শহীদ জননীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২২, ১১:০৯ |  আপডেট  : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯

মহসীন দেওয়ান লিটন
----------------------------


ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রযোজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়ত এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়রি। কী অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প। — হুমায়ূন আহমেদ

এক বাঙালি নারী, গৃহবধূ, লেখিকা এবং লড়াকু জননী জাহানারা ইমাম স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন প্রেরণা ও আস্থার ধ্রুবলোক।

এ এমন জননীর গল্প যিনি খলীল জিবরানের প্রফেট থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন,পুরো পরিবার যেন নীলকণ্ঠ।পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব,নিজে হয়েছিল নীলকণ্ঠ।এই পরিবার ,এই গল্প,এই পিতা পুত্র জননীরাও যেন তাই।আমরা দুর্ভাগ্যবান তাদের নষ্ট বীজ আজো বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে শ্যামল বাঙলায়,যার জন্য গল্পের জননীকে,আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধান। এরচেয়ে বড় জঘণ্য অনাচার পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?

চল্লিশের দশকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে একটি রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে সৈয়দা হামিদা বেগম আর তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী সৈয়দ আবদুল আলীর ঘর আলো করে ১৯২৯ সালের ৩ মে জন্ম নিলো এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান।মেয়ের ডাক নাম বাবা-মা আদর করে রাখলেন জুড়ু পুরো নাম জাহানারা বেগম। পরে জুড়ু কে জাহান ও নামে ডাকা হতো।সাত ভাই-বোনদের মাঝে জাহান ছিলো সবার বড়।

ক্লাস সিক্স শেষ করে আর লেখাপড়া করবেন না বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। কেউ যখন তাকে লেখাপড়া করাতে রাজি করতে পারছেন না তখন হঠাত করে নিজে থেকেই আবার লেখাপড়ায় আগ্রহ ফিরে পেলেন। কারণটি বিচিত্র, তিনি খবরের কাগজে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মুগ্ধতা যতটুকু না বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বিদ্যাবুদ্ধি আর পাণ্ডিত্যে তার থেকে বেশি তার হাতকাটা ব্লাউজ আর ববকাটা চুলে!

 কৈশোরে তার বই পড়ার তীব্র আগ্রহ। স্কুল শেষ করেই রবীন্দ্র রচনাবলিতে ডুবে গেছেন, বিছানার নিচে লুকিয়ে বঙ্কিমের কপাল কুণ্ডলা পড়ছেন। ছোট বয়সে বড়দের 'নভেল' পড়ার কারণে নিগৃহীত হচ্ছেন তবু কোনোমতে নিজেকে থামাতে পারছেন না। বইয়ের জন্য তীব্র আকর্ষণের কাছে সব যুক্তি সব বাধা নিষেধ তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।

 দেখি ছটফটে একটা কিশোরী সাইকেলে করে শহর চষে ফেলছে তার আনন্দ আমাদের স্পর্শ করে। আবার দেখতে পাই হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে শাড়ি পরিয়ে ঘরের ভিতর বন্দী করে ফেলা হয়েছে, সেই যাতনাটুকুও সমানভাবে আমাদের ব্যথিত করে।

অন্যজীবন বইয়ের শেষ অংশে জাহানারা ইমাম তরুণী হয়ে উঠেছেন। তার জীবনে প্রায় একই সঙ্গে রাজনীতি আর প্রেম এসে দেখা দিয়েছে। আমরা আবিষ্কার করি প্রেমকে সম্মান দেখাতে গিয়ে তিনি রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়েছেন, সেজন্য তার ভেতরে অস্পষ্ট বেদনাবোধ। এই বইয়ে উল্লেখ নেই কিন্তু আমরা জানি শেষ জীবনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তার নেতৃত্বে সারা দেশে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আমরা জানি না তরুণ বয়সে রাজনীতিকে বিসর্জন দেওয়ার সেই অতৃপ্তিটুকু শেষ বয়সে পূর্ণ হয়েছিল কিনা! কিন্তু আমরা অন্তত এটুকু জানি তার এই ভূমিকাটির জন্য এই দেশের মানুষ তাকে বুকের ভেতরে ঠাঁই দিয়েছে।

অন্যজীবন বইটিতে এই অসাধারণ মানুষটিকে আমরা ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণী হিসেবে দেখতে পাই। মানুষটি নেই কিন্তু এই ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণীটি তো আমাদের চোখের সামনে আছেন। 

" রুমি খুব সহজে পৃথিবীতে আসে নি । দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা গর্ভধারিণীকে কষ্ট দিয়ে, নিজেও কষ্ট পেয়ে তবেই সে এই পৃথিবীর আলো দেখে। আমার ডাক্তার জানতেন, রুমীর বাবা ইন্জ্ঞিনিয়ার।

তিনি সদ্যজাত রুমীকে দুই পায়ে ধরে, মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, 'এটা ১৯৫১ সাল । ২০ বছর পর ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইন্জ্ঞিনিয়ার হবে ।'

আমি বলেছিলাম, যদি হতে না চায় ?

ডাক্তার হেসে বলেছিলেন, 'ইন্জ্ঞিনিয়ার না হতে চায় না হবে।তবে কিছু একটা তো হবে ।'

১৯৭১ সালে রুমী ইন্জ্ঞিনিয়ার হতে পারে নি । তবে কিছু একটা হয়েছিল ।
সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছিল ।"

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এর "৭১ এর দিনগুলিতে এভাবেই রুমির পৃথিবীতে আসার সময়টা বলেন।

”তুইতো এখানে পড়বিনা। আই আই টিতে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে ,তোকে না হয় কয়েকমাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেব “- শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

"আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও,আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা। তুমি কি তাই চাও আম্মা?” রুমী।

শহীদ জননী জোরে জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন- “না ,তা চাই নে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে।  যা, তুই যুদ্ধেই যা।”

সেই মা'কে ছেলে কিছুক্ষণের জন্য আড়ালে যেতে বলে।মা বুঝতে পারেন তার ছেলে সিগারেট খেতে শিখেছে তাই আড়াল চায়। মা বলেন, "কতদিন পর তোকে দেখছি! আবার কখন, কতদিন পর দেখব জানিনা। আমার সামনেই সিগারেট খা।

 ঢাকায় অপারেশন করতে বাসায় এসে মা'য়ের কাছে রুমীর আবদার ছিল একটা ভালও সিগারেটের বক্স, যেটাতে পানি ঢুকে সিগারেট ভিজে যায় না। 

মা জাহানারা ইমাম ঢাকার সব মার্কেট ঘুরে অবশেষে এমন একটা সিগারেটের বক্স পেলেন যেটাতে সিগারেট রেখে তাঁর ছেলে পাক বাহিনীর ভয়ে জলের নিচে ডুব দিয়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু তাঁর সিগারেট ভিজবে না।

''এখন আমি ২০০০ সালের দিকে তাকিয়ে আছি । অতদিন বাঁচব কি ? এখন আমি বাঁচতে চাই । বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য আরো লিখে যেতে চাই । আমার বই পড়ে যেসব পাঠক আমার কাছে আসে , তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে । তারা আমার কাছ থেকে জগত জীবন সম্পর্কে কতো কিছু জানতে চায় , আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা আরো বেশি করে জানতে চায়, তাদের নিজস্ব সুখ দুঃখ মেশানো নানা সমস্যার সমাধানও জানতে চায় , তারা আমাকে ঘিরে রাখে । তাদের জন্যই আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একাকী বাস করেও কখনো নিঃসঙ্গ বোধ করি না । তাদের আগ্রহে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো বাঁচার , আরো লিখে যাবার প্রেরণা পাই । ''

দশ বছর ঘাতক ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করে এই কথাগুলো দিয়ে তিনি শেষ করেছেন ''ক্যান্সারের সাথে বসবাস ''বইটি । শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এভাবেই সকল তরুণের মাঝে খুঁজে পেতেন রুমীর মুখ ভালবাসায়,স্নেহে হয়ে উঠেছেন সকলের মা।

১৯৮২ সালে তিনি আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ব্যাধি ওরাল ক্যান্সারে। প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাঁকে। এভাবেই যাচ্ছিলো তাঁর দিন। মুখের ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছিলো অপরূপ লাবণ্যময়ী এই নারীর মুখশ্রীর অনিন্দ্য সৌন্দর্য।মরণব্যাধি ক্যান্সারের সংগে লড়াই করতে করতে অন্য আরেকটি লড়াইয়ের জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন জাহানারা ইমাম।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের লোভ এবং অদূরদর্শিতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার আলবদরদের ক্রমশঃ উত্থান তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিলো। ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী- মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এই উত্থানকে রুখে দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন জাহানারা ইমাম, আশ্চর্য সাংগঠনিক দক্ষতায়। মাতৃত্ব থেকে অবলীলায় তিনি চলে এলেন নেতৃত্বে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম - মায়ের চোখে দেখা আমাদের ৭১ এর দিনগুলো ।তোমার জ্বালানো চেতনার শিখায় ধ্বংস হবেই ঘাতকের শেষ চিহ্ন ।আম্মা চেতনার মিছিলে দেখ আজ তোমার রুমিদের কি স্পর্ধিত পথচলা। 

আজ শহীদ জননী জাহানার ইমামের চলে যাওয়ার দিন!মা কি চলে যায়? না তো। এই প্রজন্ম তাঁর কাছে ঋণী। তিনি এই জাতিকে মৌলিক শিকড়ের সন্ধান দিয়েছিলেন। এই দেশ জেগে আছে তাঁর স্বপ্ন বুকে ধারণ করে। তারা জানি তিনি কী অদম্য সাহস নিয়ে ডাক দিয়েছিলেন। মা তিনি , জননী তিনি।। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নিজের বাকি জীবন উৎসর্গ করেন।

আম্মা রুমির মত এভাবেই তুমি বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের নতুনভাবে আমাদের চিনিয়েছ।রুমি , জামীর মা থাকেন নি , পুরো জাতির আম্মা হয়ে উঠেছেন।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকুক আপনার অনুপ্রেরনাদায়ী আত্মত্যাগী জীবনগাঁথা।

আম্মা  থেমে যাননি, সংগঠিত হয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন, গড়ে তুলেছিলেন ঘাতকের বিচারের দাবীতে অদমনীয় আন্দোলন। যে আন্দোলনের ফসল আজ আমরা দেখতে পারছি, অথচ তাঁকে চলে যেতে হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে। এ লজ্জা আমাদের রাখবার জায়গা নেই।  

ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়েছে ভুল পথে...
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত