হে শিক্ষক, আমাদের ক্ষমা করুন
প্রকাশ: ২ জুলাই ২০২২, ১০:০৬ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩১
মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা বর্তমানে কতটা অসহায় তা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শিক্ষককে অপমান, অপদস্থ, গায়ে হাত তোলার মতো ধৃষ্টতা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এ সমাজে যত ধরনের পেশা আছে তার মধ্যে তুলনামূলক সম্মানজনক, আদর্শপরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পেশা হলো শিক্ষকতা। শিক্ষক ও শিক্ষকতার প্রতি আঘাত আসলে যদি এ সমাজ চুপ করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে অসততা, মিথ্যা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, হীন স্বার্থ, লোভ-লালসা, ক্ষমতার দম্ভ সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে কেন তারই শিক্ষার্থীর হাতে মরতে হবে? নড়াইলের সদর উপজলোর মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে কেন গলায় জুতার মালা পরতে হবে? মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্র করে ভুল বোঝাবুঝির জেরে শিক্ষককে কেন জেলে যেতে হবে? রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকাকে কেন ক্লাসে হেনস্তা হতে হবে? কেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দপ্তরির হাতে মার খেতে হবে?
‘শিক্ষক’ সে তো সবার উপরে। পিতামাতার পরেই শিক্ষকের স্থান। ‘শিক্ষক’ শব্দটার সাথে শ্রদ্ধায় মাথা নত হওয়া, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, ন্যায়নিষ্ঠ, সততার নিদর্শন, আদর্শপরায়ণ, সম্মানজনক ব্যক্তিকেই বোঝায়। অনেককেই দেখেছি শুধু সম্মানের জন্য অন্যসব লোভনীয় চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় আসতে। কখনো কী চিন্তা করে দেখেছি একজন শিক্ষককে যখন জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয় তখন সেই শিক্ষকের মনের অবস্থা কেমন হয়? চরম অপমানিত হলে আর কী অবশিষ্ট থাকে একজন শিক্ষকের জন্য! অন্য দেশের তুলনায় বেতন কম পেয়েও একজন শিক্ষক শুধু সম্মানটুকু পেয়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছে। সেই সম্মানটুকু নিয়ে যদি টানাটানি করা হয় তাহলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ হারাবে মেধাবীরা। কেন জানি মনে হয় শিক্ষক হলো সবচেয়ে ভদ্র, বিনয়ী ও নিরীহ প্রাণী! ঠিক এ কারণেই সহজেই তাকে আঘাত করা যায়, সহজেই অপমান করা যায়!
কেন জানি মনে হয়, পাঠ্যবইয়ের পড়ার সাথে বাস্তব জীবনের মিল কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল দিয়েও এ সমাজে পার পাওয়া যায়। বাজারে কারসাজি করে, সিন্ডিকেট করে নিজের স্বার্থ হাসিল করা যায়। ট্রাফিক আইন অমান্য করলেও জরিমানা হয় না! ক্ষমতার জোরে চাঁদাবাজি করেও অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। সামান্য বেতনে চাকরি করেও আজ অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক। শুধু দালালি করেও অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত! টাকা পাচার, ঘুষ-দুর্নীতি করে বিদেশে সেকেন্ড হোম করলে সমাজে সস্তা সম্মান পাওয়া যায়। অনিয়ম-চুরি করলেও ‘বড় ভাই- মামার’ জোরে পার পাওয়া যায়! চারপাশের সস্তা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কিশোর গ্যাং-এর নামে দম্ভ করা যায়। শুধু বস্তুগত উন্নয়ন করলে হবে না, নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি দরকার। মন-মানসিকতায় উন্নতি না হলে সে জাতির ভিত্তি দৃঢ় হয় না। মিথ্যাকে মিথ্যা আর সত্যকে সত্য বলতে হবে। শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি ব্যস্ত, অসহিষ্ণু ও ধৈর্যহীন। বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অনুশাসনের দিকটা কিছুটা হলেও কমে গেছে! অনেককে মজা করে বলতে শুনেছি- শিক্ষকের কাছ থেকে লাঠি নিয়ে এখন তা দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে! সমাজে চলছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। এখন শিক্ষার্থীরা যন্ত্রের সাথে সময় কাটাচ্ছে বেশি। মোবাইলটাই যেন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে!
একটা সময় ছিল, শিক্ষককে মানা হতো সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। শিক্ষককে দেখলে শিক্ষার্থীর মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেত, ক্লাসের বাইরে শিক্ষক চলার পথে পড়লে শিক্ষার্থী শ্রদ্ধার ভয়ে পালানোর চেষ্টা করতো। কোথায় গেল সে সম্মান? যে বা যারা শিক্ষককে অপমান করছেন তারা এর আগেও ছোটখাটো অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে, তা না হলে শিক্ষককে অপমান করতে তারা সাহস পেত না। যথার্থ আইনের শাসন থাকলে অপরাধীরা অপরাধ করতে সাহস পায় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে স্নেহ-শ্রদ্ধার, আন্তরিকতার ও বন্ধুত্বের। শিক্ষক সমাজকে একর পর এক অপমান জাতির জন্য অশনিসংকেত। শিক্ষক সমাজকে অপমান ও হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হোক।
লেখকঃ শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা)
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত