২৬ মার্চ ১৯৭১: পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ১০:০৬ | আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:২৮
[স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন, জীবন দিয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি]
২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিন বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়। শুধু বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিন একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্মের স্বাক্ষী হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। আমাদের জাতীয় জীবনে শুরু হয়েছিল স্বাধীন দিন। যদিও সেই স্বাধীনতার বিজয় আসতে লেগেছিল নয় মাস সময়। নয় মাসের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ শেষে একই বছরে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাঙলার ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক নারী বর্বর গণধর্ষণের বিনিময়ে জাতি স্বাধীনতার বিজয় ছিনিয়ে আনে। কাজেই ২৬ মার্চ দিনটির গুরুত্ব মহান। ইতিহাস এই দিনটির জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছে। ইতিহাসের সেই প্রেক্ষাপটের আলোচনা ছাড়া দিনটির গুরুত্ব বোঝানো যায় না।
১৯৪৭ সাথে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পরেই পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের পূর্ববাঙলার জনগণের আবহমানকাল ধরে চলতে থাকা হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পালটে দেওয়ার পায়তারা করে। এমন কি তারা আমাদের মাতৃভাষাকে পর্যন্ত পালটাতে পরিকল্পনা করে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (২ নভেম্বর, ১৮৮৬ - ২৯ মার্চ, ১৯৭১) আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানে পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলির জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত বলে তিনি গণপরিষদে মত দেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবি নাকচ করে দেন। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয় এবং একই সঙ্গে মুদ্রার নোট এবং স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেন।১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্বপাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা'।
তারা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে পূর্বপাকিস্তানের লোকজন সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এদেশের সর্বস্তরের জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে নেমে আসে মাতৃভাষার মান রক্ষার দাবীতে। ছাত্রদের একটি দল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসলে পুলিশ তাদের উপর অতর্কিত গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে নিহত হয়। মাতৃভাষার দাবী থেকেই স্বাধীকার আন্দোলনের বীজ বপন হয়। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে সেই আন্দোলন-সংগ্রাম একাত্তরে এসে পৌছায়। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ ও ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামীলীগ গঠনের মাধ্যমে সেই আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে বেগবান হয়। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আমাদের রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে উজ্জীবিত করে, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তার প্রভাব ফেলে এবল ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার প্রতিফলন দেখা দেয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয় নি। এবিষয়ে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেছেন, 'সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তার প্রেক্ষাপটে জাগরণের শক্তি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই আন্দোলনে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালির আত্মজাগরণের জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন। এই দুটো জায়গায় নিজের ভূমিকাকে আত্মপ্রত্যয়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাঙালির মানসপটে বিপুলভাবে আত্মজাগরণের দরজা খুলে দেন। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে। শুরু হয় স্বাধীনতার স্বপ্নে নিরন্তর যাত্রার দুঃসাহসী ভূমিকা। সত্তরের নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান বিপুল সাহসী চৈতন্যে ঐক্যবদ্ধ বাঙালির তোরণ উন্মোচন করেন। বিশ্বজুড়ে বাঙালির জাগরণ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা বিপুল সাহসী প্রত্যয় বিশ্বের মানচিত্রে প্রলয় ঘটায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার আসনে আসীন করে বাঙালি নিজের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটায়। পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর সামরিক শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন হতে দেননি। সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান নির্বিচারে দেশকে শাসন করে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে অপসারিত হয়ে আর একজন সামরিক ব্যক্তি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে বিদায় গ্রহণ করেন। সাতচল্লিশ–পরবর্তী সময় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি জাতির অধিকারের প্রশ্নে প্রবলভাবে সচেতন ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলুন বলে দাবি করেছিলেন। বাঙালির আত্মমর্যাদার জায়গাকে তিনি নিরন্তর স্মরণ করিয়েছেন দেশবাসীকে। ছয় দফা সনদে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর রাজনীতির সচেতন বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল গণমানুষ।
পূর্ব বাংলার দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকায় সত্তরের নভেম্বে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় হয়। এই মহাপ্রলয়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এলাকায়। এরপর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে। আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে দেয়। সত্তরের নির্বাচন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে বৃহত্তর স্বার্থে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালি বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু যে উদাহরণ দিয়ে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর হাতে বাঙালির বঞ্চনার দিক তুলে ধরেছেন, তার নিরসনকল্পে ঐক্যের শক্তির সামর্থ্যে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে এমন ঘোষণা করার পর আবার সেই তারিখ ১ মার্চ স্থগিত ঘোষণা করে ইয়াহিয়া খান। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশজুড়ে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা হবে বলে জানান। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালির সর্বাত্মক চেতনায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধে দুঃসাহসী বোধ প্লাবিত হয়। সাহসের দুর্জয় ঘাঁটি নিয়ে দেশের সব স্তরের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন প্রতিরোধের আলোকে। ৭ মার্চের বক্তব্যে ঘোষিত হয়, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'।'
একাত্তরের মার্চ জুড়ে মানুষের মনে নানা আশঙ্কা ছিল। অপারেশন সার্চলাইট নামে ১৯৭১সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তর পরিকল্পিত গণহত্যা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন গবেষণা বিভাগ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত খবর পর্যালোচনা করে একটি টাইমলাইনটি তৈরি করে। ১ মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য সারা বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো ও জনাব কাউয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজি ছিলেন।’ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২ মার্চে ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা। মার্চের ২ তারিখে সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন। বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ, গুলিবর্ষণ। পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের ডাক, ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ
১) ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন।
২) ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করতে হবে।
৩) রেডিও, টেলিভশন ও সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নাকচ করে দিতে হবে।
৪) আগামী ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণদান করবো। সেখানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করবো।
৫) সংগ্রাম সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে এবং গণবিরোধী শক্তি ও তাদের ভাড়াটিয়া চরদেরই স্বার্থোদ্ধার করবে।
এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তলন করা হয়।
৩ মার্চে বিভিন্ন স্থানে মিছিলে গুলিবর্ষণ, ঢাকায় ২৩ জন নিহত, চট্টগ্রামে ৭৫ জন। ঢাকা, সিলেট ও রংপুরে কারফিউ জারি। ৪ মার্চে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে ১১৩নং সামরিক আইন আদেশ জারি। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ১২১, খুলনায় নিহত ৬। ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার। সাংবাদিক ও শিল্পীদের একাত্মতা: জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ডাক দিয়েছেন সাংবাদিক ইউনিয়ন, মিছিল ও জনসভার সিদ্ধান্ত। সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি। স্বাধিকার আন্দোলনকে সফল করতে নিউজপেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভার প্রস্তাব, যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প গ্রহণ। ২০ জন বিশিষ্ট শিল্পীর যুক্তবিবৃতি, বেতার টেলিভিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত। ৫ মার্চে টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ, ৪ জন নিহত ২৫ জন আহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮। রাজশাহী রংপুরে আবার কারফিউ।
৫ মার্চে টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ, ৪ জন নিহত ২৫ জন আহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮। রাজশাহী রংপুরে আবার কারফিউ। ভুট্টোর সাথে ইয়াহিয়ার ৫ ঘণ্টা বৈঠক। গভীর রাতে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাঁচ ঘণ্টা ম্যারাথন বৈঠক করেন। স্বাধিকার আন্দোলনে শামিল হলন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা: চলমান দমন-পীড়নকে গণহত্যা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির বিবৃতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ ও যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা দেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা। ৬ মার্চে জাতির উদ্দেশে ইয়াহিয়ার ভাষণ, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ডাক। জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলি ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত, সান্ধ্য আইন অব্যাহত। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণ- ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত।
৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণদান। জনগণের প্রতি নতুন নির্দেশ ও অধিবেশনে যোগদানের চারটি শর্ত প্রদান। অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত:
১) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে
২) সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে
৩) নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করতে হবে
৪) নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ দেন-
১) বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন
২) সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে।
৩) রিকশা, বেবি, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না এবং সেক্ষেত্রে তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না।
৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না।
৫) শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
৬) স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন।
৭) সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন।
৮) ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়।
৯) অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনও সময় আবার অংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের বাঙালি কর্মীদের অসহযোগিতার কারণে বিকালে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার। সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভবনের সামনে বোমা নিক্ষেপ।
৮ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের একাত্মতা ঘোষণা। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্তবিবৃতিতে বলেন, 'বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ ঘোষণা করিয়া স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াছেন আমরা উহার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া স্বাধীনতার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপাইয়া পড়িবার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাইতেছি এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত সকল নির্দেশকে যথাযথ কার্যকরী করিবার জন্য সমগ্র দেশবাসীকে বিনা দ্বিধায় বাস্তবায়িত করিবার আহ্বান জানাইতেছি এবং কোনও মহল এই কর্মসূচির অন্তরায় সৃষ্টি করিলে তাহাকে অবশ্যই প্রতিহত করিবার জন্য আবেদন জানাইতেছি।' অস্থানীয়দের ঢাকা ত্যাগের হিড়িক। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের দেশত্যাগের জন্য কোনও বিমান টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীরা জীবন দিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শিল্পীদের সিদ্ধান্ত, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনের সকল অনুষ্ঠান বর্তমান গণআন্দোলনের অনুকূল হইবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে করার শর্তে বেতারকর্মীদের কাজে যোগদান।
৯ মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সকল সরকারি অফিস অচল। মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি পরিবর্তন করে সামরিক শাসন পরিচালক পদে লে জে টিক্কা খানের নিয়োগ। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন। এই সভায় আরেকটি প্রস্তাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাংলাদেশে জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়। পল্টনে জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন ২৫ মার্চের পর শেখ মুজিবের সাথে আন্দোলন করবেন। টেলিফোনে মুজিব ভাসানী আলোচনা হয়। ঢাকা থেকে বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নিতে স্ব-স্ব দেশ থেকে বিমানের ঢাকায় অবতরণ। ‘প্রয়োজনবোধে’ জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। রাজশাহীতে কারফিউ জারি, প্রতিবাদ।
১০ মার্চে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের যুক্তবিবৃতি, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার অনুরোধ। পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমানবন্দরে চেকপোস্ট বসিয়ে অবাঙালিকে দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার হুমকি।
১১ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট ভুট্টোর তারবার্তা। ঢাকায় আসতে রাজি আছেন বলে জানান। পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের ইয়াহিয়ার প্রতি বার্তা, অবিলম্বে প্রতিকার না করা গেলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে, নিউজপ্রিন্টের অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রের কলেবর হ্রাস। করাচি ডনসহ পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোর কলেবর ১৪ পৃষ্ঠার পরিবর্তে মাত্র ৪ পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। এসব পত্রিকা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কাগজ ব্যবহার করে। গত ১ মার্চ থেকে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান বন্ধ করা হয়েছে। ৩২ হাজার টন গমভর্তি জাহাজ ভিনটেজ হরিজন ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা থাকলেও গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি অভিমুখে যাত্রা করেছে।
১২ মার্চে লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এক প্রতিবেদনে বলেছে শক্তি প্রয়োগ নিষ্ফল ও বিপজ্জনক হবে। প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয় যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক। জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে স্বদেশে প্রেরণ। সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে সারা আলীর তোপখানা রোডের বাসায় অনুষ্ঠিত মহিলা পরিষদের এক সভায় পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
১৩ মার্চে সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি। সকল বেসামরিক কর্মচারী যাদের প্রতিরক্ষা খাত থেকে বেতন দেওয়া হয় তাদের ১৫ মার্চ সকালে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ। অন্যথায় চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি। এ ধরনের নির্দেশকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
> পশ্চিম জার্মানির ৬০ জন, জাতিসংঘের ৪৫ জন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের ৪০ জনসহ মোট ২৬৫ বিদেশিকে ঢাকা থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
১৪ মার্চে দুই পাকিস্তানে দুই দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা ভুট্টোর। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলছে, চলবে। অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ। বাংলার অসহযোগে পশ্চিমা শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস। সামরিক সরকারের প্রতি স্মরকলিপি প্রদান। বঙ্গবন্ধুর চার দফা মেনে নেওয়ার আহ্বান। হরতালের কারণে ফল চালান করতে না পারায় লাহোরে শত শত মণ ফল নষ্ট। করাচিতে প্রতি সের পান ১৫০ টাকা হয়েছে। ঢাকার পান না পেয়ে করাচিতে পান বিরল হয়ে পড়েছে।
১৫ মার্চে ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সফরসূচিতেও গোপনীয়তা। ভুট্টোর দুই পার্টি সমাধানে পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যাপক ক্ষোভ। সর্বমহলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ভুট্টোর সমাধানকে অগণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে সকল কাজে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের এক সভায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের গণবিরোধী ভূমিকার নিন্দা করা হয়। বেতার কেন্দ্রে সংগ্রাম কমিটি গঠন।
১৬ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু। বঙ্গবন্ধু একটি সাদা গাড়িতে চড়ে বৈঠকে যান। গাড়ির সামনে ছিল একটি কালো পতাকা এবং উইন্ডো সিল্ডে বাংলাদেশের মানচিত্র, একটি পতাকার প্রতিকৃতি লাগানো ছিল। প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে বের হওয়ার পূর্বে তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। নিউজউইকের পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণাই করলেন। জনৈক এক পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক লোরেন জেনকিনসে লিখেন, ‘পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে ইহা কোনও প্রশ্ন নয়, বরং পরিস্থিতি হঠাৎ এতদূর গড়াইয়াছে যে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল কি পরবর্তী সপ্তাহে কিংবা আগামী মাসে অথবা দুই বৎসর পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে ইহাই প্রশ্ন।’ জামালপুরে হাজার হাজার লোকের লাঠি ও নানান রকম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল।
১৭ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় দফা বৈঠক সম্পন্ন। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। জনগণকে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান। ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশগামী সকল বিদেশি বিমানের চলাচল নিষিদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানগামী সকল বিমানকে ভারতে একবার অবতরণ করতে বলা হয়েছে। বিদেশি বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা বহন করে পূর্ব পাকিস্তান নেওয়া রোধ করতে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা নিয়েছে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন। আওয়ামী লীগের তদন্ত কমিটি বর্জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এই তদন্ত কমিশন চাই নাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে এই তদন্ত কমিশনের সাথে কোনও সহযোগিতা না করতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
১৯ মার্চে জয়দেবপুরে জনতায়-সেনাবাহিনী সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর উসকানিমূলক হামলায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। সেনাবাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব-ইয়াহিয়া তৃতীয় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত। ৯০ মিনিটের বৈঠকে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, মুজিবকে সমর্থন দেওয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘গান্ধিজীর পরে শেখ মুজিবুর রহমানই এতখানি বিশাল আয়তনে অহিংস শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা লাভ করিলেন’। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যেরূপ সাফল্যের সহিত জনসাধারণকে সর্বাত্মক ঐক্যে তাহার পশ্চাতে কাতারবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন, সমগ্র ইতিহাসে অন্য কোনও নেতার জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া বাহির করা খুবই দুষ্কর।’
২০ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া চতুর্থ দফায় বৈঠক। সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই বৈঠকে আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
২১ মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব অনির্ধারিত বৈঠক। ৭০ মিনিটের এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচি প্রদান করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কর্মসূচির মধ্যে আছে ভোর ছয়টায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। সাড়ে ছয়টায় প্রভাত ফেরি সহকারে শহীদদের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ। সকাল ৯টায় পল্টনে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ। বেলা ১১টায় বায়তুল মোকাররমে ছাত্র জনসভা।
২২ মার্চে ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়, শেষ মুহূর্তে যদি অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। ২৩ মার্চ ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টো আলোচনার অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। চারি দফা পূর্বশর্ত পূরণ করা না হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়া এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো উভয়েই উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সম্ভাবত সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তেই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালেই গতকাল প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহৃত এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে।’ এদিকে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ডাক বঙ্গবন্ধুর। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। পত্রিকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত বাংলাদেশের পতাকার মাপ ও বিবরণ প্রকাশ। পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপে ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমোদন। ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশগামী বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলকালে ব্রিটেন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলো।
২৩ মার্চে দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে, বাড়িতে, গাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় থাকা বিমানবন্দর ভবন, প্রেসিডেন্ট ভবন ও লাটভবন ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের বৈঠক। কোনও প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০নং সেক্টরে একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়েছে। বোমা হামলা করা হয়েছে। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে অগুন দেওয়া হয়েছে। শামীম আখতার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও তাকে ছেড়ে দিতে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পুলিশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিরপুরে অবস্থানরত অবাঙালিরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন।
২৪ মার্চে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেছে। সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ, রংপুরে কারফিউ। নিজ বাসভবনের সামনে জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তৃতা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান।
২৫ মার্চের রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে। অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান তিনটি লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অপর দু'টি পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন।
২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরীহ জনগণের উপর হামলা চালায়।, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়, নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় এবং অনেক স্থানে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকান্ড চালানো হয়। এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং বহু জায়গায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই পাকবাহিনীকে ব্যারিকেট দিতে শুরু করে। পরবর্তিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাবার পর আপামর বাঙালি জনতা পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ ভোর থেকে বিবিসি'র খবরে ২৫ মার্চের গভীর রাতের অন্ধকারে সুসজ্জিত পাকবাহিনীর নিরস্ত্র মানুষের উপর নৃশংস হত্যা আক্রমণের ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। দলে দলে মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে আসতে শুরু করে। এর মাঝেই স্বাধীনতার ঘোষণা আসে, যুদ্ধের ডাক আসে- মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সারা দেশে মিলিটারি নামে, থানায় থানয় মিলিটারি ক্যাম্প বসায়। স্থানীয় রাজাকারের দল মিলিটারিদের সহযোগিতা দেয়। ভয়, আতঙ্ক আর আশঙ্কা বাড়তে থাকে মানুষের মনে, মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধারাও সংগঠিত হতে থাকে। ২৫ মার্চে সবচেয়ে বড় নৃশংস অভিযান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাকিস্তানি সেনারা রাতভর গণহত্যা চালিয়ে ভোরের দিকে লাশ গণ করব দিয়ে ফিরে যায়। মেজর সিদ্দিক সালিক পরবর্তী সময়ে 'উইটনেস টু স্যারেন্ডার বইতে এ বর্ণনা দিয়েছেন- ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ করেছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো, অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।'
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয় এই ঘোষণা- 'এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।' স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ২৬ মার্চ থেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করেন। পরবর্তীতে ভারতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। অন্যরা দেশেই আত্মগোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ২৬শে মার্চ বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েক'জন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান প্রথম শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। পরে ২৭শে মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে ফলাও করে ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার নিউজ প্রকাশিত হয়। বিদেশি সাংবাদিকেরা অনেক বাধার মুখে পড়লেও বিভিন্নভাবে তারা খবর সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস (আ.ফ.ম সাঈদ)' বইতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সংকলন অনুযায়ী বিবিসির খবরে তখন বলা হয়েছে, 'কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।'
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছিল- 'ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন'। দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিল- 'বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।'
লন্ডন থেকে দি ডেইলি টেলিগ্রাফ নিউজ করে- '২৭শে মার্চ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় 'সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ, এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়। দি গার্ডিয়ানের ২৭শে মার্চ সংখ্যায় এক খবরে বলা হয়, '২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই 'দি ভয়েস অব বাংলাদেশ' নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।'
ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭শে মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, 'বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।'
নিউইয়র্ক টাইমসেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়েছিলো। পাশেই বলা হয়েছে 'স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিব আটক'। বার্তা সংস্থা এপির একটি খবরে বলা হয়, 'ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।' আয়ারল্যান্ডের দি আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিলো- পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিলো শেখ মুজিবের ছবি।
দিল্লি থেকে রয়টার্সের খবরে ২৬ মার্চে ১০ হাজার মানুষের নিহত হবার ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে, এমন কথা বলা হয়। ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।'
তথ্যসূত্র
১) উইকিপিডিয়া, দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া
২) বিবিসি বাঙলা নিউজ, লন্ডন
৩) দৈনিক ইত্তেফাক
৪) দৈনিক সংবাদ
৫) দৈনিক প্রথম আলো
৬) বাঙলা ট্রিবিউন
কৃতজ্ঞতা
১) কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন
২) গবেষক মিজানুর রহমান
৩) গবেষক নুসরাত টিসা
Sent from Yahoo Mail on Android
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত