চারণ চিকিৎসক ডাঃ কালি জীবন মজুমদারের সাথে আলাপচারিতা

  মো.জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১৮:১৯ |  আপডেট  : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:১২

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বিক্রমপুরসহ অবিভক্ত বাংলার গ্রামগঞ্জে ন্যাশনাল পাশ ডাক্তাররাই গ্রামে থেকে স্বল্পমূল্যে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন।’৭১-এ শহীদ সাংবাদিক শহীদউল্লাহ কায়সার তাঁর কালজয়ী উপন্যাস সংসপ্তকে এমন এক পল্লী চিকিৎসকের চরিত্র চিত্রন করেছেন গগন ডাক্তার নামে। গগন ডাক্তার মানুষকে চিকিৎসা দিতেন। মানুষ আধুলি, সিকি, লাউ, মূলা, মুরগি দিত ফি হিসেবে। অনেকে কিছুই দিত না।বিক্রমপুর এলাকায় গগন ডাক্তারের মতো ডাক্তার প্রতিটি ইউনিয়নে ছিলেন। যেমন ষোলঘরে অবিনাশ ডাক্তার, কাজির পাগলায় জলধর ডাক্তার,শিমুলিয়ায় ডাঃকালি জীবন মজুমদার,বাঘড়ায় মানিক ডাক্তার, ভাগ্যকূলে হরেন্দ্র ডাক্তার (এম বি)। এমন ডাক্তার অন্যান্য এলাকায়ও ছিলেন। শ্রীনগর শ্রীনাথ হাসপাতালের কিংবদন্তীতুল্য  চিকিৎসক ডাঃ মন্মথ নাথ নন্দী(এমএন নন্দী) কলকাতার চাকরি ছেড়ে ১৯৩৭ সালে চলে এসেছিলেন তৎকালীন অজপাড়াগা শ্রীনগরে।

শিমুলিয়ার ডাঃ কালি জীবন মজুমদার জন্মভিটার টানে গত দু সপ্তাহ যাবত মেয়ের ঢাকার বাসায় অবস্থান করছেন। গত ১০ অক্টোবর সোমবার মতিঝিলে গ্রামনগর বার্তা অনলাইন পত্রিকা অফিসে তাঁর সাথে দেখা ও আলাপচারিতার সুযোগ করে দেয় খান নজরুল ইসলাম হান্নান।

ডাঃ কালি জীবন মজুমদার ১৩৪২ সালের ২৪ মাঘ জন্মগ্রহন করেন। হলদিয়া হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক লাল মোহন সাহা মেট্রিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় বয়স দু বৎসর কমিয়ে দেন। তিনি কলকাতার এক স্কুলেও লেখাপড়া করেছেন। মেট্রিক পাসের পর তিনি হোমিওপ্যাথের উপর ঢাকায় পড়াশোনা করে পাশ করেন। তাঁর দাদা নিবারণ কবিরাজ ১১৫ বছর বয়সে মারা যান। বাবা ডাঃ ক্ষেত্রমোহন মজুমদার ৭০ বছরের আগেই মারা যান।

১৯৪৭-৪৮ সালে দেশ ভাগেরকালে তিনি শিমুলিয়ার পৈত্রিক বাড়ি আসেন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। তিনি জানান তখন শিমুলিয়া বাজারের প্রায় সব দোকান ছিল হিন্দুদের। মুসলমানদের মধ্যে জলকদর খলিফা ও দরবেশ খানের দোকান ছিল। দেশ ভাগের পর পর শিমুলিয়া বাজারে এক রাতে খুব দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। তারক খলিফা নামের একজন দর্জি কাজ করতেন। রাতে তিনি দোকানেই থাকতেন।এক রাতে দোকান ঘরের জানালা দিয়ে লগ্গি ঢুকিয়ে কে বা কারা তারকের মুখ মন্ডল ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। যা দেখে হিন্দুদের মাঝে আতঙ্ক সৃস্টি হয় এবং তারক খলিফাসহ দলে দলে তারা জন্ম ভিটা ত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে চলে গিয়ে উদ্বাস্ত হয়। শিমুলিয়া বাজারে দোকান ছিল এমন অনেকেও চলে যায়। শিমুলিয়ার প্রভাবশালী ও ভদ্রলোক জালাল মুন্সী ডাঃ কালি জীবন মজুমদারকে বাজারের পরিত্যক্ত একটি দোকান নিতে প্রস্তাব দেন। মুন্সী সাহেব তারক খলিফার ঘরটি বছরে ৮০ টাকা ভাড়ায় কালিজীবন মজুমদারকে বন্দোবস্ত দেন। এ ঘরে তিনি ডিসপ্নসারি সাজিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। প্রতি রুগীর ফি ছিল আট আনা। শুকনা কালে পায়ে হেটে কখনোবা সাইকেলে চড়ে ও বর্ষায় নৌকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। তাঁর নৌকার মাঝি ছিল ছয়করি। তাকে সবাই ছক্কু মিয়া ডাকতো।ছক্কু মিয়া আবার কীর্তনে দোহার হতেন।ডাঃকালি জীবনের দাদা স্থানীয় মসজিদ ঘরে পাটি কিনে দিতেন।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ছিলেন।পাকিস্তান আমলে তিনি কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, রহমান মাস্টার, শামুদ্দিন আহমদ, কোরবান আলী , কফিলউদ্দিন চৌধুরী, আনোয়ার উদ্দীন চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শফিউদ্দীন আহমদের সংস্পর্শে এসেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কোরবান আলীর পক্ষে কাজ করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত কুমারভোগের নূর মোহাম্মদ তাঁর চেম্বারে প্রায়ই আসতেন এবং বলতেন,” দেশে একটা পরিবর্তন হবে।”

১৯৬৯ সালের ১১ দফার আন্দোলনে , ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বসের ত্রাণকাজ করতে ডাঃ কালি জিবন মজুমদার কফিল উদ্দীন চৌধুরীর সাথে তাঁর লঞ্চে ভোলা অঞ্চলে  গিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষন রেডিওতে শুনে তিনি কেঁদেছেন। তাঁর কম্পাউন্ডার  বাদল ৭ই মার্চের ভাষণ  শুনতে পায়ে হেঁটে রেইসকোর্স ময়দানে গিয়েছে। বাদল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর রেডিওতে শুনে বাদল হাউমাউ করে উঠানের মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের পর ঢাকা থেকে জিনজিরা দিয়ে বিক্রমপুর আসার সময় জিতেন ঘোষের সাথে ছিল শিমুলিয়ার রমিজউদ্দিন শেখ।সে জিনজিরায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া গুলিতে আহত হয়।

শিমুলিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে সামাদ খানের ছেলেকে পুকুরে গুলি করে মারে। ছেলেটি ভয় পেয়ে পুকুরে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা লুট করেছে , রেপ করেছে ,ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের আসার খবর পেয়ে ডাঃ কালি জীবন মজুমদার বাসুদেব ঘোষকে নিয়ে সাঁতার কেটে খড়িয়া দেওয়ান বাড়ি আশ্রয় নেন।

পাকিস্তানি সৈন্য শিমুলিয়া আসার দিন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে বলেছিল ডিসপেনসারির ‘ইস্ট বেঙ্গল হোমিও হল’লেখা সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলতে।

তখন ডাঃ কালী জীবন মজুমদার বলেছিলেন, এরা (পাকিস্তান আর্মি) বড়জোর সাইনবোর্ডটাকে ব্রাশফার করতে পারবে কিন্তু আমার অন্তরের মাঝের সাইনবোর্ডটাকেতো কিছু করতে পারবেনা। জসলদিয়া স্কুলের শিক্ষক ফরিদ মাওলানা তাঁর ডিসপেনসারির চেয়ারে বসে মালামাল রক্ষা করেছেন।

জুলাই ১৯৭১ মাসে তিনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বৌলতলীর এক ডাক্তারের বাড়িতে আশ্রয় নেন।৷কিন্তু তাঁর মা ও কাকা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি।বৌলতলীতে ছাত্রলীগ নেতা আবদুস সহীদ খান সেন্টু ও ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি এই ক্যাম্পে রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর চালানো ও গ্রেনেড নিক্ষেপের ট্রেনিং নেন।

১৯৭১ সালে বর্ষাকালে একদিন ঈমান আলী মাঝির নৌকা ভাড়া করে স্ত্রী কন্যা সহ শ্বশুরালয় জয়পারা (দোহার)যাওয়ার পথে আড়িয়ল বিলে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের একটি ছোট বিমান দুবার তাঁর নৌকার ওপর চক্কর দিয়ে চলে যায়। এতে ভয় পেয়ে জয়পারা আর যাওয়া হয়নি। ভাগ্যকুল বাজার থেকে কলা-মুড়ি খেয়ে শিমুলিয়া ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাদল নাম নিয়েছিলেন আর নূহ আলম লেনিন নাম নিয়েছিলেন রাখাল। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর শ্বশুড় সুখলাল ডাক্তারের বাড়ি লুট হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় খড়িয়ার হানিফ হাজী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তা করেছেন। তিনি খুলনায় লোহার ব্যবসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি খুলনা থেকে খড়িয়ায় চলে এসেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়েছে খবর পেয়ে হানিফ হাজীকে নিয়ে ডাঃ কালি জীবন মজুমদার আনন্দে জয়বাংলা শ্লোগান দেন। তখন শিমুলিয়া বাজারে কোন মিস্টির দোকানে মিস্টি তৈরি হতো না, সব দোকান বন্ধ ছিল। এক দোকানে গিয়ে পাঁচ সের বাতাসা কিনে বিতরণ করেন। কিছু বাতাসা রেখে দেন এবং বাড়িতে কীর্তনের পর তা বিতরণ করেন।

ডাঃ কালি জীবন মজুমদার জানান ১৬ ই ডিসেম্বর রাতে তাঁর ঘরে টোকা দিয়ে একজন একটি বেদনাদায়ক খবর জানায়। শিমুলিয়ার বোরহান খলিফা, হাছান খলিফা ও জলিল খলিফাকে মুক্তিবাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা খারাপ ছিলনা বলে তিনি জানান।

ডাঃ কালি জীবন মজুমদারের বাড়িতে স্বাধীনতার পর দু/ তিন বার ডাকাতি হয়। যার দরুন তিনি বাড়ি বিক্রি করে কলকাতা চলে যান।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত