১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের  পিছনের কথা

  নূরুদ্দীন দরজী

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৫ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১৫:৩৩

পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি  বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলার স্বর্গ রাজ্য। পাক ভারত উপমহাদেশের দক্ষিণ পূর্ব ধারে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পারে  সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ও বন কুন্তলা এ দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা,শরৎ, হেমন্ত,শীত ও বসন্তে বাহারী রুপে ফুটে উঠে পাগলকরা আকুতি আনে প্রতিটি বাঙালি মনে। নদ নদীতে ভরা সমুদ্রমেখলা আমাদের সোনার বাংলা। নিরবে সরবে বয়ে চলে অসংখ্য নদ নদী। তীরে তীরে গড়ে উঠেছে অনেক লোকায়িত  সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বঙ্গোপসাগরের  আদ্রতা নিয়ে এখানে বৃষ্টিপাত হয় এবং হিমালয়ে সৃষ্ট প্রায় সকল নদী এ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শান্ত হয় সাগর মোহনায়। সমুদ্র সৈকত, পাহাড় অরণ্য,উচু নিচু  সমতল ও টিলা টেঙ্গরে ঘেরা উর্বর ভূমি। এখানে আছে যোজন সৃষ্টিকারী খাল বিল।

এদেশ বাঙালিকে কবি বানায়। বিভিন্ন পার্বণে নেচে গেয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেথে উঠে বাঙালিরা। হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ রয়েছে দেশের এক এক অঞ্চল। রয়েছে উপজাতিদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির আবহ ধারা। শান্তি সুখের এ অনাবিল বাসভূমি পৃথিবীর বুকে জেগে থাকা আমাদের বাংলাদেশ।

যুগে যুগে এখানে এসেছেন অনেক বিদেশী মনীষী পর্যটক। এসেছেন ইবনে বতুতা,হিউয়েন সাঙেরা। তাঁদের‌ই একজন ফরাসী পর্যটক বার্ণিয়ার বাংলার রুপে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন' বাংলায় আসার অনেক রাস্তা থাকলে ও এখান থেকে বের হয় যাওয়ার কোন রাস্তা ও নেই,। মোটামুটি আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,এক সময় বাংলা ছিলো অনেক অনেক সমৃদ্ধশালী। আমাদের ছিলো গোলা ভরা ধান, গোয়ালে ভরা দুধাল গরু আর পুকুর ভরা মাছ। আমাদের সম্পদ,  রুপকথা ও ঐশ্বর্যের কথা শুনে কোন কোন বিদেশি হিংসুটে পরশ্রীকাতর হয়ে বাণিজ্যিের নামে এ দেশে এসে নানা কৌশলে আমাদের সম্পদ লুটে নিতে থাকে।  সুখের রাজ্যে হানা দিয়ে আমাদের নিঃস্ব করতে থাকে। এ দেশের মাটি অতিশয় উর্বর,সুজলা সুফলা হ‌ওয়ায়  অনায়াসে প্রচুর ফসল ফলে ও বৃক্ষ জন্মে। কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্য এ ফসলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু আগাছা হয়ে কতিপয় বেঈমান বিশ্বাসঘাতক জন্মগ্ৰহণ করে। তাদের চরম বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বিদেশি বেনিয়ারা এখানে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে বার বার।

যুগে যুগে নানাভাবে এ দেশে এসেছেন বিভিন্ন মনীষী ও অনেক পর্যটক। আবার নানা ছদ্ধাবরণে এসেছে কৌশলী বিভিন্ন দেশের দস্যুরা। এ দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের হাত ধরে কেড়ে নিয়েছে আমাদের শাসন ক্ষমতা। সু শাসনের নাম করে সোনার বাংলা থেকে তারা পাচার করেছে অজস্র সম্পদ। আমাদের সম্পদ নিয়ে তারা ধনী হয়েছে আর আমরা হয়েছি নিঃস্ব হতে নিঃস্বতর। ইতিহাস সাক্ষ্য হয়ে আছে প্রাচীন কাল হতেই বাংলার সম্পদের  উপর দৃষ্টি ফেলে এসেছিলো মৌর্য,গুপ্ত,পাল ও সেনেরা। এসেছিলো পাঠান, সুলতান ও মোঘলেরা। পঞ্চদশ শতাব্দী বা তার আগ থেকেই অশুভ দৃষ্টি ফেলেছিলো পর্তুগিজ, ফরাসী, ডাচ, ওলন্দাজরা। সর্বশেষ হায়ানার থাবা মেলে এসেছিলো ইংরেজরা। ইংরেজরা আমাদের শোষণ করেছে প্রায় দুইশত বছর।

সুলতান,পাঠান, মোঘলেরা সম্পদের লোভে এসে পরে পছন্দ করে এ দেশেই থেকে যায়। কিন্তু সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রা বিশেষ করে ইংরেজরা আমাদের দেশের মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো, ঘৃণা করতো। তারা মনে করতো যত সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়া যায়। বাংলাদেশসহ পাকভারত উপমহাদেশ বাসীর দুর্ভাগ্য যে, এ দেশে আসার আগে ইউরোপীয়রা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। ফ্রেঞ্চ ইংল্যান্ডের শতবর্ষী ব্যাপি যুদ্ধসহ তারা আর ও নানা রকম যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। ১৫৫৭ সাল হতে ১৫৫৮ সাল পর্যন্ত দুই বছর ব্যাপি   এ্যাংলো- ফ্রেঞ্চ যুদ্ধ চলে। সে যুদ্ধে ফ্রান্স জয়লাভ করে। যুদ্ধে উভয় দেশ অর্থনৈতিক ভাবে বিপুল পরিমানে ক্ষয় ক্ষতি সম্মুখিন হয়। ওই ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য এবং বাঁচার তাগিদে দুইটি এলাকাসহ ইউরোপীয়রা সারা বিশ্বে ব্যবসা বানিজ্য করার উদ্দেশ্যে  ছড়িয়ে পড়ে। তাদের‌ই একটি অংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পাক ভারত উপমহাদেশের দিকে ধাবিত হয়। আবার সে সময়ে ইংল্যান্ডের প্রধান প্রতিপক্ষ ফ্রান্স অগ্ৰসর হয় প্রধানত আফ্রিকা  অভিমুখে। ব্যবসার নামে ফ্রান্সরা আফ্রিকাকে লুটেপুটে তছনচ করে ফেলে যার  বিবরণ ইতিহাস পাঠে জানতে পাওয়া যায়। এর পর ও উভয় অপশক্তির দৃষ্টি ছিলো সমগ্ৰ বিশ্বের উপর। প্রথমত ভারতের সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলো ফরাসী, ডাচ,পর্তুগিজ ও ইঃরেজরা। তাদের মধ্যে অনেক যদ্ধ ও সংগঠিত হয়েছিলো।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পাকভারত উপমহাদেশে তখন যতগুলো এলাকা বা রাষ্ট্র ছিলো তার মধ্যে বেনিয়াদের বিশেষ কুদৃষ্টি ছিলো আমাদের বাংলার প্রতি। কারণ, তখন বাংলা ছিলো অনেক সমৃদ্ধশালী।  মোঘল আমলে একটি সময়ে ভারতের কিছু কিছু জায়গায় ইংরেজদের ব্যবসাবাণিজ্য শুরু হলে ও তারা বাংলায় আসতে পারে নি। বাংলার ধন সম্পদের কথা শুনে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তৎ সময়ে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে হাজির হয়ে ইংরেজরা বাংলায় ব্যবসার অনুমতি চেয়েছিলো।কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর সে অনুমতি দেননি। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে  অনুমতি আদায়ে তারা সমর্থ হয়। ক্রমান্ধয়ে  নানা কৌশলে দৃশ্যপট পাল্টিয়ে ফেলতে থাকে। নবাবী আমলে ইংরেজদের এক চেটিয়া ব্যবসার নামে কূটকৌশল নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝে ফেলেন, তাঁর ভালো লাগতো না। নবাব নানাভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেন। এ কারণে নবাবের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিদের সাথে তারা হাত মিলায়। কিছু কিছু জায়গায় মার খেলে ও সর্বশেষ ১৭৫৭ সালে দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় পলাশীর আম্রকানের যুদ্ধে নবাব সিরাজ পরাজিত এবং নিহত হন। ইংরেজরা জয়ী হয়ে পুতুল নবাব বানিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সম্পদ পাচার করতে থাকে ইংল্যান্ডে।


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত