সাত দিনেও চালু হয়নি বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৭ | আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:৩৬
সাত দিনেও চালু করা যায়নি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে আছে। ফলে পার্বতীপুর উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলার বাসিন্দারা বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ও লো-ভোল্টেজের কবলে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। যা থেকে সর্বশেষ উৎপাদন হচ্ছিল মাত্র ৫০ থেকে ৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বাকি ইউনিট চালু হতে আরও সময় লাগবে।
গত রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ১২৫ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট এবং এর আগে ১৬ অক্টোবর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে তৃতীয় ইউনিটে গর্ভনর ভালভ স্টিম সেন্সরের চারটি টারবাইন নষ্ট হয়। এসব কারণে কেন্দ্রটির ২৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের সংস্কারকাজ ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলমান। ফলে তখন থেকে এই ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর সম্ভাব্য সময় জানালেও কবে নাগাদ চালু হতে পারে কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট তা এখনও নির্দিষ্ট করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এই ইউনিট বন্ধের ১০ দিন পার হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইউনিট বন্ধের পাঁচ বছর হয়ে গেলেও সেটি চালুর ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন করে চালু করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল এখন একটি ইউনিট (দ্বিতীয় ইউনিট) মেরামত করতেই তার চেয়ে বেশি অর্থ চাচ্ছে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
২০০৬ সালে পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বড়পুকুরিয়া এলাকায় কয়লাভিত্তিক এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। প্রথমে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট ছিল। যার প্রতিটির উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১২৫ মেগাওয়াট করে। ২০১৭ সালে ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন আরও একটি ইউনিট চালু করা হয়। ফলে কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়ায় ৫২৫ মেগাওয়াটে।
৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র বলা হলেও কখনও ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে অধিকাংশ সময় কোনো না কোনো ইউনিট বন্ধ রাখা হতো। সর্বশেষ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় ইউনিট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেলেও এখনও সেটি চালু করা যায়নি। বাকি দুটি ইউনিটের মধ্যে কখনও প্রথমটি আবার কখনও তৃতীয়টি বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় তৃতীয় ও ১৯ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় প্রথম ইউনিট। ফলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রথমটি থেকে ৫০-৫৫ মেগাওয়াট এবং তৃতীয়টি থেকে ১৬০-১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। যা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতো। পাশাপাশি এই অঞ্চলের ভোল্টেজ ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও উত্তরাঞ্চলে চাহিদা পূরণে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, অন্যদিকে সরবরাহে ঘাটতি। এতে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষজন। জাতীয় গ্রিড থেকেও মিলছে না চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ। জাতীয় গ্রিড থেকে কমিয়ে দেওয়া হয় দিনাজপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ত্রুটি দেখা দিলে প্রভাব পড়ে পার্বতীপুরে। বিশেষ করে পার্বতীপুর উপজেলার পল্লীবিদ্যুতের ৮০ হাজার গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়ছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে বেড়েছে ভ্যাপসা গরম। ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পুড়ছে অঞ্চলটি। এই গরমে সেখানে বেড়েছে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। সকাল, ভোর কিংবা গভীর রাতে চলে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট দেখা দিয়েছে উত্তরের জেলাগুলোতে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের মাত্রা বেড়েছে। প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ নির্ভর কল-কারখানায়। এটি অব্যাহত থাকলে কৃষি উৎপাদন নিয়েও আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, আসছে শীত মৌসুমে বিভিন্ন সবজি চাষে এবং বোরোর চাষাবাদে সেচের পানির প্রয়োজন হবে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক না হলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে। বাড়বে উৎপাদন খরচ। সেইসঙ্গে বাড়বে শাকসবজির দামও। এর প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়ও।
চালকল মালিকরা বলছেন, বিদ্যুতের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবং চাহিদা মাফিক সরবরাহ না করলে দিনাজপুরে যেসব চালকল আছে, সেগুলোর উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। চাল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটলে ব্যবসায়ীরা ধান কেনায় আগ্রহ হারাবেন। ফলে কৃষক কাঙ্ক্ষিত দাম পাবেন না।
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এবং বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে পাঁচ বছর ধরে। বাকি দুটি এই চালু এই বন্ধ থাকে। এটি আসলে মেনে নেওয়ার মতো নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে এই এলাকার কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য। কৃষির মধ্যে চালকলগুলোও আছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে চালকলগুলোতে প্রভাব পড়বে, বোরোতে প্রভাব পড়বে। তাই দ্রুতই সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া দুটি ইউনিট এবং পাঁচ বছর ধরে বন্ধ থাকা ইউনিটটি চালু করা প্রয়োজন।’
উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘সকাল, ভোর কিংবা গভীর রাত; যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। আবার দীর্ঘ সময় পর আসে। এ অবস্থায় সুস্থ থাকাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে আমাদের।’
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া ২৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪০-১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো জাতীয় গ্রিডে। ইউনিটটি চালু রাখতে দৈনিক এক হাজার ৬০০ টন কয়লা লাগে। ১২৫ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট থেকে প্রতিদিন ৪০-৫০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। ইউনিটটি চালু রাখতে দৈনিক ৭০০-৮০০ টন কয়লা ব্যবহার করা হতো। ১২৫ মেগাওয়াটের দ্বিতীয় ইউনিটে প্রতিদিন ৬০-৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। এখানে ব্যবহৃত হতো ৮০০-৯০০ টন কয়লা। ২০২০ সাল থেকে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটি সংস্কারের জন্য ওভার হোলিংয়ে আছে। কেন্দ্রটির তিনটি ইউনিট চালু রেখে স্বাভাবিক উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ টন কয়লার প্রয়োজন পড়ে। তবে এ পর্যন্ত তিনটি ইউনিট একসঙ্গে কখনও চালাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সরবরাহ করা কয়লার ওপর নির্ভর করে চলে ৫২৫ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কোল ইয়ার্ডে কয়লা মজুত রয়েছে চার লাখ ৬০ হাজার টন। এদিকে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) পার্বতীপুর কার্যালয় জানিয়েছে, পার্বতীপুর শহরে বিদ্যুতের চাহিদা ছয় থেকে সাত মেগাওয়াট। কিন্তু বরাদ্দ মিলছে তিন থেকে চার মেগাওয়াট। শহরে নেসকোর আওতাধীন প্রায় ২০ হাজার গ্রাহক আছেন। পার্বতীপুর শহরে নেসকোর বিদ্যুতের চাহিদা বর্তমানে সাত মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ তিন মেগাওয়াট। বাকিটা ঘাটতি থাকছে।
এ ব্যাপারে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক, ‘প্রথম ইউনিটটি চালু করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এটি চালু করতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। কিন্তু তৃতীয় ইউনিট চালু করতে আরও বেশি সময় লাগবে। কারণ তৃতীয়টি চালু করতে অনেক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। না হলে মেশিন ভেঙে যাবে। আমরা কেন্দ্র প্রস্তুতকারী চীনা প্রতিষ্ঠান হারবিন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ইউনিটটি এখনও গরম আছে, সেটি ঠান্ডা হলে তারা এসে মেরামত শুরু করবেন।’
২০২০ সাল থেকে বন্ধ থাকা দ্বিতীয় ইউনিট চালুর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সেটি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ইউনিটটি ২০২০ সাল থেকে বন্ধ। দীর্ঘদিন চালু না থাকায় আরও যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে এখন আরও বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ২৩ মিলিয়ন ডলার চাচ্ছে। আগে তো দুটি ইউনিট করতে ২২ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছিল। এখন শুধুমাত্র একটি ইউনিট মেরামতেই ২৩ মিলিয়ন চাওয়া হচ্ছে। দুটো ইউনিটের যা দাম, এখন শুধুমাত্র একটা ইউনিট মেরামত করতেই খরচ চাচ্ছে তারা।’
এর আগে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ২২ ফেব্রুয়ারি উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এরপর ২১ জুলাই সকালে আবার তৃতীয় ইউনিট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় প্রথম ইউনিটও। ফলেও ওই দিনও পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চার ঘণ্টা পর প্রথম ইউনিট চালু করা গেলেও তৃতীয়টি বন্ধ ছিল ১০ দিন। গত ৩০ জুলাই তৃতীয় ইউনিট চালু করা হলেও পরদিন প্রথমটি বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে বারবার বন্ধ ও চালুর মধ্যে থাকলেও এটিকে যান্ত্রিক ত্রুটি হিসেবেই দেখছে তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। প্রতিবারে বন্ধ হলে যোগাযোগ করা হয় ইউনিট প্রস্তুতকারী কোম্পানি হারবিন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে। এরপর মেরামত করে চালু করা হয়।
সৌজন্যে ঃ বাংলা ট্রিবিউন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত