চা শ্রমিকরাও মানুষ !  ভাবতে হবে তাদের কথা

  ওসমান গনি

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২, ১০:১১ |  আপডেট  : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:০২

দী ,পাথর, পাহাড়, জলপ্রপাত আর চা বাগান এইসবের সমন্বয়ে গঠিত হলো সিলেট।  কি অপূর্ব সৌন্দর্য সিলেট জেলা। আর এ সিলেটের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একটি হলো চা পাতা। সিলেট মানেই যেন চা বাগান এবং চা বাগানের নারী শ্রমিকদের চা তোলার চিত্র। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মূল শক্তি চা শ্রমিক-কর্মচারীরা। এদের শ্রমেই এ শিল্পের মালিকদের বড় বড় অট্টালিকা আর অভিজাত জৌলুশ গড়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে দেশে মোট চা উৎপাদন হয়েছে ৭৮.৯৫ মিলিয়ন কেজি এবং জিডিপিতে চা শিল্পের মোট অবদান ১৮২৫.২৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে চা উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। চা শিল্পে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে দেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিবন্ধনকৃত মোট চা বাগানের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৪টি – যার মধ্যে মূলধারার চা বাগান রয়েছে ১৫৬টি, মতান্তরে চা বাগানের এ সংখ্যা ২৪১টা।

 চা বাগানগুলো মূলত মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলাতে অবস্থিত। এ সকল চা বাগানে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৪ জন শ্রমিক রয়েছে – যার মধ্যে ২১৯৯৭ জন শ্রমিক অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছে। এই চা বাগানগুলো ব্রিটিশ আমল থেকে তৈরি করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকরা স্থায়ীভাবে বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া বাসস্থানে বসবাস করছে, তাদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সরকারিভাবে বিভিন্ন আইন-কানুন প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যেমন সংবিধান, শ্রমনীতিসহ আরও অন্যান্য। বাংলাদেশ শ্রম আইন, শ্রম বিধিমালা ও শ্রমিক-মালিকের দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, ভবিষ্য তহবিলসহ বিভিন্ন সুবিধাদি দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু  শ্রমিকদের বাসস্থান হলো,  চা গাছ ছেঁটে যেভাবে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনও যেন চা গাছের মতোই। লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুড়ে ঘরে বন্দী। চা বাগানের জীবনও যেনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আর বাগানটাই শ্রমিকদের কাছে গোটা পৃথিবী। দিনে আট ঘণ্টা টানা কাজ করেও সকালে চা-পাতা ভাজা, দুপুরে শুকনা রুটি এবং রাতে মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা।

বাংলাদেশের চা-শ্রমিকেরা বহুকাল ধরে নিরক্ষরতা, নিপীড়ন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক, মশা, সাপসহ বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় খেয়ে নামমাত্র মুজুরীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে, কোনো কথা বলে না।

দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় চা-শ্রমিকেরা সব দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরক্ষরতা। দেশে বাজেটের একটা বিরাট অংশ যেখানে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা খাতে, সেখানে চা-বাগানের শিক্ষার হার অতি নগণ্য। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন কোটা-সুবিধা রয়েছে, চা-শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য তেমন কিছু নেই। চা-বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের  চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খুবই নাজুক। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার খুব বেশি। ১৯৬২ সালের টি প্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্ল্যান্টেশন রুলসে চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব থাকলেও তা প্রতিপালনের ব্যবস্থা নেই।

নারী চা শ্রমিকরা সকালে বাড়ির কাজ শেষ করে প্রতিদিন সকালে দলবেঁধে চা বাগানে চলে আসেন। সারাদিন দাঁড়িয়ে চা তুলে সন্ধ্যায় ফিরে ৮৫ টাকার মালিক হন তারা। সমাজের সব পেশার নারীরা কমবেশি সম্মান পেলেও চা শ্রমিক নারীরা আজীবন উপেক্ষিত। ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, সুপেয় জল, স্যানিটেশনসহ কোনো কিছুরই সুবিধা পান না তারা। এক কথায় নারী হয়ে পাহাড়ের কোলে জন্ম নেওয়াটাই তাদের অপরাধ। অথচ তারা চা শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন। চা শ্রমিকদের ২০০৭ সালে মজুরি ছিল ৩২ টাকা। ২০০৯ সালে ১৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৪৮ টাকা। ২০১৩ সালে বাড়ানো হয় ৬৯ টাকা, আর এখন ৮৫ টাকা। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি প্রতিদিন যেন তাদের ২৫০-৩০০ টাকা পারিশ্রামিক দেওয়া হয়। বতর্মানে উৎসব ভাতা বেড়েছে। বৃদ্ধ চা শ্রমিকদের সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। সেটাও চা শ্রমিকরা অনেক আন্দোলন করে আদায় করেছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের ১৬২টি চা বাগানের রেজিস্টার্ড শ্রমিকের সংখ্যা ৮৯ হাজার ৮১২ জন। এর বাইরে অস্থায়ী (ক্যাজুয়েল) শ্রমিক আছেন আরো ১৯ হাজার ৫৯২ জন। অস্থায়ী শ্রমিকরা রেশন ও  প্রভিডেন্ড ফান্ড পান না। বসবাসের জন্য ১৬ হাজার পাকাঘর বরাদ্দ আছে রেজিস্টার্ড শ্রমিকদের জন্য। আর প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিকের জন্য রয়েছে কাঁচাঘর। রেজিস্টার্ড ও অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।

চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠিত স্কুল সংখ্যা ১১৮টি। স্কুলগুলোতে ২৫ হাজার ৯৬৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র ৩৬৬ জন শিক্ষক। আর শিক্ষকরা অষ্টম থেকে নবম শ্রেণি পাস। শ্রমিকদের কেউ যদি এসএসসি পাস করে থাকে তাহলে তাকে ‘বাবু’ বলা হয় এবং তাকে বাগানে চাকরি দেওয়া হয়। তার বেতন আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে। তবে এক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ নেই। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ৩টি বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য একজন মাত্র এমবিবিএস চিকিৎসক ছিলেন। বর্তমানে ৬টি বাগানের জন্য একজন মাত্র এমবিবিএস চিকিৎসক আছেন।

পরিত্যাক্ত জমি নিজের শ্রম ঘাম দিয়ে আবাদ করে মূল্যবান চা উৎপাদন করে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। তাদের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রফতানি করা হয়। কিন্তু চা-শ্রমিকরা সকল নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতীয়মান। চা বাগানের প্রতিটি নারী শ্রমিকই চান, তারা নানা কষ্টে নিজেদের জীবনকে অতিবাহিত করলেও তাদের সন্তানরা যাতে সুখ নামের সোনার হরিণটিকে ছুঁতে পারে। তারা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু চায়ের দেশে পর্যাপ্ত স্কুল ও চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার না থাকায় তাদের সেই স্বপ্ন বোধহয় চা বাগানের অন্ধকারে।

১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চায়ের আবাদ শুরু হয়। ব্রিটিশ কোম্পানি একের পর এক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করলে প্রয়োজন হয় শ্রমিক সংগ্রহের। আসাম, নাগাল্যান্ড, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ বিহার প্রভৃতি অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হাজার হাজার মানুষদের মিথ্যা স্বপ্ন ও উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে এইসব চা বাগানে নিয়ে আসা হয়। এসকল মানুষেরা যেখানে এসেছিল একটু উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে সেখানে এসে চিত্রপট দেখে সম্পূর্ণই ভিন্ন। কোম্পানি মালিকরা এসকল শ্রমিকদের গহীন জঙ্গল কেটে বাগান তৈরি করার কাজে নিয়োজিত করে নামেমাত্র মজুরিতে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনিতে একবেলা খাবারো জুটতোও না অনেক সময়। যার ফলে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন পার করতো শ্রমিকরা।একদিকে খাবার সঙ্কট, বাসস্থানের সঙ্কট অন্যদিকে বাগান মালিকদের নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে ওঠতে থাকে চা বাগানে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবন। এরকম অসহনীয় পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে মালিক শ্রেণির শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চরাঞ্চলের চা শ্রমিকরা। ১৯২১ সালে ৩ মার্চ নিজ মুল্লকে ফিরে যাবার জন্য সিলেট ও তার আশপাশের প্রায় ত্রিশ হাজার চা শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাগান ছেড়ে নিজ মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। “মুল্লক চলো” অর্থাৎ নিজ ভূমিতে চলো। তাদের দাবি ছিল ইংরেজদের অধীনে কাজ করবে না ও তাদের নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাবে। উল্লেখ্য, উক্ত আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন পন্ডিত দেওশরন এবং পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। এখানে কোনো জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না। চা-বাগানে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও চা-বাগানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাবৃত্তির প্রচলন করা উচিত। চা-বাগান এলাকায় পর্যাপ্ত সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চা-শ্রমিকদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মানুষ মনে করলে এসব অবশ্যই করতে হবে।

চা বাগানের নারী শ্রমিকরা চা বাগানের অভ্যন্তরে ও বাইরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা জানে না নারী অধিকারের কথা। এসব নারী চা শ্রমিক এই শিল্পে অবদান রাখলেও তারা বরাবরই অধিকার থেকে বঞ্চিত।

লেখক- সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত