হেমন্তঃ উৎসব ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৪২ |  আপডেট  : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:০৫

শাশ্বত স্বপন
---------------------

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত  অদ্ভূত এক ঋতু। শরৎ শেষে প্রকৃতি কিছুটা মলিন হতে থাকে। আগাম পড়তে শুরু করে শীতের হিম কুয়াশা, মাঝে মাঝে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হালকা ছাই রঙ কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় সকাল ও সন্ধ্যার সুনীল আকাশ। ফসলহীন মাঠ যেন, পরিত্যক্ত জনপদ। এর উল্টো পিঠও আছে। কৃষকের ঘর জুড়ে আনন্দের বন্যা। মাঠশূন্য করা ফসলে তার গোলা ভরেছে, মিটেছে অভাব। দিকে দিকে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। শুধুই কি নবান্ন! সেই সুদীর্ঘকাল থেকে হেমন্তে আরও কত উৎসব উৎযাপন হয়ে আসছে ।

ভাইফোঁটা হেমন্তের একটি পারিবারিক বন্ধনের উৎসব। দেশ বা দেশের গন্ডি পেরিয়ে এর আরো নাম আছেÑভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসব, ভাইদুজ উৎসব, ভাইটিকা উৎসব। নেপালে ও ভারতের দার্জিলিং-এ দূর্গাপূজার পরে এটাই সবচেয়ে বড় উৎসব। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি, কালীপূজার দুই দিন পরেই এই মজার উৎসব হত।
মা-মাসী-দিদিমা-ঠাকুমার কাছ থেকে শুনি, এই দিন মৃত্যুও দেবতা যম তাঁর বোন যমুনার হাতে ফোঁটা দিয়েছিলেন। আবার এরকমও শুনি, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার  কপালে ফোঁটা দিয়ে দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে নাকি ভাইফোঁটা উৎসব প্রচলিত হয়।
এই দিন বোনেরা উপোস করে। বড় বোন ধান-দূর্বা ছোট ভাইয়ের মাথায় রেখে আশির্বাদ করে, এ সময় কেউ শঙ্খ বাঁজায়, কেউ উলু ধ্বনি দেয়। তারপর বোন ভাইয়ের কপালে মন্ত্র পড়ে চন্দনের ফোঁটা দেয়।
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দূয়ারে পড়ল কাঁটা,
 যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, 
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।।
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে 
যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে
 আমার ভাই হোক অমর।।
এই মন্ত্র পড়ে বড় বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘ জীবন কামনা করে। ছোট ভাইয়েরা বোনকে প্রণাম করে। ভাই বড় হলে বোন প্রণাম করে। বোন ভাইকে মিষ্টি মুখ করায়। তারপর বড় জন ছোট জনকে সাধ্যমত উপহার দেয়। আমাদের সময়ে আমরা বড় বোনের কাছ থেকে টাকাই পেতাম। আজকাল আমাদের গ্রাম এলাকায় ঘটা করে খুব বেশি প্রচলন নেই। বড়দের মাঝে এটা খুব বেশি হয় না। ছোট ছোট বাচ্চা যে ঘরে আছে, সেখানে এ উৎসব এখনও ছোট পরিসরে প্রচলন আছে। কবে যে এই ভাই ফোঁটা উৎসব শুরু হয়েছে--তা কেউ বলতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এটা আর্যদের আচার অনুষ্ঠান। 

ভাই ফোঁটা অনুষ্ঠানের দিন দীপাবলী উৎসব শেষ হয়। পাঁচ দিন ব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব হলেও, জানা যায়, জৈন-শিখরা এই সময়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান পালন করে। হিন্দুরা ঘরে দরজায়, ঘরে চারদিকে ছোট ছোট মাটির প্রদীপ জ্বালায়, মোমবাতিও জ্বালায়। আলো দিয়ে পুরো বাড়ি সাজায়। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক। হিন্দুদের বিশ্বাস, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্ণী আসে। 

হিন্দু বাড়িতে কার্তিক  মাসের শুরুতে তুলসী গাছের বেদীতে সারা মাস সন্ধ্যা থেকে জ্বালিয়ে রাখা হয় মাটির প্রদীপ। আবার কোন কোন হিন্দু বাড়িতে দেখতাম, ঘরের সাথে বাঁশ বেঁধে, বাঁশের মাথায় মাসব্যাপী আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপ ঝুলিয়ে রাখা হত, ভোরে বা সকালে প্রদীপ নিভে যেত, আবার সন্ধ্যা বেলায় গাছ প্রদীপ ঘরের কোনে বেঁধে রাখা হত। আকাশ প্রদীপ এর ক্ষেত্রে বাঁশের আগায় ছোট ঘর বানিয়ে সেখানে মাটির তৈরী মুছিতে সরিসার তেল ঢেলে  পরিত্যক্ত, পরিষ্কার সাদা কাপড় বা পাট দিয়ে বানানো সলতার সাথে সরিষা মেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাঁশটিকে ঘরের ছাদ ছাড়িয়ে আকাশে  প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত খাঁড়া করে রাখা হয়। ভূত-প্রেত, অশুভ ছায়া তথা অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপের পূজা করা হয়। আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না। 

কার্তিক মাসকে হিন্দুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসাবে গণ্য করা হয়। কার্তিকের মাসের প্রতি সোমবার ব্রত পালন করে সোমেশ্বর দেবতাকে (শিব) আরাধনা করলে পাপ মুক্ত হয়।

 আর্যরা এই অঙ্গ,বঙ্গ, কলিঙ্গ, সমতট, রাঢ় দখল করার পর আর্য-অনার্য মিশ্রণের ফলে লোকায়ত পূজা-অর্চণা এবং সাংস্কৃতিক ধারায়ও মিশ্রণ ঘটে। আদিকাল থেকেই অনুকূল আবহাওয়া এবং নানা রকমের শস্য উৎপাদনের মাসগুলোতেই বাঙ্গালীর নানা আনন্দ উৎসব হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসেই সবচেয়ে বেশী ফসল উৎপাদন হয়, মানুষের মন থাকে উৎফুল্ল, ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে যায়। আর তাই হয়তো সম্রাট আকবর এই মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় থেকেই নবান্ন উৎসব প্রচলিত। হেমন্তের ধান কাটার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠেয় অন্ন খাওয়ার উৎসবই হল নবান্ন --যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন মেলা, উৎসবে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠি খেলা, বাউল গান, নাগর দোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

আমার  গ্রাম্য বেলার জীবনে আমি দেখেছি হেমন্তের ফসল আঁকা মেঠো পথ ধরে কত আনন্দ উৎসবের ধারা বয়ে যেত। মেঠো পথে পথে বাঁশুরিয়ার সুরের তানে বাতাস-ফসলের নৃত্যে জীবন খুঁজে পায় প্রকৃতি প্রদত্ত জীবনের স্বাদ। কার্তিকে শুরু হত নতুন ফসল উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। কার্তিক মাসে  লক্ষীপূজা, কালীপূজা, কার্তিক পূজা, বুড়া-বুড়ীর পূজা, সন্তোসী মায়ের পুজা দিয়ে মাস শেষ হতেই অগ্রহায়ণের প্রতি রবিবার হতে শুরু হত ক্ষেতের বত্ত। শনিবার সন্ধ্যায় থাকত শনিপুজা, তারপর ভাই ফোঁটা উৎসব, গোবাচ্চার জন্য গোরক্ষনাথের পূজা--সারা মাসই দেব-দেবতাকে খুশী করতে নতুন নতুন শস্যের নানা উপাদেয় খাবার তৈরী হত। 

যদিও সরকারী পঞ্জিকা আর সনাতন পঞ্জিকার দিন তারিখ এক রকম হয় না। কোথাও কোথাও সরকারী পঞ্জিকা অনুযায়ী, কোথাও সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী উৎসব হয়। তিথি-নক্ষত্রের শুভক্ষণ অনুযায়ী পূজার দিন স্থির করা হয়। তাই সরকারী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দেখা যায়, আশ্মিনের দূর্গাপূজা হয় কার্তিকে, কার্তিকের কার্তিক পূজা হয় অগ্রহায়ণে। আসলে তিথি-নক্ষত্র, লোকনাথ পঞ্জিকা অনুযায়ী, সনাতন হিন্দুরা দূর্গা পূজার ঘট (মহালয়া) আশ্বিনেই বেদীতে বসায়, কার্তিক পূজার ঘট কার্তিক মাসেই বেদীতে বসায়।  ব্রাক্ষণ বালকদের মস্তক মুন্ডু করে, কানে ছুঁচ ফুটো করে হেমন্ত-অগ্রহায়ণ মাসেই উপনয়ন বেশী হত। উপনয়নের পর থেকে বালকরা  ব্রাক্ষণ হতেন।

লক্ষীদেবী প্রতিটি হিন্দু ঘরেই প্রতিদিন স্নান শেষে পূজিত হয়। বৃহস্পতিবার পবিত্র হযে লক্ষীর পাঁচালী পাঠ করে পূজা করা হয়। দূর্গা পূজার পর আশ্বনি মাসের শেষ  পূর্নিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষী  পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজার প্রকৃষ্ট সময় হল প্রদোষ কাল, সূযাস্ত থেকে দু’ঘন্টা সময় পর্যন্ত। কোন কোন পরিবারে পূজোয় মোট চৌদ্দটি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণের কোন জিনিস, ধান, পান, কড়ি, হলুদ,  হরিতকী, নানান ফলাদী ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয় পূজার স্থানটিকে, সামনে দেবীর মুর্তি বা সরা বা ঘট বসানো থাকে। অনেক বাড়িতে এ পূজার ভোগে জোড়া ইলিশ রাখা হয়। ইলিশের ভরা মৌসুম থাকায় সেটাও লক্ষীর অবদান হিসাবেই ধরা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুরী, লাবড়া অনেকেই রাখে। তবে  ফলমূল, নাড়িকেলের নাড়, তিলের নাড়ু, মোয়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক থাকে। অনেক বাড়িতে মাছের পাঁচ পদের রান্না হয়। কৃষিজ উপকরণ দেখে বুঝা যায়, ফসলের সাথে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।  লক্ষ্ণীর নানা রূপ আছে, বিভিন্ন সময়ে সে সব রূপের পূজা হয়। স্থান-কাল-জাত-বর্ণ ভেদে পূজার ভিন্নতাও আছে।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজার পর  সনাতন হিন্দুদের কাছে কালীপূজা দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসব। কালীদেবীর মূর্তি পানিতে ডুবায় না। সারা বছর মন্দির প্রাঙ্গনে রাখে, নিয়মিত পূজিত হয়। নতুন মূর্তি আসলে পুরাতন মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে রাত্রিব্যাপী এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সারারাত সবাই আনন্দ করে। 

ক্ষেতের বত্ত এক এক অঞ্চলের এক এক জাতি গোত্রের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। অগ্রহায়ণ মাসের  প্রতি রবিবার সন্ধার পর নতুন চাল দিয়ে ছোট ছোট পিঠা (লবণযুক্ত ও লবণছাড়া), ধান-দূর্বা, তুলসীপত্র, কর্পূর, চাল-কলার নৈবেদ্য, ধূপ-ধূয়া দিয়ে উঠোনে পুজা হত। উঠোনের মাঝখানের্  আয়তাকার পুকুর আকৃতির  ছোট্ট গর্ত করা হত। ক্ষেতের দেবতার কিচ্ছা শুনানো হত। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা উঠানে ছোট্ট পুকুরের চারপাশে বসে মা, কাকীমা, ঠাকুমার মুখে কিচ্ছা শুনত। পিনপতন নিরবতার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারা গল্পের রাজ্যে ঘুমিয়ে যেত। আমাদেরকে বলা হত, খুব ভোরে উঠে যে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া পিঠা খাবে, বিশেষ করে প্রথমে যে লবণযুক্ত পিঠা খেতে পারবে, সৌভাগ্যবান হিসাবে দেবতা তার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হবে। তার গোলা ফসলে ভরে যাবে, তার ঘরে ভাল গৃহস্ত, লক্ষ্ণী বউ আসবে। খেতের দেবতাকে খুশী রাখতে অনার্য নৃগোষ্ঠি সেই কবে ক্ষেতের বত্ত শুরু করেছিল, আজও তার মিথস্রোত বয়ে চলেছে এই মিশ্র জাতির মধ্যে।

বাস্তুপূজা শীতকালে হলেও কোথাও কোথাও পুরোহিতের পরামর্শ নিয়ে, বিশেষ করে বাস্তুপূজা, আমাদের বিক্রমপুর এলাকায় কার্তিক-অগ্রহায়ণেও  হত, আবার কোথাও কোথাও ঘর বানানোর জন্য মূর্তি ছাড়া ছোট পরিসরে ঘটপূজা সারা বছরই হয়। বিল থেকে হিজল গাছের কচি ডাল এনে, যেখানে ঘর তৈরী হবে সেখানে মাটির তৈরী বেদীর উপর পুঁতে দেওয়া হত। এটিই বাস্তুদেবীর  প্রতীক। চাল, গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরী পায়েস পুরোহিতের সাহায্যে কলাপাতায় এমনভাবে ঢেলে হিজল গাছের ডালের কাছে রেখে দেওয়া হতÑযাতে পায়েস গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, মাটিতে শোষিত হলেই ধরা হত দেবতা ভোগ গ্রহণ করেছেন। এবার ঘর তৈরীতে বাঁধা নেই। পুরোহিত থেকে আমরা জেনেছি, এই পূজা না করে ঘর বানালে, সংসারে অশান্তি হবে, ঘর কালবৈখাখী ঝড়ে  গৃহস্তের উপর ভেঙ্গে পড়বে। গ্রামের গৃহস্থরা, বিশেষ করে, গৃহিনীরা এসব সংস্কার মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।

এই সময়ে গ্রামে গ্রামে রাতের বেলা ‘ফকিরের ভাড়ে বসা’ গল্প খুব শুনা যেত। একটা গল্প এরকমঃ হঠাৎ কোন এক সন্ধ্যা রাতে বা মধ্য রাতে কোন  বাড়িতে চিৎকার। হারিকেন বা টচলাইট নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যেত অদ্ভুত পোষাকে, ভংগিকে মধ্য বয়সী এক দাঁড়িওয়ালা লোক অনবরত মাথা ঘুরিয়ে, হাত দু’টি মাটিতে চাপরাচ্ছে। আর কি সব বলছে। আবুল ফকির নামে নামে  তিনি পরিচিত। এই ফকির মানুষের যে কোন সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে, যে কোন অসুক, খারাপ বাতাস লাগা, ভুত-পেত্নির আছড়, বিবাহ বা বাচ্চা না হওয়া ইত্যাদি। কেউ হয়তো তার সাগরেদকে বলছে, কি করলে তার মেয়ের অসুখ ভাল হবে?  সাগরেদ ফকির বাবাকে তাদের নিজস্ব ভাষায় সমস্যার কথা বলছে। ফকির ক্লান্ত মুখে, অদ্ভুত ভংগীতে বলে, পাঁচ টাকা আট আনা মাজারে দিতে হবে। পাঁচ সের চাল আর পাঁশ সিকে পাঁচ জন ভিক্ষুককে দিতে হবে এবং পাঁচ পুকুরের পানি একটি বোতলে মিশিয়ে আবুল দরবেশকে দিতে হবে। বোতলে ফুঁ দিয়ে সেই পড়া পানি মেয়েকে খাওয়াতে হবে। আবুল দরবেশ সেই। সবাই বলে, আবুল ফকির একজন দিব্য পুরুষ। এই মিথগল্প এখনও গ্রামে গ্রামে প্রচলিত। 

গাভীর বাচ্চার বয়স একুশ দিন হলে গাভীর দুধ দিয়ে নাড়ু তৈরী করে গোরক্ষনাথ দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ দিয়ে সবাই সমস্বরে বলত, গোরখার নাড়ু, হেউচ্চ...। পূজার পর থেকে  গৃহস্তরা গাভীর দুধ খেত। এই পূজা করলে গাভী প্রচুর দুধ দেবে, প্রতি বছর সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দেবে। এই পূজার দিবস নানা গোত্রের সনাতন গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চা জন্মের ৭/১৪/২১/২৮ দিনের মধ্যে রাখেনি, নিয়মের পরিবর্তন এমন হয়েছে যে, সামান্য নিয়মাদি পালন করে প্রথম দিন থেকেই গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চার সাথে নিজেরাও দুধ খেত। হেমন্তকালের কার্তিক-অগ্রহায়ণে অথবা নিজেদের ভাল সময়ে গোরক্ষনাথ পূজার অনুষ্ঠান করত। মুসলমানরা গোরক্ষনাথের শিরনি নামে লোকাচার পালন করত। বাছুরের বয়স এক মাস হলে গরুর দুধ  জ্বাল দিয়ে ঘন করে গরু বা বাছুরের মূর্তি বা নাড়ু বানিয়ে কলাপাতায় করে গরুর ঘরে রাখত, যাতে গোরক্ষনাথ রাতে খায়।  বাউল বা বয়াতিরা পাটালি পড়ত, বাচ্চারা হেইচ্চ বলে দোহার করত। পরিবর্তনের যুগে এই পূজা বা লোকাচার এখন বিলুপ্তির পথে।

আশ্বিনে রান্দে কার্তিকে খায়, এটাকে বলে গাড়ু উৎসব। এ উৎসবটা ঘরের বড় বোন, বড় ভাবী, ছোট খালা বা মাসীরাই আয়োজন করত। তের/একুশ  বেজোড় সংখ্যার চাল-ডাল-শাপলার ডগা-ঢেঁপর-কাচাকলা-পেঁপে-শাক তথা নানান তরকারী মিলিয়ে আশ্বিন মাসের শেষ দিন রাতে রান্না হত। মোমবাতি বা কুপির আলোক শিখার উপরে কলাপাতা রেখে দেওয়া হত। সকালে কলা পাতায় যে কালী পড়ত তা ছোটদের কপালে দিয়ে বলত, কারো খারাপ দৃষ্টি যেন না পড়ে। আমাদের বাড়িতে ২১ পদের কথা মনে আছে এবং এখনও একই নিয়মে প্রচলন আছে। আশ্বিন মাসের শেষ রাতে হিন্দু মেয়েরা উপবাস করে রান্না শুরু করে, কার্তিক মাসের সকালে কার্তিক দেবতাকে ভোগ দিয়ে পূজা সেরে পান্তা খিঁচুরী খায়। কার্তিক দেবতার কাছে কামনা করে ফসল যেন ভালো হয়। মিথ আছে, অবিবাহিত মেয়েরা কার্তিকের মত বরও চায়,  ছড়ায় আছে, ‘আশ্বিনে রাঁধে বাড়ে কার্তিকে যে খায়, যে যেই বর মাগে সে সেই বর পায়’। কার্তিক দেবতার মত বীর যোদ্ধা, সুন্দর অবয়বের বর পাবার আশায় কার্তিক মাসের শেষ দিন সনাতন নারীরা কার্তিক পূজার আয়োজন করে। নতুন বিবাহিত অনেক নারীর নতুন বর দেখলে আমরা মিথজাত বিশ্বাস থেকে বলে উঠি, মেয়েটি কার্তিকের মত বর পেয়েছে। এ উৎসব হিন্দুজাত হলেও কবে, কখন ধর্মীয় গন্ডি পেরিয়ে নিজ¯^ ধাঁচের লোকজ উৎসবে পরিণত হয়েছে আমরা কেউ তা জানি না। 

হেমন্ত-শীতকালে বিয়ের উৎসব বেশী হত। অনুকূল প্রকৃতি, ফসল, সময় --সব কিছু মিলিয়ে মনে করা হত, প্রজাপতি দেবতা এই সময়টাকে বেশি পছন্দ করেন।  মানুষের বিশ্বাস, এই সময়ে বিয়ে হলে সংসার সুখের হবে। 

 দুর্গাপূজা, লক্ষ্ণী পূজা, কার্তিক পূজা, কালীপূজা, দীপাবলী পূজা, অমাবস্যার ১ম বা ২য় তিথিতে মুখের দুই পাশে দুই রংয়ের অবয়বে হরিপরমেশ্বর পূজা, পূর্ণিমাতে রাধা কৃঞ্চের জন্য কীর্তন সহকারে রাসলীলা পূজা, বনের অধিবাসীর জন্য বনদেবীর পূজা--নানা পূজা-অর্চণার মাধ্যমে বিপদ-আপদ-মঙ্গল কামনায় শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে যোগ হয় নানান পাগলের মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস, ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোলা। মুসলমানরা প্রথম ফসল দিয়ে মাজার, দরগায় শিন্নি দেয়; কেউবা কোন কিছু পাবার আশায়, কারো রোগ মুক্তি কিংবা মঙ্গল কামনায় পীর-মুর্শীদ বা পাগল বাবার জন্য প্রথম ফসল মানত করে রাখে। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভাগ্যলক্ষ্ণী কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট শস্য শ্যামলায় ভরে দেয়। আর তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে অসীম রহস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে তোলে নিজেদের মতো করে, পরিবর্তনও করে নিজেদের সুবিধা মতো।

হেমন্তের নবান্নের সময় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন-মানসিকতায়ও পরিবর্তন আসে। ধানের হরিদ্রা রঙের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেয়ে ও বধূরা হলুদ শাড়ি সায়াহ্নের রক্তিম সূর্যের কিরণে যেন, পায়ের আলতা রঙ শাড়ির পাড়ে উঠে আসে; সেই সাথে ছেলেরাও যেন অঘ্রাণের পাকা হলুদ ধানের আভা ধারণ করে তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবিতে। তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবির নকশায় আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। এ সময় গ্রামবাংলার পাড়া-মহল্লায় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। পাকা ধান কিবা নানান শস্যের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কন্যাকে পিতা পাত্রস্থ করেন। বিয়ে বাড়িতে বিয়ের গীত আর আলতা-মেহেদীতে রাঙানোর আসর বসে। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, এ সময়ে বিবাহ নাকি নতুন সংসারে সুখ ও শান্তি বয়ে আনে।

প্রকৃতির সবুজ ফসল হরিদ্রাভ সাজে নতুনের জাগরণ ঘোষণা করে। শরতের গিঁড়া জল সরে গিয়ে মাঠ-ঘাট ভরে ওঠে সোঁদামাটির গন্ধে। সূর্যের রক্তিম আভা নদীর শান্ত জল আর ভোরের ফসলের কচি ডগায় জমে থাকা শিশিরে পড়ে ঝিকমিক করে, মধুমাখা শীতল বাতাস অঙ্গজুড়ে হিল্লোলিত হয়। ঘরে ঘরে নতুন ধানের চালে শুরু হয় উৎসব। ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চালের গুড়ি কোটা, চিড়া কোটার শব্দ উঠতÑএখন যা অজপাড়া  গ্রাম ছাড়া চোখে পড়ে না।

হেমন্তের ‘নাইওর’ উৎসবে নতুন ধানের চালের গুড়ি আর গুড় দিয়ে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তৈরী হয় নানা রকমের পিঠা, পায়েস। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান, ভাপা, চিতই, পাটি সাপটা, নকসা , পাতা, জামাই, কাটা, চুটকি, মুঠা, চ্যাপা, জামদানী, হাঁড়ি, ঝুড়ি, ফুলঝুরি, বিবিখানা, মাছ, হৃদয়, গোলাপ ফুল, পেঁচানো, ফুল, শাহী বিবিখানা ইত্যাদি আরো অসংখ্য নামের পিঠা। মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠা শিল্পের পরিশ্রম সার্থক হয়। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে  প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে। এসব পিঠা নিয়েও গ্রাম বাংলায় আছে নানা রকমের মুখরোচক মিথ। অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য সনাতন হিন্দুরা দেবতা সূর্যকে, কোথাও গরু দেবতাকে আগে পিঠা দিয়ে, মেয়ের জামাইকে দেবতা রুপে কলাপাতায় বা বেতের থালাতে পিঠা পরিবেশন করত। বউ-জামাইয়ের আলাদা থালার সাথে পাড়ার সবাই একসাথে পিঠা খেতে বসত। তবে সনাতন হিন্দু  মতে, আগে জামাইয়ের খাওয়া শেষ হবে, তারপর ঘরের বউঝিরা খেতে বসবে। অতিথিকে দেবতাতুল্য জ্ঞানে সেবা করা সনাতন ধর্মের নিয়ম, বিশ্বাস। 

নাগরিক সভ্যতার জাঁতাকলে আবহমান কালের সংস্কৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একান্নবর্তী পরিবার প্রথায় মানুষের বন্ধন এক সময় দৃঢ় ছিল। উৎসব মুখর সমাজে সবাইকে সবার প্রয়োজন হত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিল সহজ-সরল। ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে সম্পর্ক ছিল আত্মার বন্ধনে। আজ, এখন সে সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অন্য ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, সনাতন হিন্দু জাতিদের অনেকেই জানে না হাজার বছরের শক্ত বন্ধনের এই ছোট ছোট উৎসবের কথাÑযা মিথ হোক আর গল্প-কাহিনী হোক, মানুষের শাশ্বত প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাকে বিনা সূতার মালায় হাজার হাজার বছর ধরে বেঁধে রেখেছিল--যা এখন শিথিল হয়ে হিংসা-বিদ্বেষের রূপ ধারণ করেছে।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত