৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি : বাঙালির অন্যতম তীর্থস্থান
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৬ | আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৯
সেই ১৯৯৮ সালে স্যাটেলাইট চ্যানেল স্টার প্লাস-এর ‘একদিন এক জীবন’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি বলেছেন তা দুর্ভাগ্যবশত শুনতে পাইনি; কিন্তু জনকণ্ঠের বদৌলতে জানতে পেরেছিলাম। জনকণ্ঠের রিপোর্টের শেষভাগে উল্লেখ আছে ‘অনুষ্ঠান শেষ হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে এসে, প্রধানমন্ত্রী এ সময় খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। নিহত প্রিয়জনদের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।’ ধানমন্ডি মাঠ পেরিয়ে শেখ রাসেল স্কয়ার থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে আমি তারপরই একবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িমুখো হয়েছিলাম; কিন্তু জনকণ্ঠের উল্লেখিত বাঙালির অন্যতম তীর্থস্থান ৩২ নম্বরকে কোথাও দেখলাম না। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনের রাস্তাটি প্রশস্ত হয়েছে, লেক সংস্কার হয়েছে, কিছু স্থাপনাও চোখে পড়ল কিন্তু ৩২ নম্বরটি কোথাও চোখে পড়ল না। ফেরার পথে দেখলাম সদ্য সংস্থাপিত ঝকঝকে নামফলকে লেখা ১১ নম্বর সড়ক। এই ১১ নম্বর সড়কটি আমাদের অজানা ছিল না, তবে কখনো চিনতে চাইনি। কেননা এতে আমি দেখিছি এক গভীর ষড়যন্ত্র আর ইতিহাস বিকৃতির উপাদান। ১৯৬১ সালে ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং সেই সালের অক্টোবর মাসে শেখ মুজিব সপরিবারে সেই বাড়িতে উঠলেন।
এই বাড়ি নির্মাণে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি শুধু বাড়ি নির্মাণের তদারকি করেননি বরং বঙ্গবন্ধু কারান্তরালে থাকলেও তিনি গেরিলা কৌশলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতেন। তিনি তাদের কাউকে বলতেন ইটওয়ালা, কাউকে সিমেন্টওয়ালা কিংবা কাউকে বলতেন বালিওয়ালা। জীবনে প্রথম পাদে তিনি শেখ মুজিবের পতিব্রতা স্ত্রী ছিলেন, ছিলেন শ্বশুর-শাশুড়ির অতি স্নেহের বধূ বা সন্তানদের সার্থক মাতা ও প্রতিপালক। জীবনের অন্যপাদে তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু, দার্শনিক ও পথ-প্রদর্শক। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সুখ দুঃখের সাথী ছিলেন না কিংবা বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও শক্তির উৎস ছিলেন না, তিনি প্রত্যক্ষ আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করে স্বাধীনতা আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে তিনি স্বামীর পাশে থেকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। কার্যত তিনি ছিলেন পদ-পদবিবিহীন আওয়ামী লীগের নেতা বা ছাত্রলীগের প্রধান পরামর্শক।
বঙ্গবন্ধু পরিবার ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এই বাড়িতে উঠার আগেই বঙ্গবন্ধু পরিবার প্রথমে ছিলেন গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনে, তারপর মন্ত্রিপাড়ার ৩নং মিন্টো রোডে, এরপর নাজিরা বাজার, আবদুল গনি রোড হয়ে সেগুনবাগিচায়। এরই মাঝে মুজিব ছিলেন বন ও কৃষিমন্ত্রী; পার্টির সাধারণ সম্পাদক, ৯২ ক ধারার আসামি, পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য, কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রী, টি বোর্ডের
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘাতকের বুলেটে জর্জরিত জাতির জনকের প্রাণহীন দেহ
চেয়ারম্যান, মার্শাল ল’য়ের ধকলে জেলবাসী ও আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড়সড় কর্তা। তখন ধানমন্ডিতে জমির দাম অবিশ্বাস্যরকম কম ছিল। কোথাও কোথাও কয়েক শ’টাকায় দু’এক বিঘা মিলে যেত। নিজের সঞ্চয় ও ধারকর্জের ওপর জমিটি কেনা হয় এবং বলতে গেলে একটি একটি করে ইট গেঁথে গেঁথে বাড়িটি তৈরি হলো। এ বাড়িতে একনাগাড়ে বঙ্গবন্ধু বেশি দিন কখনো থাকতে পারেননি। এই বাড়ি থেকে মুজিব বারবার জেলে গেছেন আবার এ বাড়িতেই ফিরে এসেছেন।
এই বাড়িতেই ৬ দফা অঙ্কুরিত হয় এবং ৬ দফার সমর্থনে জনসভার বক্তব্য মশ্ক করা হয়। এই বাড়ি থেকে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ৮ মে বলতে গেলে স্থায়ীভাবে জেলে যান। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত আসামি মুজিব আবার এ বাড়িতেই ফিরে আসেন। সশস্ত্র পন্থায় দেশ স্বাধীনের নীলনকশার খসড়া তৈরি হয়। এই বাড়িতে বসে স্বৈরাচার ও সামরিক অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচি প্রণীত হয়; নেতাকর্মীদের দীক্ষিত করা হয়। ত্যাগের প্রতিশ্রæতি প্রস্তুত হয়। এই বাড়িতে বসেই গোলটেবিলে বসার কথা আলোচিত হয়, নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়, আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো সংশোধনের প্রস্তাব আসে। এখানেই বসে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ তৈরি করেন, ভাষণের রিহার্সেল দেন, সমগ্র অসহযোগকালে বিভিন্ন নির্দেশনামার অধিকাংশ এখান থেকেই প্রচার হয়। এই বাড়িতেই ফারল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠক হয়; দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেয়া হয়। লাখো লাখো মানুষের সশ্রদ্ধ অভিবাদন ও আন্তরিক ভালোবাসা গৃহীত হয়। এই বাড়ি থেকে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রাণের বিনিময়ে হলেও অর্জনের শপথ ধ্বনিত হয়। এই বাড়িতে ২৩ মার্চ পাকিস্তানের পতাকার বদলে বাংলাদেশের লাল সূর্য খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। মানুষের পদভারে এই বাড়ির সবুজ ঘাস তামাটে বা সাদাটে হয়ে যায়। এই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। এই বাড়িতে নেতাদের প্রাত্যহিক ব্রিফিং ও সর্বশেষ ব্রিফিং দেয়া হয়। এই বাড়ি থেকে যোদ্ধাদের অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এই বাড়ি থেকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বন্দি হন। এই বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, ইট, পাথর যে স্বাধীনতার ঘোষণা ধারণ করেছিল; তা-ই নয় মাস বাঙময় থাকে। লাখো লাখো প্রাণ, ইজ্জত, আব্রু, সহায় সম্পদের বিনিময়ে মুজিবাদর্শের বাঙালিরা বিজয় ও তাদের নেতাকে ছিনিয়ে আনে। জাতির পিতা আবারো এই বাড়িতেই বসত গড়েন। এখান থেকে দেশ শাসন করেন আর ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে সপরিবারে নিহত হন। এ সবই স্মৃতি কিন্তু আবার সবই ইতিহাস।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সব স্মৃতি মুছে দিতে সব ধরনের প্রচেষ্টায়ই চলমান রাখা হয়। ফলশ্রুতি হিসেবে জয়বাংলা জিন্দাবাদ; বাংলাদেশ বেতার, রেডিও বাংলাদেশ, বাঙালি বাংলাদেশি হয়ে যায়, স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক তুঙ্গে তোলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের নতুন সর্বাধিনায়ক আবিষ্কার করা হয়, অর্থাৎ মুজিব, মুজিবের বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাকে মুছিয়ে দিতে, গুঁড়িয়ে দিতে, বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিতে সব রকম আয়োজন করা হয়। ৩২ নম্বরকে বিস্মৃতির অতলে ফেলার প্রয়াসও হয়তো ঘাতক বা তাদের সহযোগীদের ছিল। একদিন দেখলাম ধানমন্ডির রাস্তাঘাটের নতুন নম্বর দেয়া হচ্ছে। এই নতুন নম্বরকরণ প্রক্রিয়ায় ৩২ নম্বর ১১ নম্বর হয়ে গেল কিন্তু মুজিব ভক্তদের কাছে তা ৩২ নম্বরই রয়ে যায়। আড়ালে-আবডালে তা হলো তাদের তীর্থস্থান। ১৯৭৫ সালের পর এই তীর্থে কখনো নীরবে পদচারণা করেছি; এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেছি, উর্দিওয়ালাদের ধমক খেয়েছি; কোনো কোনো সময় ভয়ে গা ছমছম করে উঠেছে। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখানে অফিস করতে দেখেছি, চোখের সামনে বাড়িটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত হতেও দেখেছি।
৩২ নম্বরকে যারা ১১ নম্বর করেছিল তাদের উদ্দেশ্যকে আমি কেন, বাংলার আপামর জনতাও প্রশ্রয় দেয়নি। এখনো রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়িওয়ালা, মুটে মজুর, ধোপ-দুরস্ত নগরবাসীর কাউকেই ৩২ নম্বর তেমন একটি চিনিয়ে দিতে হয় না। কেউ বলে শেখের বাড়ি, কেউ বলে মুজিবের বাড়ি, কেউ বলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, কেউ বলে জাতির পিতার বাড়ি। আজকের প্রজন্ম বলে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। জানি না এই জাদুঘরের ঠিকানাকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করার জন্য কিংবা রাস্তার নম্বরের শৃঙ্খলার খাতিরে আকস্মিকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল কিনা। প্রতিপক্ষ যাকে আক্রোশে মুছে দিতে চেয়েছিল আমরা আজতক তাকে হৃদয়ে ধরে আছি। যদি আমরা ৩২ নম্বরের বদলে ১১ নম্বরকে মেনে নিতাম তাহলে আমাদের আবেগ, ভালোবাসা, বস্তুনিষ্ঠতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা থাকত কোথায়? এই বিচ্যুতি এড়াতে জননেত্রী শেখ হাসিনা ৩২ নম্বরকে ৩২ নম্বরই রাখার ব্যবস্থা করেছেন। শোভা পাচ্ছে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়ক। এটা আবেগ প্রকাশের চেয়েও অবিকৃত ইতিহাস সংরক্ষণেরও প্রয়াস। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু ততদিন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকবেন; ৩২ নম্বর বাঙালির অন্যতম তীর্থ হয়ে থাকবে। এখন বয়োজ্যেষ্ঠসহ তারাও সেখানে যায়। আমাদের দাবি বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, আত্মবলিদান ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত সব প্রতীক ও চিহ্নকে অটুট ও অবিকৃত রাখতে হবে। বাংলাদেশের বাইরে ইসলামিয়া কলেজ হোস্টেলটির যে কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু থাকতেন, তা যদি বিশেষ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা যায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত সবই সংরক্ষণ সম্ভব। এটার বাস্তবায়ন কঠিন কিছু নয়, কারণ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই বাড়ি থেকে নেতা মুজিব ও পিতা মুজিবকে পাকিস্তানিরা ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু নেতার আদর্শে সারা জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নেতা ও পিতা থেকেই তিনি হলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, নেমে এলেন নয়ন থেকে হৃদয়ে। বাঙালি বুঝল ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।’ তাকে হৃদয়ে আর তার আদর্শকে মন, মনন ও মগজে ঠাঁই দিয়েছি বলে আমরা অমিত বিক্রমে লড়তে পেরেছি, তার নির্দেশে হেসেছি, কেঁদেছি, লড়েছি, মরেছি-জয়ী হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্বে আমরা তাকে সদা উপস্থিত পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব সমাপ্ত হলে আমরা আবারো সশরীরে তাকে দ্বিতীয় পর্বের মহানায়ক হিসেবে পেয়েছি। এবারো তিনি সর্বাধিনায়ক; তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে রাষ্ট্রযন্ত্র হাতে নিলেন। কিন্তু মনের আগুন, ক্ষেতের আগুন, কলের আগুন আর প্রত্যাশার আগুন নেভাতে নেভাতে তিনি নিঃস্ব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। পরিকল্পিত পন্থায় তাকে নিন্দিত ও বিচ্ছিন্ন করা হলো। এই পর্বের সৈনিকরা অধিকাংশ কিন্তু ২৩ বছরের সংগ্রাম ও ৯ মাসের যুদ্ধের সহযাত্রী বা সহযোদ্ধা ছিলেন না। মুষ্টিমেয় কিছু ছাড়া অন্যরা ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম ও ৯ মাসের সশস্ত্র যোদ্ধাদের তুলনায় কমই নিবেদিত ছিলেন এবং তাদের চৌর্যবৃত্তি যে নিবেদিত ও পরীক্ষিতদের বিক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছিল তার প্রমাণ মিলল ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের কালরাতে। চাটার দল বা হতাশাগ্রস্তরা তাকে রক্ষা করতে পারেনি, পারেনি তার স্বজনদের কিংবা যোগ্য সহকর্মীদের রক্ষা করতে।
১৫ আগস্টের কালরাতে এই বাড়িতে আরো যারা শহীদ হলেন তারা হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, জামাল ও কামালের নব পরিনীতাদ্বয়, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ নাসের, কর্নেল জামিলসহ কর্তব্যরত তিনজন কর্মকর্তা।
তারপর বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে দেবার প্রচেষ্টা নিরন্তর কার্যকর ছিল। পরিকল্পিতভাবে তাকে বিস্মৃত করার প্রচেষ্টাও ছিল এবং আছে কিন্তু সুদীর্ঘ সময়ের ইতিহাস বিকৃতি, অপপ্রচার বা চরিত্র হনন তাকে বাঙালির স্মৃতি থেকে মুছে দিতে পারেনি। তার তিরোধান আমাদের স্মৃতিকে বেদনায় ভরে দিলেও তিনি শুধু বেদনা নন বরং প্রেরণা। এই স্মৃতি ও চেতনাকে তারই নিবেদিত ও পরীক্ষিত অনুসারী ও যোদ্ধারা ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে তার স্থান আমাদের শুধু মগজে নয়, নয়নে নয়, শ্রুতিযন্ত্রে নয়, তার স্থান আমাদের হৃদয়ে, বাঙালির হৃদয়ে। বাংলাদেশের ন্যায় তাকেও চির অস্লান ও চিরজীবী রাখতে হলে তার স্বপ্ন তথা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। আজকে তার ত্যাগী, যোগ্য, পরীক্ষিত, নিবেদিত কর্মীদের মূল্যায়ন, আমলা-নির্ভরতা পরিহার ও সদ্য রূপান্তরিতদের কম গুরুত্ব দিয়ে সোনার বাংলার স্বপ্ন রূপায়নে এগিয়ে যেতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসা¤প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে ও চলবে। এই লড়াইয়ে একদিকে ঘাতক-দালালদের নির্মূল করতে হবে, অপর ফ্রন্টে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে ব্যক্তি মুজিব, বন্ধু মুজিব, পিতা মুজিব, আদর্শ মুজিব, মানবিক বাঙালি মুজিব বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন তার রাজসিক আসনটি দখল করে থাকবেনই। ১৫ আগস্ট যারা আমাদের জন্যেই আত্মাহুতি দিলেন তারাও অবিনশ্বর থাকবেন।
আমাদের দুর্ভাগ্যের মাঝেও পরম সৌভাগ্য যে শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে সে ১৯৮২ সাল থেকে অধিষ্ঠিত আছেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার কিংবা তা আরো সমৃদ্ধশালী করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সুফল সারা জাতি পাচ্ছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হলে এবং সুদীর্ঘ সময় অধিষ্ঠিত না থাকলে তার সামান্য কিছুও অর্জিত হতো না। তবে বর্তমানে ৩২ নম্বর রোডের ৬৬৭ নম্বর বাড়িটি আর এখন শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানার বাড়ি নয়, এখন তা জনগণের তীর্থস্থান-সম্পদ। এটা মহান জাতির, মহান স্থপতি, জাতির পিতা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের স্মৃতি স্বাক্ষরই এই বাড়িটি নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। বঙ্গমাতার অনেক প্রয়াসেরও একটি নিদর্শন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত