স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সমাজসেবক রণদা প্রসাদ সাহা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৩৩ |  আপডেট  : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১২

রণদা প্রসাদ সাহা (১৫ নভেম্বর ১৮৯৬ - ৭ মে ১৯৭১) বাংলাদেশের প্রখ্যাত সমাজসেবক, জমিদার ও দানবীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আর. পি. সাহা নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে হাসপাতাল, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গরীবদের কল্যাণার্থে ট্রাস্ট গঠন করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন। পরবর্তীকালে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। সমাজসেবায় অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান রণদা। সেখানে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে মুটের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স করে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় যান। সেখানে তিনি হাসপাতালে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের জীবন বাঁচালে তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রদান করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ সালে পঞ্চম জর্জের সাথে সাক্ষাতের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড সফর করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগে টিকেট কালেক্টরের চাকরি নেন। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি। উপার্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। চার বছরে ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এ সময়ে দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি নামে নৌ-পরিবহন সংস্থা এবং নৌ-পরিবহন বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২ - ১৯৪৩ সালে সরকারের খাদ্য-শস্য ক্রয়ের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন এবং জর্জ এন্ডারসনের কাছ থেকে 'জুট প্রেসিং বিজনেস' এবং 'গোডাউন ফর জুট স্টোরিং' ক্রয় করে নেন। এরপরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস ক্রয় করেন। চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন এই সময়।

কয়লা, চামড়া, পাটের ব্যবসায় নিজ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ধনকুবেরে পরিণত হন রণদা। পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ও মানবতার কল্যাণে প্রচুর অর্থ দান করতে থাকেন তিনি। রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৩৮ সালে মির্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট 'কুমুদিনী ডিস্পেনসারি' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে সেটিই কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৪২ সালে তার প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে 'ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ' স্থাপন করে ঐ অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযোগ করে দেন যা পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমস-এ রূপলাভ করে। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে রণদাপ্রসাদ তার সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরীবদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করার জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল নামে অলাভজনক প্রাইভেট কোম্পানী রেজিস্টার্ড করেন। মীর্জাপুরে ডিগ্রী মহিলা কলেজ কুমুদিনী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৩-৪৪ সালে সংঘটিত পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় রেডক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিন লক্ষ টাকা দান করেন[১] এবং ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারাদেশে দুইশত পঞ্চাশটি লঙ্গরখানা খোলা রাখেন। এছাড়াও তিনি টাঙ্গাইলে এস. কে. হাইস্কুল ভবন নির্মাণ এবং ঢাকার সমন্বিত সামরিক হাসপাতাল সিএমএইচ-এর প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রণদাপ্রসাদ সাহাকে রায় বাহাদুর খেতাব প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার মরণোত্তর প্রদান করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকহানাদার বাহিনী রণদা ও তার ২৬ বছর বয়সী সন্তান ভবানীপ্রসাদ সাহা -কে তুলে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর তারা বাড়ী ফিরে আসলেও পুনরায় ৭ মে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। ঐ সময় তিনি তার স্ত্রী কিরণবালা দেবী, পুত্রবধূ শ্রীমতি সাহা ২০০৫ সালে রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত ও পৌত্র রাজীবকে রেখে যান।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত