শিক্ষার্থীদের উগ্রতা চর্চা বাড়ছে, আতঙ্কে সংখ্যালঘু শিক্ষকরা

  হাসান শান্তনু

প্রকাশ: ৮ এপ্রিল ২০২২, ১৪:৩৫ |  আপডেট  : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৪

স্বঘোষিত এক ‘মুফতি’ গত বছর দাবি করেন, ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মুসলমান ছিলেন! তার ওই দাবির ভিডিও নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় দেশের একশ্রেণির মুসলমানের মধ্যে। ফেসবুক, ইউটিউবে হৈচৈ শুরু হয়। তারা গর্বের সঙ্গে ওই ভিডিও প্রচার, শেয়ার করেন।

অথচ শেক্সপিয়ার এক নাটকে ইসলামের নবি মুহাম্মদের (সা.) ধর্ম প্রচার সম্পর্কে ‘কবুতর’ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, সেটা প্রকৃত কোনো মুসলমান কখনো বিশ্বাস করেন না। অজ্ঞতার কারণেই তারা ‘মুফতির’ বক্তব্য নিয়ে মাতামাতি করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে মুসলমান, বা তিনি ‘ইসলাম গ্রহণ করেছেন’- এ ধরনের মিথ্যা দাবি ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীর বিশেষ কৌশল। তাদের কৌশলের আরেকটি অংশ- ‘ইসলামের সবকিছু বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণিত’। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের এ যুগে এমন প্রচারণা তারা চালাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ ইউটিউব, ইন্টারনেট টিভি, অনলাইন পোর্টাল, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে দেশের বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উগ্র মতাদর্শে প্রভাবিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে উগ্রচিন্তা প্রকট।

অনলাইনে উগ্রতার চর্চা করে জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন। একজন শিক্ষার্থী গড়ে দৈনিক ১৩ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকছেন। ফলে তাকে সে মাধ্যমে প্রভাবিত করা সহজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ওয়াহাবি মতাদর্শে অনুসরণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ভাত-কাপড়ের জন্য নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও মগজধোলাইয়ের কারণে তারা বিপথগামী হচ্ছেন। তাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা নেই। অন্য ধর্মের অনুসারীদেরকে ‘ইসলামের শত্রু’ মনে করে তারা।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর না হওয়া, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকা, শিক্ষা কার্যক্রম সঠিক পথে পরিচালিত না হওয়া, অভিভাবকদের সতর্কতার অভাব আর উদার সংস্কৃতির চর্চা না থাকায় শিক্ষার্থীরা উগ্রতায় জড়াচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গিবাদ-বিরোধী সেল খোলার নির্দেশ দিলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না।

এসব শিক্ষার্থীকে ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যালঘু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই ব্যবহার করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। ‘ইসলাম অবমাননার’ কথিত অভিযোগ তুলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান শিক্ষককে গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুত করা, বিভিন্ন সাজা দেওয়ার ঘটনা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়া ও প্রশাসনের এক ধরনের প্রশ্রয় থাকায় ধর্মীয় কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীগুলো।

এতে ‘অভিযুক্ত’ শিক্ষকসহ তাঁর পরিবার নতুন ঝুঁকির কবলে পড়ছে। সবশেষ মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তির’ অভিযোগে মামলা ও তাঁর কারাবাস দেশের সংখ্যালঘু শিক্ষকদের আতঙ্কিত করে তোলেছে।

তাঁরা বলেন, হৃদয় মণ্ডলকে শ্রেণিকক্ষে ফাঁসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এভাবে যে কাউকে ফাঁসানো সম্ভব। তিনি বলেছেন, ধর্ম বিশ্বাসের আর বিজ্ঞান প্রমাণের বিষয়। এটা যে কোনো শিক্ষকেরই বক্তব্য। শ্রেণিকক্ষে মুঠোফোন সেট নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।

শিক্ষার্থী কীভাবে, কেন মুঠোফোন সেট নিয়ে গেল, এর বিচার হয়নি। হৃদয় মণ্ডল পুরো বক্তব্যে কোনো ধর্ম সম্পর্কে অবমাননা করেননি। প্রশাসন তা বিবেচনা না করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও বিষয়গুলো অশনি সংকেত।

‘ইসলামবিদ্বেষী’ কথিত মন্তব্যের জের ধরে গত বছরের অক্টোবরে ঢাকার ভিকারুন নিসা স্কুল ও কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র পালকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটে। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তালুক শাখাতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পবিত্র রায়কে গত বছরের ২৪ জুলাইয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে একই অভিযোগে। ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর চাঁদপুরের ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির ইলেক্ট্রিক্যাল বিভাগের শিক্ষক জয়ধন তনচঙ্গাকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।

ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জের পি আর সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ২০১৬ সালে কান ধরে উঠ-বস করানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতীয় পার্টির স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশে তাঁকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করানো হয়।

ওই ঘটনা তদন্তের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি শ্যামল কান্তির ধর্মীয় অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও একই কথা বলে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রঘুনন্দনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পিন্টু মজুমদার কথিত একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।

২০১১ সালের ২৬ জুলাই ঢাকার ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক মদনমোহন দাস, একই বছর গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শংকর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননা’র অভিযোগ ওঠে। পরে জানা যায়, তাঁরা বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের শিকার হন। ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেননি।

ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব আছে। ফলে সমাজে নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয় ঘটছে। সুষ্ঠু রাজনীতি ও সংস্কৃতির চর্চা না থাকা আর ধর্মান্ধতার কারণে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বিপথগামী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।’

শিক্ষার্থীদের উগ্রতার চর্চার গবেষণার বিষয়ে এর অন্যতম গবেষক ও ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইম‌তিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সম্ভাষণ ও বিদায়সহ দৈনন্দিন নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কথাবার্তায় আরবি শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিজাব, নেকাব পরা ও ছেলেদের মধ্যে ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুসরণকারীদের মতো গোড়ালির ওপর প্যান্ট পরার প্রবণতা বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘বৈশাখের মতো বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন করার বিষয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করেন।’

কৃতজ্ঞতায় :
মত ও পথ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত