অসহিষ্ণুতা -বিচিত্র কুমার
বিচিত্র কুমার
প্রকাশ: ৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৯ | আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৫
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এই সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সহাবস্থান। কিন্তু যখন এই সহনশীলতার জায়গাটি ক্ষীণ হয়ে আসে, তখনই সমাজে জন্ম নেয় অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা কোনো নতুন ব্যাধি নয়, বরং মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক বিস্তৃত হয়েছে, সেখানে অসহিষ্ণুতার চেহারা আরও বিকট ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
আজকের পৃথিবীতে অসহিষ্ণুতা শুধু রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; তা ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, লিঙ্গ, জাতিগোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তিগত রুচিবোধের মধ্যেও। অন্যের মতের প্রতি সম্মান দেখানো কিংবা ভিন্নমতকে গ্রহণ করার মানসিকতা আজকের সমাজে ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। অথচ সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য এই মানসিকতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
গ্রামের মাঠ থেকে শহরের রাজপথ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি—সব জায়গাতেই অসহিষ্ণুতা আজ এক মহামারীর রূপ নিয়েছে। একজন ছাত্র যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে প্রশ্ন করতে ভয় পায়, কারণ সে জানে তার প্রশ্ন যদি শিক্ষকের মনমতো না হয়, তাহলে হয়তো সে তিরস্কৃত হবে, তখনই বোঝা যায় অসহিষ্ণুতা কতটা গাঢ় হয়ে গেছে। একইভাবে, যখন কোনো মানুষ তার ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না, কারণ প্রতিবেশী ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, তখনই সমাজে অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষের শিকড় অনুধাবন করা যায়।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিতে গেলে অসংখ্য চিত্র উঠে আসে। গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক হোক বা শহরের উচ্চশিক্ষিত নাগরিক, সকলের মধ্যেই একধরনের “আমিই ঠিক” মানসিকতা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সহিষ্ণুতার সংকট। ধরা যাক, একেবারে সাধারণ একটি দৃশ্য—বাসে উঠে একজন ব্যক্তি যদি বলে, “আমি জানালার পাশে বসতে চাই”, তখনই আরেকজন যাত্রী তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আপনি কে আমাকে সরিয়ে বসানোর?” এখানে কেউ আর বুঝতে চায় না যে, হয়তো ওই ব্যক্তি অসুস্থ, হয়তো বাতাসের দরকার আছে তার। ছোট ছোট জায়গায় যদি আমরা একে অপরের অনুভূতিকে বুঝতে না চাই, তবে বৃহত্তর সমাজে কিভাবে সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে?
রাজনৈতিক অঙ্গনেও অসহিষ্ণুতার ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ভিন্নমতের মানুষদের কণ্ঠরোধ করা, বিরোধী মতাদর্শকে শত্রু মনে করা, শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর হামলা চালানো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা—এগুলোই হলো রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার নগ্ন প্রকাশ। অথচ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো ভিন্নমতের সহাবস্থান। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দেশে যখন বিরোধীদলের সভা-সমাবেশকে প্রতিপক্ষ নয় বরং শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখনই সমাজে এক বিভাজনের দেয়াল নির্মিত হয়, যা সহিষ্ণুতার চর্চাকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেয়।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করা, ঘৃণা ছড়ানো, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর আক্রমণ করা, ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা—এসবই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জ্বলন্ত উদাহরণ। অথচ সকল ধর্মেই সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, মানবতা শেখানো হয়। তবু কেন মানুষ ধর্মের আড়ালে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে? এর অন্যতম কারণ হলো—অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণা। যারা নিজের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা জানে না, তারাই অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আবার কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে এই অজ্ঞতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সমাজে অসহিষ্ণুতা ছড়ায়।
অসহিষ্ণুতার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে মানুষ যেন আরও বেশি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। “মত প্রকাশের স্বাধীনতা”র নাম করে কেউ যখন নিজের মত অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তখনই সেখান থেকে শুরু হয় ট্রলিং, কটাক্ষ, অপমানজনক মন্তব্যের ঝড়। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের কমেন্ট সেকশনে যদি কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করে, তখনই তার ওপর নেমে আসে গালি-গালাজের বন্যা। এখানে যুক্তি নেই, সভ্যতা নেই, আছে শুধু “আমিই ঠিক, বাকিরা ভুল” এই আত্মঘাতী দম্ভ।
অসহিষ্ণুতার একটি নির্মম উদাহরণ দেখা যায়—পারিবারিক পরিসরে। শৈশব থেকেই যদি শিশু তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পায়, যদি মা-বাবা প্রতিনিয়ত তার মতামতকে উপেক্ষা করে, তখনই সে একটি সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। পরিবারই যদি সহিষ্ণুতার প্রথম পাঠশালা না হয়, তবে স্কুল, সমাজ, রাষ্ট্র তা হতে পারে না। আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ে ভেদে চলন-বলন, পোশাক-আশাক, পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের অসহিষ্ণুতা কাজ করে। মেয়ে হলে তাকে রান্না শেখাতে হবে, ছেলে হলে মাঠে খেলতে পাঠাতে হবে—এই ধারণাগুলো আমাদের সমাজে প্রোথিত। অথচ, ছেলে যদি রান্না করতে চায় বা মেয়ে যদি ফুটবল খেলতে চায়, তখনই সমাজ তাকে বাঁকা চোখে দেখে। এটা আসলে চিন্তার অসহিষ্ণুতা, যা আমাদের সামাজিক গঠনকেই বিকৃত করে তুলছে।
অসহিষ্ণুতার কারণে সমাজে বিভাজন তৈরি হয়, সৃষ্টি হয় ঘৃণা, হিংসা, সহিংসতা। একবার ভাবুন, কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যখন ভয়ভীতির মধ্যে বসবাস করে, তখন তার সমাজের প্রতি আস্থাই ভেঙে যায়। একইভাবে, রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে যদি কাউকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়, তার কর্মস্থলে হেনস্থা করা হয়, তাহলে সেই সমাজে গণতন্ত্রের ভিত্তি বলতে কিছু থাকে না। আজকাল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়েছে। শিক্ষক যখন ছাত্রের প্রশ্ন শুনে বলেন, “এটা বোকার মতো প্রশ্ন”, তখনই ছাত্রের মধ্যে প্রশ্ন করার আগ্রহ হারিয়ে যায়। এর ফলে এক ধরনের মানসিক অসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়, যা ছাত্রকে ভবিষ্যতে জ্ঞানচর্চায় নিরুৎসাহী করে তোলে।
অসহিষ্ণুতার ভয়াবহ দিক হলো—এটা ছোঁয়াচে। একটি পরিবার, একটি সম্প্রদায়, এমনকি একটি রাষ্ট্রও যখন অসহিষ্ণু মানসিকতা লালন করে, তখন তা ক্রমেই সামাজিকভাবে সংক্রমিত হয়। এটা ঠিক যেমনটা ঘটে—যখন এক ব্যক্তি অন্যকে গালি দেয়, তখন অপরজনও প্রতিক্রিয়ায় গালি দিয়ে বসে। ধীরে ধীরে এই আচরণ একটি সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আজকের পৃথিবীতে আমরা সেই অসহিষ্ণু সংস্কৃতির চরম পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে মানুষ মতামত ভিন্ন হলেই শত্রু হয়ে ওঠে। অথচ মতের ভিন্নতা মানব সভ্যতার অন্যতম সৌন্দর্য। এই ভিন্নতাই নতুন ভাবনা, নতুন উদ্ভাবন, নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
অসহিষ্ণুতা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাধি। এটি নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন—জ্ঞান, শিক্ষা, মানবিকতা ও সহানুভূতির চর্চা। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রেই এই অসহিষ্ণুতা লালন করে চলে। পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ভিন্নমতকে সম্মান করার শিক্ষা যতটা থাকা উচিত, তা অনুপস্থিত। বরং পরীক্ষায় “একই উত্তর” লেখার প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একরৈখিক চিন্তা গড়ে তোলে। ফলে, শিক্ষার্থীরা শিখে যায় ভিন্ন কিছু বললে সেটাকে ‘ভুল’ হিসেবে ধরা হবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন, যেখানে যুক্তি-তর্ক, মতভেদ, প্রশ্ন করার অধিকারকে উৎসাহিত করা হবে।
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো—শ্রবণশীলতা। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের কথা ধৈর্য ধরে শুনতে না শিখব, ততক্ষণ পর্যন্ত অসহিষ্ণুতা দূর করা সম্ভব নয়। সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যারা ভিন্নমত শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন, কথা বলার পরিবর্তে গলা চড়ান। এটা আসলে আত্মবিশ্বাসের অভাবের লক্ষণ। যারা আত্মবিশ্বাসী, তারা অন্যের মতামত শুনে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার সক্ষমতা রাখেন; তারা গলা চড়িয়ে নিজের মত চাপিয়ে দেন না।
মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার বীজ বপন করতে হলে শৈশব থেকেই সন্তানদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, যুক্তিভিত্তিক চিন্তার চর্চা গড়ে তুলতে হবে। পরিবারকে হতে হবে শিশুদের প্রথম শিক্ষালয়, যেখানে ভিন্নমতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হতে হবে মুক্তমনা, যারা শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, বরং জীবনের শিক্ষা দেবেন। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে হতে হবে সহিষ্ণুতার পাঠশালা, যেখানে মানুষ শিখবে সব ধর্মের প্রতি সম্মান রাখতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অসহিষ্ণুতা কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি এক সামাজিক ব্যাধি, যা সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে। এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিদিন আমাদের নিজেদের আচরণ বিশ্লেষণ করতে হবে—আমি কি অন্যের মতামতকে সম্মান করছি? আমি কি ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতিশীল? আমি কি নিজের মতকে চেপে ধরছি অন্যের ওপর? এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিনের আয়নায় দেখতে হবে।
যতদিন পর্যন্ত আমরা একে অপরকে সম্মান করতে শিখব না, ততদিন অসহিষ্ণুতার আগুন আমাদের সমাজকে গ্রাস করবে। তাই প্রয়োজন সহিষ্ণুতা চর্চার একটি সামাজিক আন্দোলন। যেখানে মানুষ শিখবে শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে, ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে।
অসহিষ্ণুতা আমাদের উন্নয়নের পথে এক ভয়াবহ বাধা। এটি মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, সমাজে হিংসা ও অস্থিরতা ছড়ায়। তাই সময় এসেছে নিজেকে সংশোধনের, সহনশীলতার নতুন পাঠ নেওয়ার। একমাত্র মানবিকতা ও শ্রদ্ধাবোধের চর্চাই পারে আমাদের অসহিষ্ণুতার অন্ধকার গুহা থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত