আসামী ১২ বছর ইটালি, গুলি ছুড়েছেন ঢাকাতে!

  এসআর শফিক স্বপন মাদারীপুর

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৩৬ |  আপডেট  : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭

মাদারীপুরের চরমুগরিয়া এলাকার বাসিন্দা সারাফাত ইসলাম ডলার দীর্ঘ ১২ বছর যাবত থাকেন ইটালীর মিলানো শহরে। করেন বিএনপির রাজনীতি। তার পিতা রাজা জমাদ্দার। একজন অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। কয়েক বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্থ। রোগেশোকে ঘরেই কাটে দিন। অসুস্থতার কারনে বাসা থেকেও বের হতে পারেন না। অথচ তাদের নামে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বিবরন মতে, তারা গুলিও ছুড়েছেন। সেই গুলিতেই মারা গেছে এক যুবক। তবে স্থানীয়দের দাবী, ব্যক্তিগত শক্রুতার কারনেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার সিএমএম আদালতে মনিরুজ্জামান মনির নামে এক যুবক নিহেতর ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ২৬জনকে আসামী করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২১জন মাদারীপুরের বাসিন্দা। অন্য আসামী হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল,পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ। এই ৫ জনের ঠিকানা ঢাকার হলেও ২১ জনের কেউই ঢাকার বাসিন্দা নন। স্থানীয়দের দাবী, এলাকার রাজনৈতিক বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রæতাকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের ২১জনকে আসামি করা হয়েছে।

এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, আসামীর নাম বাদ দিতে আওয়ামীলীগের সমর্থিত মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক এক ভাইস চেয়ারম্যান একাধিক আসামির কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পর রাজধানীর ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সামনে পুলিশের গুলিতে মনিরুজ্জামান মনির নামে এক যুবক নিহত হয়। নিহত মনিরুজ্জামান মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় এলাকার নুরুল ইসলাম মোল্লার ছেলে। মনিরুজ্জামান মনিরকে মামলার এজাহারে রিক্সা চালক উল্লেখ করা হয়। এই ঘটনায় তাঁর বোন নিলুফার ইয়াছমিন বাদী হয়ে গত ৩ অক্টোবর ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। পরে আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য শাহবাগ থানাকে নির্দেশ দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আসাদুজ্জামান জুয়েল। মামলায় প্রধান ৫ আসামী ছাড়া সব আসামিই মাদারীপুরের বাসিন্দা।

মামলার বাদী নিলুফার ইয়াছমিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আপাতত মামলার বিষয় কিছু বলতে চাই না। পরবর্তীতে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। 

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদসহ মোট ২৬ জনের নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত ২৫০ থেকে ৩০০জন আসামী করা হয়। তবে মামলার প্রথম ৫ আসামীর বর্তমান ঠিকানা ঢাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাম উল্লেখ করা বাকি সব আসামির বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার  বিভিন্ন এলাকায়। তাঁদের আর একজনেরও বর্তমান ঠিকানা ঢাকায় নয়। সবার ঠিকানাই মাদারীপুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে মামলার এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ভন্ডুল করার জন্য পুলিশে সাথে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সদস্যরা ও ৬ থেকে ২৭ নম্বর আসামীগণ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করতে করতে পাড়ায় মহল্লায় ঢুকে এবং র‌্যাব হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষের উপর গুলি করে এবং এই মামলার ভিকটিম তার রিক্সা নিয়ে জীবিকার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই ভিকটিমের বুকে গুলি করা হয়। পরে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ভিকটিমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে ৫ আগষ্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে মনিরুজ্জামান মারা যায়। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। 

মামলা দায়ের করার বেশ কয়েকদিন আগে নিহত মনিরুজ্জামান মনিরের বাবা নুরুল ইসলাম মোল্লা গণমাধ্যমে জানিয়েছিল, ৫ আগস্ট সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন মনিরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু আলম। তারাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যান। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার আগে গণভবন থেকে বের হয়ে আসেন। পরে তারা পুলিশ সদর দফতর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ করার পর বের হয়ে দেখেন তাদের মোটরসাইকেলটি দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই পুলিশ সদর দফতরের সামনে শুরু হয় গোলাগুলি। মনিরুজ্জামান ও আলম জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় মনিরুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হন ও আলম মারধরের শিকার হন। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই দিন রাতেই মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মনিরুজ্জামানের বন্ধু আলম কাজী বলেন, ‘আমরা গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিক থেকে তখন গুলির আওয়াজ। কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) আর বেঁচে আর নেই। সেই দিনের কথা এখনো চোখে ভাসছে।’

মামলার বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন,‘ মামলার তদন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খু বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। ঘটনার সময় যদি কেউ দেশের বাইরে থাকে তাও তদন্তে উঠে আসবে। নির্দোষ কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।’

মামলার এজাহার ঘেঁটে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসামীদের প্রথম ৫জন ছাড়া সবাই মাদারীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। এলাকায় জমিজমা ও ব্যবসায়িক বৈরিতা ও ব্যক্তিগত শত্রæতা কারণে তাঁদের আসামি করা হয়েছে। মামলার ১০ নম্বর আসামি মাদারীপুরের চরমুগরিয়া এলাকার বাসিন্দা সারাফাত ইসলাম ডলার একজন প্রবাসী। তিনি ১২ বছর ধরে ইটালির মিলানো শহরে আছেন। তার বাবা মামলার ১২ নম্বর আসামী রাজা জমাদ্দার একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগী।

স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদ সরদার বলেন,‘সারাফাত ইসলাম ডলার ১২ বছর যাবত ইটালিতে থাকেন আর তার বাবা অসুস্থ্য লোক। ঘর থেকেও বের হবে পারেন না। তাদের উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে আসামী করা হয়েছে।’

 মাদারীপুর জেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব অহিদুজ্জামান খান বলেন,‘মাদারীপুরের একজন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কু পরামর্শ দিয়ে এই মিথ্যা মামলা দেওয়াইছে। সেই ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মুলত আওয়ামীলীগের লোক। তার সাথে যাদের দ্ব›দ্ব তাদের হয়রানি করার জন্য এই মামলা দায়ের করিয়েছেন। মামলার আসামী সারাফাত ইসলাম ডলার একজন বিএনপি নেতা। ছাত্র আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় বিএনপি নেতা আসামী হওয়া দুঃখজনক।’

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন,‘ঘটনাস্থল ঢাকা এবং মামলাও ঢাকাতেই হয়েছে। বিষয়টি আমাদের জেলা পুলিশের নয়।’

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত