সম্প্রীতির ভিত্তিমূলে আঘাতের কারণ বিচারহীনতা
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২২, ১১:৫৩ | আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৫৭
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিমূলে আঘাতের মূল কারণ বিচারহীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কোনো ধর্মকে অবমাননা করার অধিকার যেমন কারো নেই, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বাড়িঘর, মন্দির ও দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার অধিকারও কারো নেই। ফেসবুকের পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে শাস্তি অনিবার্য। কিন্তু এর জের ধরে অন্যায়ভাবে যার বা যাদের বাড়িঘরে, দোকানে, মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করা হলো তাদের অপরাধটা কী? ২০০১ সাল থেকে বহুবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হলেও কোনো ঘটনায় হামলাকারীর শাস্তি হয়েছে বলে নজির নেই। অতি সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। এর আগে গত ১৮ জুন নড়াইল সদর উপজেলায় ইউনাইটেড কলেজের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দিয়ে চরমভাবে অপদস্থ করার ঘটনা জাতিকে হতবাক করেছিল। দিঘলিয়া গ্রামের মতো ঘটনা এদেশের বিভিন্ন স্থানে যতবারই ঘটেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ততবারই চরমভাবে আঘাত পেয়েছে। হৃদয়ে আঘাত করলে সে আঘাত দেখা যায় না। হৃদয় যখন আঘাত পেতে পেতে অসার হয়ে যায় তখন ক্ষয়ে যাওয়া হৃদয় পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে নেয়!
মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানরা একসাথে মিলেমিশে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া। তবে কেন স্বাধীন দেশে হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার হামলা? মসজিদ-মন্দির পবিত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। যুগ যুগ ধরে মুসলমান-হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। কিন্তু সুযোগসন্ধানী কিছু লোক তথা ধর্ম ছত্রধারীরা বিভিন্ন সময় ধর্মকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে থাকে। স্বার্থান্বেষী ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে এ ধরনের ঘটনার পুরনাবৃত্তি ঘটছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা জাতীয় সংহতির ওপর আঘাত। স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর আঘাত। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারিয়ে ফেলেনি তো? স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও কেন বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা? হামলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক দুর্বলতার ঘাটতি নেই তো?
দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেসবুকে পোস্ট, রাগ-ক্ষোভ, চাঁদাবাজি, জমিদখল, পূর্বশত্রুতা ও তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। তথ্য বলছে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৩৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বর্তমানে তা ৮ দশমিক ২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের মোট জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। কিন্তু হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অনাকাক্সিক্ষতভাবে কমে যাওয়ার কারণ দেশের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেছে কি ? ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় কয়েক’শ পরিবার নির্যাতনসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া আরেক জঘন্যতম ঘটনা ছিল কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা। এ ছাড়া পাবনার সাঁথিয়া ও বরিশালের চর কাউয়ার, কুমিল্লার ঘটনা, খুলনার শিয়ালী গ্রাম, মুন্সীগঞ্জ, নড়াইল ও উত্তরায় সংখ্যালঘু ও তাদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা কারো অজানা নয়।
এদেশের সংখ্যালঘুদের অপরাধটা কী ? বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মগ্রহণই কি অপরাধ ? কেন বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে ? দুই দশক পার হয়ে গেলেও কেন ২০০১ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ও ক্ষয়ক্ষতির বিচার এখনো থেমে আছে ? স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতি ও ঘটনার গুরুত্বহীনতার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বিভিন্ন ঘটনা দ্রুত সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়ায় অন্যান্যরাও হিন্দুদের জমি দখল, বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা করতে সাহস পাচ্ছে। সব ঘটনা পত্রিকায় আসে না। এদেশের অনেক হিন্দু পরিবার স্থানীয়ভাবে ভয়ের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে! অনেক হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি-জমিদখল করার জন্য ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নানা কৌশলে চাপ দিচ্ছে। বিভিন্ন সময় নির্যাতন ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর মধ্যে তো বটেই সারাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় অভিযুক্তদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। কোনো কোনো ঘটনায় অভিযুক্তরা বিভিন্নভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে! ফলশ্রুতিতে ভয়ে ও দুঃখে অন্যায় নিপীড়নের প্রতিকারের প্রত্যাশা সংখ্যালঘু নিপীড়িত মানুষ আর করতে সাহস পাচ্ছে না! যেকোনো গুরুতর সহিংসতায় অপরাধীদের শাস্তি না হলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে থাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এদেশে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সচেতনতা ও প্রশাসনের বাড়তি সতর্কতায় পারে জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। বারবার সাম্প্রদায়িক আঘাতের বিচারহীনতার কারণে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন এদেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বুকভরা কষ্ট নিয়ে অন্যত্র নিরাপদ ঠিকানায় পাড়ি জমাবে!
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত