সেলাই জননী ও দরজি কন্যা - ১

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২১, ১০:৪২ |  আপডেট  : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৪৫

ঝর্না রহমান
 -------------------

 
জননী পর্ব

 

আম্মা দাঁত দিয়ে আটকে রেখেছেন একটা সুঁই। সুঁইয়ের চাপ লেগে নিচের ঠোঁটের মাঝখানে চিকন একটা ভাঁজ পড়েছে। সুঁইয়ের কিছুটা চিকিমিকি সেই ভাঁজের ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুঁই থেকে ঝুলছে সুতো। আম্মার হাতে এক টুকরো রঙিন কাপড়। সেটা দিয়ে বাচ্চার নিমা হচ্ছে, অথবা ছোট কাঁথা, ল্যাঙট কিংবা লোলদানি। জিনিসটাকে ঠিকঠাক করে নিয়ে আবার ফোঁড় তুলছেন। কখনো শুধু সুই দাঁতের ফাঁকে আটকে রেখে আম্মা কাটিম থেকে সুতো খুলছেন। ঠোঁট থেকে সুঁই খুলে দাঁত দিয়ে কুট করে কেটে নিলেন সুতো। সুতোর মাথায় থুতু লাগিয়ে দু আঙুলে ডলে আগাটা সূক্ষ্ম করে নিয়ে জানালার দিকে একটু ঘুরে পুট করে ঢুকিয়ে দিলেন সুচের ফুটোতে। তারপর কেমন জাদুকরের মতো বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে একটা প্যাঁচ খেলা খেলেন আম্মা! বাহ, সুতোর শেষ মাথায় একটা গিঁট পড়ে গেছে! আবার হাতে তুলে নিলেন কাপড়ের টুকরো। আম্মার পায়ের দোলনায় শোয়ানো আমার তিন নম্বর ছোট বোন মিনু। আমার চেয়ে চার সাড়ে চার বছরের ছোট। বোনের বয়স চার কি পাঁচ মাস। ঘুমুচ্ছে। মনে হচ্ছে আম্মা বুঝি জামা সেলাই করার আগে একটা পুতুল সেলাই করে পায়ের ওপর রেখে দিয়েছেন। ফুটফুটে মুখ, কপালের একপাশে আঙুলের মাথায় কাজল লাগিয়ে একটা ফোঁটা দিয়ে দিয়েছেন আম্মা। বোন একটু নড়ে উঠলেই আম্মা পা দোলাচ্ছেন। পাশাপাশি চলছে সেলাই। পাশের ছোট্ট জানালা দিয়ে পড়ন্ত দুপুরের রোদ্দুর তেরছা হয়ে পড়েছে চৌকির ওপরে। চৌকির ওপরে পাটি। চকচকে পাটির ওপর সর্ষের তেলের মত পিছলে গেছে পেতল রঙের রোদ। আমি জানালার একপাশে বসে পেতলরঙা রোদের আলোয় আম্মার সেলাই দেখছি। এ হল আমার স্মৃতিতে সেলাইরত আম্মার সবচেয়ে পেছনের, ১৯৬৪ সনের কোনো এক মগ্ন দুপুরের ছবি।


 
 আম্মা ছিলেন সূচিকর্মে দারুণ নিপুণ। ছোটবেলায় গল্প শুনেছি, বিয়ের আগে নাকি পাত্রী হিসেবে আম্মার দুটি গুণের কথা গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল, এক হল তাঁর হাতের লেখা আর এক তাঁর সেলাই। ট্রাঙ্কে তোলা ছিল আম্মার অনেক সূচিকর্ম। রঙিন সুতোয় নানা রকম স্টিচের ফুল, পাখি, লতা, তাজমহল, জগ, হংসলতা, আর নানারকম বাণী লেখা বান্ধাইল, টেবিলক্লথ, বালিশের কভার, বিছানার চাদর, রুমাল, কুরুশ কাঁটায় বোনা সরপোশ ছাপনি, গ্লাস ঢাকনি, পুঁতি দিয়ে বোনা খোঁপা ছাপনি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে এসব বের করে আমরা দেখতাম। বিশেষ করে আমি। অবাক লাগতো! কী সূক্ষ্ম সেলাই! ভরাট স্টিচের সেলাইয়ে হাত বুলোলে মনে হত কাপড় কেটে বসানো হয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেলাইগুলো দেখতাম। ডিজাইনগুলো পেনসিল দিয়ে খাতায় এঁকে রাখতাম। আম্মা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, কত শখ করে এসব সেলাই করেছি। কবে যে এসব বান্ধানো হবে! ট্রাঙ্কে থাকতে থাকতে সুতার রঙ নষ্ট হয়ে গেল! তবে বিয়ের পরে আর আম্মার শৌখিন সূচিকর্ম করার সময় হয়নি।
 
 
একের পর এক সন্তানের মা হয়েছেন আর তাঁর হাতে লাইন ধরে চলে এসেছে নানারকম জামাকাপড় আর কাঁথা সেলাইয়ের কাজ। আমার শৈশব জুড়ে আম্মাকে আমি অসংখ্য সেলাই করতে দেখেছি। আমাদের জামা, প্যান্ট, শেমিজ, পাজামা, আম্মার নিজের সায়া-ব্লাউজ, আমাদের ভাইবোনদের বাচ্চাকালের নিমা-জাঙ্গিয়া-কাঁথা-ল্যাঙট সব আম্মা হাতে বানাতেন। সেলাই মেশিন ছিল না আম্মার। খালি হাতে সেলাই করতেন। পায়ের নিচে কাপড় আটকে হাঁটুতে থুতনি গুঁজে আম্মা হেম বক্কা অথবা কাঁথা স্টিচ দিতেন। কাপড়ে বর্ডারের দাগ ফেলার জন্য দু আঙুলে অদ্ভুত কৌশলে চিকন ভাঁজের ওপর কুচি ফেলে চেপে নিয়ে ছেড়ে দিতেন। বেশিরভাগ সেলাই করতেন রাত জেগে। দিনে সংসারের হাজার কাজ করে সময় পেতেন না, রাতে সব কাজ সেরে হারিকেনের আলোয় আম্মা সেলাই নিয়ে বসতেন। তখন আম্মাকে মনে হত গল্পের বইয়ের কোনো ছবি। শুধু ছবিটা সচল। টিনের বেড়ার ওপর বড় হয়ে ছায়া পড়তো। একটা ঠাণ্ডা ছায়া হাত নাড়তে নাড়তে সারা দেয়ালে সেলাই বুনে যেত। ওইসব দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে উঠে হয়তো দেখতাম, টেবিলের ওপরে রাখা আছে সেলাই শেষ হয়ে-যাওয়া কোনো জামা। সেটা গায়ে পরিয়ে আম্মা ফিটিং দেখতেন। কোথাও মিসফিট হলে আবার চলতো সেটাকে মেরামত। পুরোপুরি ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত আম্মার মন ভরতো না।
 
 
শীতকালে আমরা আম্মার বোনা নানা ডিজাইনের সোয়েটার আর মাফলার পরেছি। আম্মা বলতেন টাই। টাইয়ের দুই মাথা পানপাতার মত। গোড়াতে একটা জিপার। একটা পান জিপারের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে টেনে দিলে গলার নিচে ক্রস হয়ে বসে থাকতো দুটো পানপাতা। সুন্দর লাগতো দেখতে। নানারকম ডিজাইনের জামা বানাতেন আম্মা আমাদের জন্য। আমরা পিঠেপিঠি চার বোন ছিলাম। আম্মার সেলাই-জীবনটা চলছিল চার মেয়ের জামা বানাতে বানাতেই। অনেক ছোটবেলায় দেখেছি, এক একটা ডিজাইনের জন্য আম্মা কত উদগ্রীব থাকতেন। একবার রুমাল-ছাঁট জামা শেখার জন্য আম্মা গজ কাপড় কিনে আমাকে নিয়ে এক প্রতিবেশির বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রতিবেশি খালাম্মা সংসারের এ কাজ সে কাজ করে আম্মাকে সময় দিতে প্রায় ঘণ্টাখানেক পার করে দিলেন। আম্মা বসে থেকে থেকে বহুবার কাপড়টার ভাঁজ খুললেন আবার ভাঁজ করলেন। আমার মনে হচ্ছিল, আম্মার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, খুব লজ্জা হচ্ছে। আবার উঠতেও পারছেন না। খুব খারাপ লাগছিল আম্মার জন্য। 
 
সেলাইয়ে অসাধারণ মেধা ছিল আম্মার। একবার আয়না বসানো কাপড়ের ফুলতোলা পাখা শেখার শখ হল। এক টুকরো কাপড়ের মাঝখানে দু পাশে দুটি গোল আয়না বসিয়ে চারপাশে ফুলের পাপড়ি তুলতে হবে। একটা বিশেষ টেকনিক আছে সেটার। যার কাছে পাখাটি প্রথম দেখেছিলেন আম্মা সেই প্রতিবেশিকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলেন তাঁকে শিখিয়ে দেবার জন্য। তিনি দিচ্ছি দেব করেও আর আম্মাকে সেলাইটা শেখালেন না। আম্মার খুব রাগ হল। বললেন, বুঝেছি, শেখালে তার কম পড়ে যাবে। কাপড় সুতো আয়না ইত্যাদি নিয়ে কয়েকদিন চেষ্টা করে আম্মা নিজেই সেই পদ্ধতিটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। সেই পাখা শেষ করে আম্মার আনন্দ হয়েছিল দ্বিগুণ। 
 
আম্মার সব সেলাইয়ের নিবিড় দর্শক ছিলাম আমি। কীভাবে সুঁচে সুতো লাগান, কীভাবে ফোঁড় তোলেন, চোখের পলক না ফেলে দেখতাম। একবার ফ্যাশন এলো ফ্রকের কোমরে পুরোটা ঘিরে চওড়া ভাঁজের বেল্ট লাগানো আর সেই বেল্টের সামনে মাঝখানের জায়গাটায় মেশিন দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানারকম নকশা তুলে সেলাই করা। আমাদের সেলাই মেশিন নেই। দরজির কাছে জামা বানানোর চিন্তাও করা হয় না। আম্মা সেলাই জানেন, সেখান কেন দরজিকে টাকা দিয়ে জামা বানানো হবে? এত বড়লোক তো আমরা নই! আমি আম্মাকে বললাম, বেল্টের মাঝাখানে নকশা করে দিতে। আম্মা সেবার এমন মিহি সেলাই করে সেই নকশা তুললেন, দেখে তাক লেগে গিয়েছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না এটা মেশিনে সেলাই নয়। কীভাবে হল? আম্মা আমাকে পাশে বসিয়ে দেখালেন, সুঁইয়ে কত ছোট করে সমান দূরত্বে ফোঁড় দিয়ে বক্কা সেলাই দিলে এমন মেশিনের সেলাইয়ের মত দেখায়।

একবার ঈদে আমাদের শখ হলো ‘চিকেন’ বলে একরকম নেটের কাপড় দিয়ে জামা বানানোর। নানারকম ফুটো ফুটো ডিজাইনের চিকেন কাপড় তখন একটা ক্রেজ। চিকেন কাপড়ের নিচে এক প্রস্থ লাইনিং দিয়ে বানানো জামা তখন আমাদের চোখে স্বপ্নের রাজকুমারীদের জামা। আব্বা বড় চাকুরে ছিলেন না, কিন্তু আমাদের কোনো শখ অপূর্ণ রাখতেন না। তো আব্বা নিয়ে এলেন কাপড়। আমরা খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিলাম। কিন্তু কাপড় দেখে আমার মাথায় হাত। আব্বা চিকেন কাপড় এনেছেন ঠিকই। তার রঙ বিকেলের ঘুমঘুম আকাশের মত কোমল নীল। মুরগির ছানার মত নরম মসৃণ কাপড়। কিন্তু তার লাইনিংয়ের কাপড় এনেছেন কটকটে কমলা রঙের। কাপড়ও খসখসে শক্ত। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। নীল চিকেনের লাইনিংও তো হতে হবে নীল! আব্বা কাঁচুমাচু মুখে বলেন, একরকম রঙের কিনতে হয় তা তো জানতাম না! আমি তো ভাবছি নিচে একটা কাপড় দিলেই হয়। কী হবে এখন? ঈদের দেরি নেই। জলদি বানাতে হবে জামা। আর চার বোনের চারটা জামা! বানাতেও সময় লাগবে। স্বপ্নের রাজকুমারী জামার এই বিসদৃশ রঙ বিভ্রাটে আমার মন দমে গেল। তখন আম্মা এলেন উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে। বললেন, তোর আব্বা তো ঠিকই করেছে। সবাই তো রঙ মিলিয়ে নিচের কাপড়টা দেয়, তাতে কি চিকেন কাপড়টা আর বোঝা যায়? বরং নীল কাপড়ের ফুটোগুলো দিয়ে একটু একটু কমলা রঙ বেরিয়ে থাকবে তাতে আরও সুন্দর লাগবে। সেবার সত্যিই অপূর্ব সুন্দর জামা হয়েছিল আমাদের। নীলের ভেতর থেকে কমলার আভা উঁকি দেয়া সেই রহস্যময় রোমাঞ্চভরা জামার সৌন্দর্য আজও ভুলতে পারিনি।
  
আম্মার সেলাই শুধু নতুন কাপড়ইে নয়, পুরোনো যত মেরামতে আম্মার ধৈর্য ছিল অসীম। ছোটবেলায় দেখতাম, এতটুকু অবসর পেলেও আম্মা বসতেন এটা সেটা মেরামত করতে, ছেঁড়া ফাটা জামাকাপড় এটাসেটা রিপু করা, জোড়া দেয়া, তালি মারা চলতেই থাকতো। সহজে কোনো কাপড়ের জিনিসকে বাতিল করতেন না। ব্লাউজের ডান হাতা আগে ছিঁড়ে যেত। সেখানে আর এক ব্লাউজের হাতা এনে জুড়ে দিতেন। বলতেন ঘরেই তো থাকবো, কে দেখবে! আম্মার মৃত্যুর পরে এখনও সংরক্ষণ করে রেখেছি তাঁর জায়নামাজ, বছরের পর বছর নামাজ পড়তে পড়তে দাঁড়ানোর জায়গা ছিঁড়ে গিয়েছিল, পরে সেখানটাতে আব্বার ছেঁড়া প্যান্টের কাপড় কেটে তালি লাগিয়ে নিয়েছিলেন। ছোটবেলায় শুনতাম আম্মা জামাকাপড় ছাঁটতে শিখেছেন বঁটি দিয়ে। শৈশবে মাকে হারিয়ে ছিলেন আম্মা। নানা ছিলেন অন্ধ। শিশু বয়স থেকে সংসার সামলাতেন আম্মা। তাঁকে কে কিনে দেবে কাঁচি আর সেলাইয়ের সরঞ্জাম! বিয়ের পরে আম্মার কাঁচি হয়েছিল তবে সেলাই মেশিন হয়নি। সেটা হয়েছিল আমি যখন সেলাই শিখেছি তখন। 

(চলবে)

ঝর্না রহমান

                                                          

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত