হেমন্তের রাজদরবারে শীতরাজের আগমণ বার্তা
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১১:৪৭ | আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩৫
শাশ্বত স্বপন
-------------
হেমন্তকাল, কার্তিকের প্রায় শেষ। 'হে সখি, হামারি দুখের নাহি ওর। এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূণ্য মন্দির মোর।।'--এ সময়ে সাধারনত আষাঢ়-শ্রাবণ অথবা ভাদ্র মাসের মত বৃষ্টি হবার কথা নয়, কারো মন মন্দির রিক্ত থাকার কথা নয়। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ। প্রাণিদের মাঝে সখা-সখিদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকে আকাশ-বাতাস-প্রান্তর। কারো কারো উঠোনে হয়তো প্রথম হেমন্তের ফসল উঠেও গেছে। অথচ গত দুই-তিন দিন ধরে রয়ে-সয়ে যেন, মানুষের মনে শীতের আগমন স্মরণ করিয়ে দিতে, প্রকৃতির ভালোবাসার বা নিরবতার মাঝে, শীতল ছোঁয়ায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, মাঝে মাঝে মুসলধারে।
রাজ-রাজাদের আমলে, রাজা যখন রাজদরবারে প্রবেশ করতেন, তার আগমনের আগে গেটের প্রহরী চুঙ্গা ফুঁকিয়ে ঘোষণা দিতেন, শাহানশাহ আল-সুলতান আল-‘আজম ওয়াল খাক্বান আল-মুকাররাম, মালিক-উল-সালতানাত, আলা হযরত আবুল-মুজাফফার শাহাব উদ-দীন মুহাম্মাদ শাহজাহান, সাহিব-ই-কিরান-ই-সানী, বাদশাহ গাজী জিল্লুল্লাহ, ফিরদাউস-আশিয়ানী, শাহানশাহ-ই-সালতানাত উল হিন্দিয়া ওয়াল মুঘলিয়া এখন রাজদরবারে প্রবেশ করিবেন, সবাই হুসিয়ার--।এ সময় রাজদরবারের ভিতরে ও বাহিরে স্ব স্ব পদ মর্যাদা, অবস্থান অনুযায়ী সবাই যেমন প্রস্ততি নিতে থাকে; ঠিক তেমনি করে হেমন্তের প্রথম হলুদ রংয়ের ফসল আঙিনার মেটে রংয়ের সাথে মিশে শীতের বাওয়াইয়া সুরে যেন, আগমনী গান গেয়ে চলেছে। যেন, আকাশ-বাতাস, নদ-নদী-খাল-বিল, দিন-রাতের প্রাণি তথা প্রকৃতিকে জানিয়ে দিচ্ছে, শীত রাজ বা শীত দেবীর আগমণ বার্তা। রাজনৈতিকভাবে বলতে পারি, অসময়ে শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম হুসিয়ার বার্তা !
প্রকৃতি এখন আর নিয়ম মেনে চলে না, চলতে চায় না। আমরা গাছপালা উজার করে, ফসলি জমি ধ্বংশ করে তথা প্রকৃতি উজার করে ঘর-বাড়ি, শিল্প কারখানা গড়ে চলেছি, প্রকৃতির তাপমাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে চলেছি, ফলে প্রকৃতি তার নিয়ম মানতে পারছে না।
গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে আকাশে, গাছে গাছে পাখিদের আনা-গোনা দেখা যায় না। প্রকৃতির পাখিগুলো গাছের ডালে ডালে নিজেদের বাসায় চুপচাপ বসে আছে। বাড়ির পাশের বড়ই গাছের পরজীবী স্বর্ণলতা বৃষ্টির স্পর্শে লাল আভায় চকচক করছে। অসময়ে জলে ভরা ডোবায় ব্যাঙ ডেকে চলেছে অবিরাম। ভিজা বনের শ্যাওলা পথে সাপ ব্যাঙ মুখে নিয়ে চলেছে কোন গুহা পথে। রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকারা বৃষ্টির জলে ভিজে চুপচাপ হয়ে আছে; মাঝে মাঝে দু’একটা পোকা রয়ে রয়ে ডাকছে। শ্মশান, গোরস্থান, বন-জঙ্গল, মেঠোপথ কোথাও হাঁটু বা কোথাও গিঁড়া জলে ভিজে আছে। শিয়ালগুলো পাকা রাস্তার অন্ধকারে গোঁড়াডুবা ডোলকলমীর ঝোপে বিপদাপন্ন সুরে ডেকে চলেছে। সেই সাথে রাস্তার কুকুরগুলিও শিয়ালের সাথে অবিরাম ডেকে চলেছে। গায়ের গৃহিনীরা এ পরিবেশকে অসনিসংকেত মনে করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছে। আগাম রোপা আলুর বীজ পঁচে গেছে। কৃষক মাথায় হাত রেখে প্রকৃতির পানে চেয়ে আছে, মিনতি করছে আর যেন বৃষ্টি না হয়।
ষড়ঋতুর কীর্তন করতে গিয়ে প্রকৃতির মত আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বাও নিয়ম মেনে গায়নি। শরতের কীর্তন গাইতে গিয়ে শরতের সাথে গেয়েছে বর্ষা ও হেমন্তের পুঁথি গান, বর্ষার কীর্তন গাইতে বর্ষার সাথে গেয়েছে গ্রীষ্ম ও শরতের পুঁথি গান, ঠিক তেমনি করে আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বা হেমন্তের কীর্তনেও গেয়ে চলেছে বর্ষা, শরৎ ও শীতের পুথিঁ গান।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস ও তাদের আবহাওয়া বার্তাও নিয়ম মেনে চলে না। আজ তাদের আবহাওয়া বার্তায় বলেছে, মুসলধারার বৃষ্টি কার্তিক মাসের আরো কয়েকদিন হবে। তারপর প্রকৃতিতে শীতের আগমন শুরু হবে। আজ কার্তিকের ২৯ তারিখ। শীঘ্রই ঝরা পাতার গান শুরু হবে। ভরা কার্তিক আর মরা কার্তিক না হয় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল, অগ্রহায়নের কি হবে, সে তো এখনও আসেইনি। প্রকৃতির এ অবস্থা হলে সম্রাট আকবর অগ্রহায়নকে বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দিতেন না।
প্রকৃতির সাথে সমসুরে গীত গাইতে গিয়ে বৈশাখ মাস সুবিধাজনক হওযায় হয়তো পরবর্তীতে এ বৈশাখ মাসকেই বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দেওয়া হয়েছে আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ একটি গান দিয়েই এ মাসকে করেছেন বিশ্বনন্দিত।
প্রকৃতির এ বিরূপ কর্মকে কার্তিক দেবতাও সামাল দিতে পারছে না। সদ্য চলে যাওয়া মাসের বিদায় আর নতুন মাসের আগমণকে গ্রহণ করতে পহেলা অগ্রহায়ণ বিকাল বা সন্ধ্যায় গৃহিণীরা লেপ-চাদর মুড়ি দিয়ে হয়তো আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় বুড়ার পূজা উৎসব করবে। হাজার বছর ধরে হেমন্তকালে হেমন্তলক্ষী আর কার্তিকের কৃপায় ফসলে ফসলে মানুষের ভাগ্যলক্ষী দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যায়। ফসলের ডগার শিশির বিন্দু দিনের প্রথম আলোয় চিকচিক করে উঠে; যেন দিনকে জানিয়ে দেয় সুজলা-সুফলা-শষ্য শ্যামলার আগাম বার্তা। সনাতন জাতি, উপজাতির মাঝে 'ক্ষেত্তের বত্ত' বা খেত ফসলের দেব-দেবতার পূজা শুরু হয়। হলুদ রংয়ের খড়-নাড়ার বিছানায় মাঠে মাঠে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। দেশ বা দশের কোন কল্যাণ না হলেও হাজার হাজার বছর ধরে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, মাজার মানত, পূজা-পার্বন, বুদ্ধ বন্দনা, খ্রীস্ট বন্দনা চলছে, চলবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত