‘জ্বলজ্বলে তারকা’ বাংলাদেশ থেকে শেখার আছে দক্ষিণ এশিয়ার
প্রকাশ: ২ জুন ২০২১, ০৮:১৯ | আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:০৩
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য আর কোনো রূপকথা নয় বরং দৃশ্যমান ও বাস্তব। মাত্র ১০ বছরেরও কম সময়ে আয়তনে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র এই দেশটির অর্থনৈতিক সাফল্যগাঁথা উঠে এসেছে ভারতের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কলামিস্ট মিহির শর্মার লেখায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অর্জন নিয়ে মিহির শর্মার কলাম উঠে এসেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর সম্পাদকীয়তেও। মিহির শর্মার সেই লেখার অনুদিত ও সম্পাদিত সারাংশ থাকছে এখানে-
অর্ধ-শতাব্দী আগে ১৯৭১ সালের মার্চে তুলনামূলক ধনী ও অধিক শক্তিশালী পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের মধ্যে জন্ম নেয় দেশটি। লাখ লাখ মানুষ ভারতে পালিয়ে যায় বা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নিহত হন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দেওয়া মার্কিনিদের কাছে মনে হয়েছিল ব্যর্থ হবে নতুন দেশটি। সেজন্য বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ (তলাবিহীন ঝুঁড়ি) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
এ মাসে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের জানান, গত বছর দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশের বেশি বেড়ে দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বর্তমানে এক হাজার ৫৪৩ ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তান ৭০ ভাগ ধনী ছিল। আর আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ ভাগ ধনী। এ কারণে এক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি বিষন্নভাবে দেখিয়েছেন যে, ‘২০৩০ সাল নাগাদ খোদ বাংলাদেশের কাছেই পাকিস্তানের সাহায্য চাইতে হতে পারে’।
ভারত- দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র অর্থৈনিক পরাশক্তি হিসেবে যার আত্মবিশ্বাস সেই তাকেও মেনে নিতে হচ্ছে যে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় সে গরীব। ২০২০-২১ সালে এসে ভারতের মাথাপিছু আয় প্রায় এক হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার।
তবে ভারত বাংলাদেশের এমন সাফল্যের স্বীকৃতি দেবে তা আশা করবেন না। দেশটির ডানপন্থী নেতারা এখনো বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ এতটাই নিঃস্ব যে, সেখান থেকে অবৈধ অভিবাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে (ভারতে) ঢুকছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতীয় রাজ্যগুলোতে যেখানে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা এখনো বাংলাদেশিদের ‘উঁইপোকা’ বলে সুর চড়াচ্ছেন, সেগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ধনী বাংলাদেশ। বিষয়টি এমন যেন- কানাডা থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিসিসিপি।
সম্ভবত এতেই স্পষ্ট হয় যে, জিডিপির সংখ্যা ঘোষণার সময় ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন ক্ষোভ ও অস্বীকৃতির বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিপরীতে, বাংলাদেশি গণমাধ্যম অনেক কমই তুলনা করেছে। এটা এক ধরনের আত্মবিশ্বাস যা দেশটির ধারাবাহিক উন্নতি থেকে আসছে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে: রপ্তানি, সামাজিক উন্নয়ন ও আর্থিক দূরদর্শিতা। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতি বছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে বৈশ্বিক রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র শুণ্য দশমিক চার শতাংশ (০.৪%)। আর এই সাফল্য এসেছে তৈরি পোশাকের মতো বিশেষ সুবিধা থাকা রপ্তানি পণ্যে কঠোর মনোযোগের কারণে।
এর মধ্যে বাংলাদেশে নারী শ্রম সম্পদের পরিমাণ নিয়মিতভাবে বেড়েছে যেখানে ভারত ও পাকিস্তানে শ্রম বাজারে নারীর উপস্থিতি কমেছে। একই সঙ্গে জিডিপি’র তুলনায় বাংলাদেশ তার সরকারের ঋণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যেই ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই অনুপাত প্রায় ৯০ শতাংশ। অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে দেশটির প্রাইভেট খাত ঋণ করে বিনিয়োগ করছে।
তবে বাংলাদেশের সফলতা আবার নিজে থেকেই দেশটির জন্য কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসছে। একটির উদাহরণ দিয়ে বললে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধার মতো উন্নত দেশে বিনা শুল্কে রপ্তানি হতে পারতো। এমন সুবিধা শুধু বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোই পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের উন্নয়নকে ধন্যবাদ যে, ২০২৬ বা এরপর থেকে বাংলাদেশকে এসব সুবিধার মায়া ত্যাগ করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও যতো পরিণত হবে এর তুলনামূলক সুবিধাগুলোও পরিবর্তিত হবে। ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের মতো, বাংলাদেশকেও তৈরি পোশাকের মতো পণ্য থেকে অধিকতর মূল্যের পণ্য রপ্তানির দিকে মনযোগী হতে হবে। এই পথচলায় বাংলাদেশকেও অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে পরীক্ষা দিতে হবে।
বৈশ্বিক সংহতিকরণ ও ক্রমশ পরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে টিকে থাকতে বাংলাদেশ সরকারকে আগামী দশকের জন্য এখনই কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। চৌকস পদক্ষেপ হবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনের মাধ্যমে নিজ পণ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট-আশিয়ান এর সঙ্গে এফটিএ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে; তবুও আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে।
উপরন্তু, বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের তুলনায় একধাপ এগিয়ে থাকতে হবে কেননা ভিয়েতনাম শুধু চীন কেন্দ্রিক আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের অংশই না বরং ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরকারী দেশও বটে। নিজেদের ব্যবসার ধরণ পরিবর্তন করা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে আর সে কারণে তাদেরকে এখনই শুরু করতে হবে। ঢাকাকে তাদের দেনদরবারের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে হবে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এমন দেনদরবার করার জন্য নিবেদিত বাণিজ্যিক আলোচক নেই।
এতদসত্ত্বেও, বিগত ৫০ বছর (আমাদের) এটা দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাজি ধরাটা কতোটা বোকামি ছিল। ১৯৭১ সালে (বাংলাদেশের জন্য) সফলতা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে দূরের এক বস্ত অর্জনের মতো মনে হচ্ছিল। আজ দেশটির ১৬ কোটিরও বেশি মানুষ যারা কিনা ভ্যাটিকান সিটির থেকেও অধিক ঘনবসতিতে একটি উর্বর জমিতে বাস করছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অভাবনীয় সাফল্য হিসেবে নিজেদের নিয়তির জানান দিচ্ছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত