১৯৫২ সালের সময়ের উপর ভিত্তি করে দুই পর্বের ধারবাহিক গল্প

সময়ের লাশ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:১০ |  আপডেট  : ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৫

শাশ্বত স্বপন 
--------------


স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে অনন্তের পথে ছুটে চলা স্মৃতিগুলো প্রত্যেক মানুষের জীবনে জোনাকীর মত জ্বলে আর নিভে। সময়ের লাশ--গল্পে বৃদ্ধ বয়সে নায়িকা, তার নায়কের সাথে প্রেমের কাহিনী এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভুমির কিয়দংশ উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে বর্ণনা করেছেন। এখানে নায়ক ৫২ সালের সময়ের ধারক, নায়িকা মাতৃভূমির ধারক অর্থাৎ গল্পটি যেন, ৫২ এর সময়ের সাথে লাজুক মাতৃভূমির ভালোবাসার লুকোচুরি-মিছিল-আন্দোলন-যুদ্ধ-মৃত্যুর খেলা। 

পর্ব-২

দু’জনেই চলে গেল। বাবা অবশ্য আদর করে বলেছিল, ‘এগুলো কিছু না, মা। কালই আমি সুমাদকে নিয়ে আসব।’ স্বপ্নের কথা বললেও চিঠির কথা গোপন রেখেছিলাম। আবার ঘুমিয়ে ভাবতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম--আমি কে?--না, আমি দিলীপ দাসের মেয়ে কল্যাণী। আমার বয়স চৌদ্দ। বাবা-মা আমার জন্য বর দেখছে। আমি শিক্ষিতা, সুন্দরী (সবাই বলে)--আমার হবু স্বামী নিশ্চয়ই খুব সচ্ছল হবে। তবে সুমাদ একি বলছে, আমি একটা মানচিত্র! রাত তিনটা বাজে। আমি আবার চিঠি পড়তে শুরু করলাম। ‘তোমার সারা দেহের লোমে লোমে ছড়িয়ে আছে আ- ই- ক- ম...। ওরা তোমাকে দলিত মথিত করে তোমার লোমগুলি একটি একটি করে তুলে নকল উর্দু অক্ষরযুক্ত লোম লাগিয়ে দেবে। তুমি অপসংস্কৃতি আর পরাধীনতার শৃংখলে আটকে যাবে। তোমার ভাষা হবে দেহের সাথে সম্পর্কহীন। তোমার কথা এত মধুর শুনাবে না। বুঝতে পারনি? পাকিস্তানীরা তোমার ভাষা কেড়ে নেবে। ভয় নেই, আমি তো আছি। আমি এসিড হয়ে ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদন করবো লবন ও পানি। লবণ দিয়ে দেশের জোঁকগুলোকে মারব। আর পানি দিয়ে তোমার বুকের উত্তপ্ত মরুভূমি ভরে দেব--পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতে--এঁকে দেব তোমার ঠিকানা। অবাক হচ্ছো। বার তারিখে বিকাল তিনটায় আমাদের সমাবেশ হবে তোমাদের ঐ পশ্চিমের মাঠে। তুমি জানালা দিয়ে দেখ এবং সবার বক্তৃতা শুনিও। তুমি তথা তোমরা কোথায়, কেমন আছ, সব বুঝবে। এবার রাখি। কষ্ট দিলাম। দিদি, এর চেয়েও ভয়ংকর কষ্ট সম্মুখে তোমাদের...বিদায়।

বার তারিখে সমাবেশ হল। সব শুনলাম, বুঝলাম, আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি? যে ভাষায় আমরা কথা বলি--যে ভাষা রক্তের সাথে আছে মিশে--সে ভাষা পাকিস্তানীরা কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করবে সমুদ্রে আর তার পরিবর্তে পাকিস্তানীদের উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। তার মানে আমাদের দেহের রক্ত পরিবর্তন করে ওদের রক্ত আমাদের দেহে ভরে দেবে। মিটিং এর শেষটা অত্যন্ত লজ্জাস্কর পরিস্তিতিতে শেষ হল। তখন সুমাদ বক্তব্য রাখছে--‘মাতৃভাষাকে কেড়ে নেওয়া মানে আমার মাকে তথা আমাদের মাকে কেড়ে নেওয়া। আজ আমাদের যুদ্ধের যাবার সময়--আজ আমাদের মিছিলে যাবার সময়। আমরা যুদ্ধে যাব--আমরা মিছিলে যাব। মাননীয় অধ্যাপক সাহেব, সম্মানিত...ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। আমরা স্বাধীনতা চাই...।’ হঠাৎ কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠি চার্জ সেদিন সমস্ত মিটিং পন্ড করে দিল। ছত্রভঙ্গ হলো সবাই।

যাই হোক, আরেকদিন দাদুর কাছে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি সেই আগের মত ইটের নিচে চিঠি রেখে চলে গেল। সেদিন আর ভয় পেলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চিঠিটা উঠালাম। পা দিয়ে ইট সরাতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। সুমাদ দৌঁড়ে এল, ‘--দেখি দেখি।’ পায়ের আঙ্গুল আলতো ভাবে ছুঁইয়ে দিল। গোড়ালী থেকে নখ পর্যন্ত ম্যাসাস করতে লাগল। ‘-- ব্যথা কমেছে?’ আমার কি যে ভালো লাগলো। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পায়ে চুমু দিতেই আমি দৌঁড়ে চলে এলাম। পথে দু’একজন ছোকরা দেখেছে । বাড়ী ফিরে ড্রইং রুমে আসলাম। বাবা-মা-রাম তিন জনেই রামকৃষ্ণ মিশনে গেছে। অতএব, চিঠিটা খুলতে শুরু করলাম। পুরো চিঠিতে প্রকৃতির আবছা চিত্র। আর চিত্রের উপর দিয়ে নিপূন হাতে লেখা--‘কল্যাণী দি, কেমন আছো? নিশ্চয়ই স্নান সেরেছ? চুলগুলি নুয়ে পড়েছে বিছানায়। কি দেখছ? এ লেখা। তোমার অস্তিত্বের কাল্পনিক মানচিত্র এখানে লুকিয়ে আছে। তুমি ওকে খুঁজে পাবে না কারন তুমি এখনও তোমাকে চিনতে পারনি। চুলের গুচ্ছ থেকে দু’এক ফোঁটা জল ফেলে দেখ, কাগজটি কাঁদবে। এ কাগজ আমার শত জনমের না পাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস; হারিয়ে যাওয়া লক্ষ বছরের বেদনাময় স্মৃতির গন্তব্যহীন ঠিকানা। কাগজের প্রান্তগুলো দেখ। বামদিকে সিঁদুরের স্পর্শ দেখেছ? ডানদিকে সবুজ রং? সূক্ষ্ণ কতগুলো সূতা চুল হয়ে ছড়িয়ে আছে। নদীর মত প্রশান্ত জলরেখার দাগ সবুজ আর সিঁদূরের প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। নিচে তাকাও--চঞ্চল, নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী ঝর্ণার নৃত্য শুনতে পাও। ভয় পেয়েছ? পায়ের ঘুঙুর বাঁধানো পদধ্বনি শুনেছ? আবার ভয় পেয়েছ? ভয় নেই, এতো তুমি আর আরেক জন--যে তোমারি মত--ঠিক তোমারি মত। তাই তোমাকে এত ভালবাসি। আমার প্রেমিকার রূপ খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রতীক, একটা সুন্দর ছবি হিসেবে তোমাকে পেয়েছি। আমার সেই প্রেমিকা তোমারি মত। বুঝতে পারনি কিছু? লুকিয়ে রাখ হৃদয়ের গভীরে, স্মৃতির সাগরের হাজার ফুট নিচে। মরুভূমির ছোঁয়া পেলে এ লেখা আবার আসবে--তখন বুঝবে কি এর অর্থ। খারাপ লাগছে? আজ আর নয়, এটুকুই থাক। স্বাধীন হোক, তোমার জীবন।’

সরস্বতী পূজার পরের দিন দাদুর জন্য লুচি, চিড়া, নাড়– আর মোয়া নিয়ে দাদুর কাছে যাচ্ছি। পথে হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কোকিল সুরে একটা ধ্বনি দিল। পাশে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। সুমাদ হাসছে। অথচ ওর কপাল আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ‘--আমাকে সারা রাত বুকের কাছে নিয়ে শুয়েছিল। এখন আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ। আমার চোখের কাছে তার চোখ রেখে বলল, ক্ষুধা পেয়েছে, মিছিল করে আসলাম তো। পথে যেতে দেখি, তুমি আসছ। ভাবলাম টিফিনে নিশ্চয় খাবার আছে। দেবে খেতে? জান, মিছিলে মার খেয়েছি... তারপর হাসপাতালে...।’ আমি টিফিন বাটি ওর হাতে দিয়ে মাথা কাঁত করলাম। টিফিন বাটি খুলেই একটা নাড়– আমার মুখে দিল। আমি মুখে নাড়ুটা নিয়ে মুখটাকে স্থির করে রেখেছি। বাম হাতে একটা লুচি আর ডান হাতে একটা মোয়া, একটা নাড়ু নিল।
--কি গো, খাবার সব অশুদ্ধ হয়ে গেল, তাই না ?
আমি মাথা নাড়লাম।
--বা! তুমি তাহলে তোমাদের সংস্কার নামক কুসংস্কার মান না।
আবার মাথা নাড়লাম।
--এই মেয়ে, কথা বল না কেন? ও মা! মুখে এখনো নাড়ু? কষ্ট দিলাম, যাই আবার দেখা হবে।
আবার পেছন ফিরে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
-- আমি কে জানতে ইচ্ছে করে না?’

কিছু বললাম না। ও চলে গেল। মাথা কতটুকু ফেটেছে, কিভাবে ফাটল কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। কারণ আমি কখনও ওর সাথে কোন কথা বলিনি। বাড়িতেও খুব কম কথা বলি। খুব সুন্দর দেখতে। নাকটা তীরের মত চোখা; বিশাল বুক যেন, মাঠ। বোতাম খোলা শার্টটা যা ময়লা! হোস্টেলে থাকে, কে ধুইয়ে দেবে। টিফিনের বাটি আলগা করে রেখে গেছে। আমি শক্ত করে আঁটকাতে গিয়ে দেখি লাল আর সাদা কি যেন। উপরের বাটিটা উঠালাম। ওমা! রক্ত মাখা কাগজ। দ্রুত বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম। দাদুকে টিফিন বাটিসহ খাবার দিয়ে চলে এলাম বাড়ীতে। বাথরুমে ঢুকলাম।
চিঠিটা খুলে পড়ছি। একি! সারাটা চিঠি রক্ত মাখা। আবছা একটা মানুষের ছবি--হাতে ফেস্টুন--গুলিবিদ্ধ হয়ে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আমার সারাটা শরীর কেঁপে উঠল। পড়তে শুরু করলাম--‘হ্যাঁ, সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমি গর্ভবতী হব। আমার গর্ভ থেকে জন্ম হবে একজন মহাবিদ্রোহীর--যে সারা বিশ্বকে শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে মুঠি মুঠি বিদ্রোহী ভালবাসা উপহার দেবে। বিভক্ত ভারতবর্ষকে আবার একত্র করবে। আতুড়ে ঘরে প্রসূতি যেমন অব্যক্ত যন্ত্রণা, অসহ্য বেদনায় সমস্ত দেহ-মন নিয়ে বিদ্রোহ করে নারী জাতির প্রতি ঘৃনা অথবা ভালবাসা ঢেলে দেয়; মা, মা বলে চিৎকার করে; সাগর যখন সমস্ত জল শুকিয়ে মরুভূমি হবার সীমাহীন বেদনার শেষ গোধূলীর ছায়া আঁকড়ে ধরবে--তেমনি কোন এক সময়ে আমার মৃত্যু হবে বড় নির্মমভাবে--যা দেখে যত ধাই, যত দর্শক আছে, সবাই কাঁদবে, বিলাপ করবে কিন্তু বিশ্ব কাঁপানো ভবিষ্যৎ মহাবিদ্রোহী বেঁচে থাকবে বেদনার উল্টোপিঠে। যতদিন জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হবে, যতদিন অন্যায়-অবিচার, বিশৃংঙ্খলা থাকবে--ততদিন সে আমারি আজ্ঞাবাহী, বিদ্রোহ করে যাবে অনন্তকাল। সে অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। অপেক্ষা করো কল্যাণী, সেই দিনের আশায়। আজকের রক্তের কাছে এই আমার প্রদীপ্ত অঙ্গীকার...।’ পাগল, কি সাব লিখেছে? গর্ভবতী হবে? ও কি নারী নাকি? কিছু বুঝি না। হ্যাঁ, সেদিন কিছু বুঝি নাই। আজ বুঝি, সব বুঝি।


মনে পড়ে, আর একদিনের কথা। সেদিন পুকুরে এক ঘটি জল আনতে গিয়েছিলাম লক্ষ্মী পূজাটা সম্পন্ন করার জন্য। অনেকটা ইচ্ছে করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও স্নান করছে। পায়ের কাপড়টুকু উঠিয়ে যেই ঘটিটা পানিতে ডুবিয়েছি অমনি সে বলতে আরম্ভ করল, আমি যাকে ভালোবাসি তার পা আমি কোনদিন দেখিনি। তার বুকে হেঁটেছি, শুয়েছি। একদিন হয়তো তার কোলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কোন কথা না বলেই সেদিনও চলে এলাম। ঘাটের সিঁড়ির চারটি ধাপ পার হতেই ও আমাকে পানি ছিটিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি সুন্দর, আমার সেই প্রেমিকার মত--ঠিক প্রেমিকার মত!’ কে ওর প্রেমিকা? সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। আরেকদিন কোন এক কথা প্রসঙ্গে বাবাকে বলেছিল, ‘জানেন স্যার, এই বাংলার সবাইকে আমার বড় আপন মনে হয়। আমার তো মা--বাবা কেউ নেই। তাই এ দেশ, এই মাটিই আমার মা-বাবা।’ ওর সাথে কখনও কথা বলিনি। কেন? লজ্জা হয়? না, অন্য কিছু--আমি জানি না। আমাদের ব্যাপারটা মা-বাবা-রাম সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে প্রায়ই মায়ের বকা শুনতে হয়। সুমাদকেও একবার বকা শুনতে হয়েছে। একদিন দূর থেকে ওকে দেখেছিলাম। ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন? সেদিন চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখি সুমাদ আমাকে ছেড়ে দূরে, বহুদূরে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি--সেই স্বপ্ন থেকে আজও কাঁদছি। আমার কান্না বোধ হয়, মৃত্যুতেও শেষ হবে না। মা যে বলেছিল, যবন নাস্তিক ছেলেকে ভালোবেসেছি বলে ভগবান নরকে নিয়ে আমাকে কাঁদাবে। তবুও নরকে গিয়ে যেন, ওর দেখা পাই। কত চিঠি ও আমাকে দিয়েছিল--তা গুনে দেখিনি। যে কয়টা সংরক্ষণে ছিল--তা এই লেখনিতে সাজালাম। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে মাকে সুমাদ বলেছিল, ‘কাকীমা, আমি ও স্যার, আমরা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিকলে বন্ধি নই; আমার সকল ধর্মের উর্ধেŸ।’ মা অবশ্য রেগেছিল। সুমাদ গরু, কাছিম, শুকর, ছাগলের মাংস খেত; সামান্যও ঘৃনা হত না। আমি কোনদিন মাংস খাইনি, আজো খাই না। না খেতে খেতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখ। বিকাল বেলা রামকে নিয়ে ঘাটে গেছি জল আনতে। জল ভরে আমি সিঁড়ির উপর উঠে দেখি কৃষ্ণচুঁড়া গাছের গোড়ায় বসে অশ্রু নয়নে হাত-পা কাটছে। আমি ভয়ে ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে আসতেই সে পথ আটকাল। ‘কল্যাণী, তুমি কি আমাকে ভালবাস না?’ কোন কথা বললাম না। ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সুমাদ হাত কেটে রক্ত দিয়ে আমাকে সাজাতে লাগল। রাম দৌঁড়ে বাসায় চলে গেল। ঘটি পড়ে গেল হাত থেকে। ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম তবুও কোন কথা বললাম না। মনে মনে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল সারা শরীরে। আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে লতা পাতার মাঝে শুয়ে পড়েছিলাম। রক্ত সিঁদুর দিয়ে কপালে টিপ দিল--চুলের সিঁথিতে রেখা একে দিল। আমি ওর বুকে আবেগ ভরা হৃদয়ে খানিকক্ষণ মুখ গুঁজে রইলাম। সেদিন সময়ের কাছে আবেগ আর জীবনের পরাজয় হয়েছিল। মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সুমাদকে বকে গেল। আজ বুঝতে পারছি সেদিন হয়তো আমার গর্ভেই জন্ম দিতে চেয়েছিল বিশ্ব কাঁপানো মহাবিদ্রোহীকে। আজ সব বুঝি, সব...। ২১ তারিখের বিকাল বেলা। একটা ছেলে আমাদের বাসায় এসে দরজায় নক করছে। মা দরজা খুলে দিল।
-- কি চাই ?
--কল্যাণী দিদি আছে ?
-- কেন ? তাকে কেন ?
--এই চিঠিটা তাকে...।
মা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন। সব উল্টা করে লেখা। অতএব, মা কিছুই বুঝলো না। আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেলেন, তোকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেব অজয়ের কাছে। অজয় আমার মেজো মামা। আমি আয়নার সাহায্য নিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম--কল্যাণী, অনেক কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যাচ্ছি। দুঃখ, একটিবার বললে না, আমি তোমায় ভালবাসি। আমি আবার আসব। তোমাদের স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আমি অবতীর্ন হব এ ভারতবর্ষে। বিশ্বাস করো, আমি হিন্দু নই, আমি মুসলমান নই, আমি সকল ধর্মের উর্ধ্বে। আমি তোমাদের এ কুসংস্কার সমাজের কেউ নই। আমার জন্মও কেউ জানে না, মৃত লাশও কেউ পাবে না। আমি সময়--আমি ’৫২--আমি স্মৃতি। তোমাকে বাংলাদেশ ভেবে ভালবেসেছি, অন্য কিছু নয়। সময়ের উজানে এসেছি--সময়ের ভাটায় চলে যাচ্ছি। না, পরাজয় নয় বরং জয় তোমার-আমার। এদেশকে একদিন নারীরাই শাসন করবে, সেবা করবে। আমি হয়তো সময়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখব। তবু থাক না হয়--দু’তীরে দু’টি মন। হে কল্যাণী আমার, ঠিকানা আমার--মুক্ত আকাশ; বিন্দু থেকে সিন্ধু--সিন্ধু থেকে আবার বিন্দু। চিরবিদায়...।’

সন্ধ্যার পর বাবা তার ছাত্র মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসলেন। মাহফুজ ভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তিনি কবিতা, গল্প লিখেন পত্র-পত্রিকায়। আমি সেই বিকাল থেকে কান্নার্ত চোখে শুয়েছিলাম। বিছানা থেকে উঠে দরজায় আসতেই মাহফুজ ভাইয়ের মুখ থেকে ছাত্র হত্যার ঘটনা শুনতে পেলাম। উনি বলতে লাগলেন, আগের দিন থেকেই একটা আশঙ্কা ছিল--আগামীকাল মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে কোন মিছিল হলে সরকার কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্য মিছিলের উপর গুলি বর্ষিত হতে পারে এমন আশঙ্কা আমার মনে ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। সংবাদ অফিসে থাকতেই শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল শুরু হয়েছে, যে কোনো সময় মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আমি শংকিত চিত্তে আবার আজিমপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম, সারা পথেই স্থানে স্থানে মানুষের জটলা। সবাই শংকিত, কি ঘটে না ঘটে। আজিমপুরে পৌঁছেই শুনলাম, মেডিকেল কলেজের মোড়ে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর গুলি করেছে, বহু মানুষ তাতে মারা গেছে। এই খবর শুনে আমিও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে দৌঁড়ে পলাশী ব্যারাকের মোড়ে গেলাম। তখন ভয়ে আমার হাত-পা সিঁধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই শোকাবহ ঘটনার পরই মেডিকেল কলেজের দিকে অসংখ্য মানুষের যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ও আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভবনে মাইক লাগিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও জ্বালাময়ী বক্তিতা শুরু হয়ে গেছে। শোকের গভীর ছায়া ছড়ানোর পাশাপাশি মাইক থেকে সংগ্রামের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে। জালিম মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে প্রচন্ড ঘৃণা ও ধিক্কার। পলাশীর ব্যারাকের মোড়েই জনতার ভীড়ের মধ্যে মোহাম্মদ আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা হল। সে মিছিলে ছিল। গুলি তার গায়ে লাগেনি। তবে ঐ গুলাগুলির পর সুমাদকে আজিজরা কেউ খুঁজে পায়নি। পরে আমি...।”
-- স্যার--
--হ্যাঁ, বল। না থাক, তুমি চা খাও। লক্ষ্মী-
--না স্যার, আমি আসি-
--সুমাদের কোন খবর পেলে-
-- আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব
আমাকে দেখে বাবা মাহফুজ ভাইকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি সব শুনে ফেলেছি। আমার মাথা ঘুরতে লাগল, বিছানা পর্যন্ত না যেতেই পরে গেলাম রামের গায়ের উপর। আমার আর কিছু মনে নেই। সুমাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি জানি, ওকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে, সময়ে আসে, সময়ে হারিয়ে যায় আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু জানি, সুমাদকে আমি খুব ভালবাসতাম কিন্তু বলতে পারিনি। ভালবাসার শিকলে, সময় অথবা যৌবন কাউকেই বেঁধে রাখা যায় না। সময়ের কি লাশ হয়? হয় না? তাইতো সুমাদের লাশও হয়নি, সুমাদ সময়। সেই সময়টাকে আজ ষাট ধরে হৃদয়ের হাজার ফুট গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম নারী বলে। আজ আমি বৃদ্ধা। সকল বয়সের বাইরে আমার জীবন। জীবনের এই ভাদ্র বেলায়, সকল মানুষের কাছে সেই সময়ের করুণ সুর শঙ্খের আওয়াজে না হোক, বাঁশের বাঁশিতে বাজিয়ে দিলাম। সুর ভেসে যাক প্রত্যেক নারীতে-পুরুষে। হাজার মানুষের স্মৃতির ভীড়ে, এ স্মৃতি হোক সকলের আপন ।


 

 

 

 

 

 

 

 

 

১ম পর্বঃ
https://cutt.ly/GPfvtSE

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত