহরের পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। কয়েক মিনিট কথা বলে আমরা তিনজন একসঙ্গে দ্রুতবাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম । বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মূহূর্তে আমি শুধু আমার স্ত্রীকে বলে গেলাম,“আমি যাচ্ছি, আর্মি আসছে, তোমরা যেখানে পারো চলে যেয়ো।” (সূত্র-তাজউদ্দিন আহমদের একাত্তরের যাত্রা (১),দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল,২০২১)।
ড. কামাল হোসেন এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে কেরানীগনঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও কর্মীদের সহায়তায় পদ্মা নদী নৌকায় পার হয়ে ফরিদপুর দিয়ে মেহেরপুরের সীমান্ত পথে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পৌছেন। কলকাতা থেকে যোগাযোগ করে দিল্লী যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। ভারত-নেত্রীকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ। এ যুদ্ধে জয়লাভ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের সহায়তা প্রয়োজন। তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক ও সময়োচিত। তাঁর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক চিন্তা- চেতনা ও দূরদর্শিতা ইন্দিরা গান্ধীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। যার দরুন ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক ও বাস্তব সহযোগিতা প্রদানকরে। এক কোটি শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে ও বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে; যার ফলে মাত্র নয় মাসে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তাজউদ্দিন আহমদ স্ত্রী- সন্তানদের থেকে আলাদা থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পাশেরএকটি কক্ষে তিনি থাকতেন। নিজের কাপড় নিজেই কাঁচতেন। সে কাপড় শুকিয়ে তা গায়ে দিয়ে রণাঙ্গনে যেতেন ও অফিস করতেন।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলের ভিতরে উপদলীয় কোন্দল ও মোশতাক- মনিদের ষড়যন্ত্র-হটকারিতা সব ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ধৈর্য ধরে তিনি মোকাবিলা করেছেন। মোশতাকের ষড়যন্ত্র ধরতে না পারলে বাংলাদেশ অর্জন হতো কিনা সন্দেহ। মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ব্যক্তিদের লেখা বিভিন্ন বই থেকে দেখা যায়, খন্দকার মোশতাক আহমদ চেলাচামুন্ডাদের নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের ষড়যন্ত্র করেছিলেন; যা তাজউদ্দীনের বুদ্ধিমত্তায় ব্যর্থ হয়। এ কাজে তাজউদ্দীন আহমদকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন দিয়েছেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
মুজিবনগর সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সার্বিক সহায়তায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে স্বাধীন হয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বঙ্গবন্ধু সশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও তিনিই ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালির অনুপ্রেরণার মূল উৎস। তিনি ছিলেন বজ্রকন্ঠে, ছিলেন গানে-কবিতায়, পোস্টার-নাটকে। ছিলেন বাঙালির হৃদয়জুড়ে। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ও ভাবমূর্তিকে সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোশতাক-চক্র ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রচার করেছিল ‘স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে’ একসঙ্গে পাওয়া যাবেনা। প্রতিউত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ উচ্চকন্ঠে বলতেন “স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই আমরা পাব”। তিনি তাই করেছেন। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ও বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফিরে পেয়েছি।
পাকিস্তান আমলে বাঙালির ব না ও শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু । তিনি জনসম্মোহনী নেতৃত্ব দ্বারা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রধান সহযোগী হিসেবে যাবতীয় নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে হয়ে ওঠেন প্রধান ব্যক্তি। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিপক্ষ কতৃক বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে একটি পূর্ণ মাত্রার সামরিক আক্রমণ চালিয়ে প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহের সহায়তায় দেশ স্বাধীন করার দুরূহ দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। সেদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য সহযোগী নেতাদের চেয়ে তাজউদ্দীন আহমদের বিচক্ষণতা, দায়িত্বশীলতা ও নেতৃত্বের ব্যাপ্তি অনেক তাৎপর্যমন্ডিত। একদিকে নেতার অনুপস্থিতিজনিত সমস্যা, অন্যদিকে ভিন্ন রাষ্ট্রর সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বে পরিণতহয়।তাই আমি মনেকরি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর পরেই তাজউদ্দীন আহমদের স্থান।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আওয়ামী লীগের একটি দুষ্টচক্র তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদানকরেন। অর্থনীতির ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ না নিয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সেভাবেই তিনি দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেন। ১৯৭৪ সালে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় তাজউদ্দীন আহমদ আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে দেশের জ্ঞানী মানুষদের প্রশংসা লাভ করেন। অর্থমন্ত্রীত্বের শেষ দিকে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি। লাল ফোনে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,“এক দলীয় ব্যবস্থার ফলে মানুষের গণতন্ত্র থাকবেনা। আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্যে গণতান্ত্রিক কোন পথ খোলা না থাকায় তখন একটি পথই খোলা থাকবে। আর তাহলো বন্দুক। তাতে শুধু আপনিই মারা যাবেন না, আমরাও মারা যাব। এতে দেশ ও জাতির মহাসর্বনাশ হবে।”(সূত্র- তাজউদ্দীন আহমদের পিএস আবু সাঈদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ)।
বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের মধ্যে তাজউদ্দিনের মতো বিচক্ষণ মেধাবী, দেশপ্রেমিক ও জনবান্ধব নেতা খুব কমই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রকৃত ঘটনা তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে একান্তে শুনে এবং তাঁর পরামর্শ ও পরিকল্পনামত বঙ্গবন্ধু চললে পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা হয়তো জাতিকে দেখতে হতোনা।
তবুও বলা যায়, বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর অবদান সর্বাধিক। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তাজউদ্দীন আহমদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে। জন্মদিনে তাঁকেজানাই শ্রদ্ধা ও সালাম।
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ডিএমডি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত