সন্তান ঘাতক মা নয়ঃ এই নৃশংসতা রাষ্ট্রীয় নৃশংসতারই প্রতিফলন
প্রকাশ: ৯ মে ২০২৪, ১৩:২০ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৩৭
সম্প্রতি আমেরিকায় ঘটে নিষ্পাপ এই শিশুটির নির্মম মৃত্যুতে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। এই কষ্টের রেশ কখনোই মন থেকে মুছে ফেলার নয়। সেই সাথে তীব্র ঘৃণা জাগে বিবেকহীন পিশাচ এই মায়ের প্রতি। কিন্তু কিছু প্রশ্ন-কিছুটা ঘৃণা-ভালবাসা তীব্র যন্ত্রণা যা সতন্ত্র মনের গহীনে আরো বেশি তীব্র হয়ে নিজকেই দগ্ধীভূত করতে চায় অথবা হতে চায় যেন।
তথাকথিত পিশাচ এই মা কি সিংগেল মাদার ছিল কি না। সে কি 'post partum blue' - তে আক্রান্ত ছিল? অনেক দিন ধরে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন জীবন একা একা কাটাচ্ছিল কি না/ তীব্র রকমের অসহায় একটানা একা বাচ্চার জন্য রাত জাগতে হয়েছিল কি না।
নিজের দুঃখ কষ্ট শেয়ার করার মত কেউ ছিল কি না। কোন কারণে চরম মানসিক অবসাদ তাকে গ্রাস করেছিল কি না। তার মানসিক ভারসাম্য বজায় ছিল কি?
একটানা কর্মব্যস্ত দিনের পরে রাতের পর রাত বাচ্চার জন্য নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছিল কি না। একটি সভ্যতম দেশের নাগরিক হয়েও হয়ত তাকে সুবিধা বঞ্চিত সিংগেল মাদারের জীবন কাটাতে হয়েছিল।
আপন জন পাড়া পড়শি কেউই হয়ত তার দুঃসময়ে/ শারীরিক - মানসিক অসুস্থতায় সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে পাশে থাকনি।
ন্যুনতম সান্ত্বনার পরশও রাখেনি তার দূর্দিনে কেউ। কেউই প্রশ্ন করেনি হতভাগ্য এই শিশুটির বাবা কোথায় ছিল তখন?
পড়শি কেউ একজন অসুস্থ ক্রন্দনরত শিশুটির ছবি ভিডিও করেছিলেন। সবাই শিশুটির হৃদয়বিদারক কান্নার আওয়াজও শুনেছিল। কেউই শিশুটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি বা পুলিশে খবর দেয়নি।
হতভাগ্য এই মায়ের চোখ মুখ বডি ল্যাংগুয়েজ স্পষ্ট বলে দেয় সে মানসিক ভাবে সুস্হ নয়। মানসিক নিপীড়ন এবং দীর্ঘ সময়ের চরম হতাশায় বিপর্যস্ত ছিল সে। সভ্য সমাজ তার কোনরকম যত্ন নেয়নি/ সমব্যথী বন্ধুর মত পাশে থাকেনি।রাষ্ট্র তার কারণ খুঁজতে বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা দেখায়নি।পিশাচ এই মায়ের নৃশংসতা মূলত রাষ্ট্রীয় নৃশংসতারই জ্বলম্ত প্রতিফলন। নিষ্পাপ এই শিশুর নির্মম মৃত্যু রাষ্ট্রীয় নির্মমতারই ইংগিত বহন করে।
কোন সে হতাশাবন্দি অবস্হা থেকে মুক্তির প্রার্থনায় সে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে নাড়ি ছেঁড়া ধন এবং ঘর ছেড়েছিল রাষ্ট্র বা সমাজ তা নিয়ে একটিবারও ভাবল না তলিয়ে দেখল না। সভ্যতার শীর্ষে থাকা মানবেরা তার এই মানসিক বিকার নিয়ে একটিবারও প্রশ্ন তুলল না/কারণ খতিয়ে দেখল না।
সভ্যতার বড়াই দিয়ে তারা তাৎক্ষণিক এই অস্বাভাবিক মা কে কঠিন শারীরিক শাস্তি দিতে প্রমত্ত হয়ে উঠেছে। এই শাস্তি কি তাকে মানসিক সুস্হতা আর স্বাভাভিকত্ব দেবে? তাকে কি বাস্তবতা অনুধাবন করতে শেখাবে। এই শাস্তি গ্রহন করার মত অবস্হা তার আদৌ আছে কি না সে ও তো ভাববার বিষয়।
অনেক বছর আগে বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ের post partum blue- তে আক্রান্ত সেই মেয়েটি যখন তার ৩ টি বাচ্চাকেই মেরে ফেলে বলেছিল - আল্লাহর হুকুমে ৩ টা শয়তানরেই শ্যাষ করছি---- তখন গ্রামবাসী জ্বীনের আছর বলে তাকে পানি পড়া খাইয়েছিল( তবু ভাল যে আমেরিকানদের মত বীভৎস শাস্তি দেয় নি তাকে)। তাদের শিক্ষা ছিল না, তারা সভ্য ছিল না, কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের মত আচরণ তারাও করেনি। একটি সভ্যতম দেশের সৃষ্টির সেরাদের কাছে পৃথিবী কোনরকম বিচার বিশ্লেষন ছাড়া এই হিংস্রতা আশা করে না।
পিশাচ এই আমেরিকান মায়ের সুযোগ সন্ধানী ছেলে বন্ধুটির মাথায়ও কি এই প্রশ্ন আসেনি - যার সাথে হলি ডে কাটানোর অভিপ্রায়ে সে আত্মহারা তার অবোধ শিশুটির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে তো? মায়ের অবর্তমানে কে দেবে তার নিরাপত্তা, আদর যত্ন মমতা?
আমরা কি তবে এমনটাই ভেবে নেব একটি সিংগল মা এবং তার সন্তানের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ শীর্ষতম মানব সভ্যতা। আমরা কি নিশ্চিত ধরে নেব সিংগেল মায়েরা পৃথিবীর কোথাও ভাল নেই। পুরুষ শাসিত এখনো এই সমাজের নারী বিদ্বেষী চোখ রাঙানী -সভ্য দেশেও। মেয়েদের প্রজনন এবং মাতৃত্ব কালীন বা পরবর্তী স্বাস্হ্য সেবা সারা বিশ্বেই অবহেলিত।।
অবিবাহিত মায়েরা( আমি জানিনা এই মা অবিবাহিত ছিল কি না) সব দেশেই পরিবার পরিজন কর্তৃক পরিত্যক্ত এবং অবহেলিত। অবিবাহিত পিতারা(পুরুষেরা) সব সময়ই এই মানসিক যন্ত্রনা এবং সামাজিক ঘৃনার উর্ধে বিরাজমান। দেশ কাল পাত্র ভেদ যতই থাকুক না কেন দুধে ধোয়া তুলসী পাতা তারা।
আমি আমার খুব কাছের একজন আত্মীয়াকে জানি জমজ বাচ্চা জন্মের ৪৬ দিন পরেই পরকীয়ার পাগলামীতে পেয়ে বসেছিল তাকে।তিনি ঘর সন্তান ছেড়ে তাকে বিয়েও করেছিলেন। সবাই ছি ছি করেছিল তাকেই, তার প্রেমিকটি যেন সাধু পুরুষ! তবু ও তো তার post partum psychosis diagnosis ঠিকই হয়েছিল একসময়।
এক্ষেত্রে বলতে পারি সভ্যতার বড়াই করা দেশটির অবস্হান অনেক নীচে।
মেয়েদের সন্মান, মর্যাদা, যত্ন, স্বাহ্য সেবা নিয়ে সভ্যতম দেশটির প্রতি আরো অনেক প্রশ্ন জাগে মনে।
আশা করছি আরো বেশি টর্চার করে মৃতপ্রায় করার আগে মানসিক ভারসাম্যহীন এই মায়ের সার্বিক অবস্থা এবং এর প্রকৃত কারন খুঁজে বিশ্লেষণ করা হবে। যে সমাজ ব্যবস্হা নর পিশাচ মাতৃত্ব তৈরি করে/ তৈরি হতে বাধ্য করে এমন রাষ্ট্র কখনোই প্রার্থনায় রাখি না আমরা কেউই। নিষ্পাপ শিশুটির জন্য প্রার্থনা করি প্রার্থনা করি তার আত্মার শান্তির জন্য।
ডাঃ প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, নাজমা বেগম নাজু
সান
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত