শনি মন্দির ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ১২:৩৪ | আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০০
কেশব মুখোপাধ্যায়
---------------------------
শনি কবে থেকে বাংলার রিক্সা চালকদের নিজস্ব দেবতা হয়েছেন, জানা নেই। তবে রিক্সা স্ট্যান্ডের উপরে লাল পতাকা, নিচে শনি দেবতা এবং তার রমরমা বাম জমানা থেকেই। ২০১১ তে রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পর, আর সব যেমন ছিল তেমন থাকলেও শনি ঠাকুরের মাথার উপরে ওড়া পতাকাটা পাল্টেছে ।
এই ধরনের শনি মন্দিরগুলো থেকে শুধু হিন্দি গান বা হিন্দি এফ এম শুনতেই আমাদের কান অভ্যস্ত ছিল এবং আছে। এবং এইভাবে এই সব শনি মন্দির 'ভারতীর সংহতি' বিকাশের কেন্দ্র হয়ে আছে কয়েক দশক ধরে। গত শনিবার এহেন এক শনি মন্দির থেকে প্রিয় গায়কের গাওয়া, প্রিয় একটি নজরুলগীতি শুনে হঠাৎ করেই নানা ভাবনা মাথায় এসেছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮-বি 'র কাছে ওই শনি মন্দিরের অদূরেই থাকতেন বাংলা গানের স্বনামধন্য শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এক বিকেলে তাঁর গাওয়া 'বাগিচায় বুলবুলি তুই ...' গানটি ওখানে বাজতে শুনে মনে প্রশ্ন জেগেছিল আজ কি শিল্পীর জন্ম বা মৃত্যু দিন ? পরে এমন প্রশ্ন মনে আসায়, নিজের মনেই হেসে ছিলাম ।
ওই সূত্রেই মনে পড়ে যায়, 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন কমিটি' গঠন করার পর, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সঙ্গীত ইত্যাদির সংকট ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা এবং অভিমত জানতে ১৯৮৭ সালে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হওয়ার স্মৃতি।
শিশু বয়সে বাবার সঙ্গে দেখে ছিলাম 'লালুভুলু' সিনেমা। ওই ছবিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গাওয়া গানগুলো শোনা থেকেই, তিনি আমার প্রিয় শিল্পী। বাড়িতে মাঝে মাঝেই কলের গান বাজিয়ে লালুভুলু-র গান শোনা শিশু বয়সে ছিল আমার প্রিয় সখ।
বেশ কিছুটা দ্বিধা নিয়েই ১৯৮৭-র কোনও এক সকালে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যাযয়ের বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে ছিলাম।
দ্বিধার কারণ ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাওয়ার সামান্য কয়েকদিন আগে, আর এক প্রিয় গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই উদ্দেশে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে, প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা । দিন কয়েক আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আমি কোথা থেকে আসছি জেনে, যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে বসতে বলে, ভিতরে খবর দিয়ে একটু পরে ফিরে এসে বললেন, '... উনি আসছেন'। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, অনুষ্ঠান কবে, কোথায় হবে ইত্যাদি। উত্তরে জানিয়ে ছিলাম কোনো গানের অনুষ্ঠানের বায়না করতে নয়, বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সংকট ইত্যাদি বিষয়ে ... । আমাকে থামিয়ে তিনি বিরক্তির সঙ্গে বললেন, 'এ সব তো আগে বলবেন'। তারপর তিনি ব্যস্ততার সঙ্গে ভিতরে গিয়ে, কিছু সময় পর ফিরে এসে জানালেন, 'না এ সব বিষয়ে উনি কথা বলতে পারবেন না। উনি অসুস্থ'।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির একতলার প্রসস্থ বারান্দায় বসেই তাঁকে জানিয়ে ছিলাম বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে আমাদের কমিটি তৈরির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। শুনে তিনি দু-হাত উপরে তুলে বললেন, 'আমি সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। কিন্তু খুব কঠিন, আমরা নিজেরাই সব মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, ... হিন্দির অনুকরণ ও অনুসরণ করছি। ... ধর্মের ভিত্তিতে যে বাংলা ভাগ হয়েছিল, তার একটা অংশ ভাষার ভিত্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। তা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিয়েছি ? কিছু না। শুধু মুখে প্রগতির কথা ... । ওই যে সল্টলেক স্টেডিয়াম, তার জন্য মিছিলে হেঁটেছি, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গান গেয়েছি। ভেবেছি বাঙালির খেলা-ধূলার একটা নিজস্ব কেন্দ্র হবে। ... কী হচ্ছে যেখানে ? বোম্বাইয়ে শিল্পীদের নিয়ে এসে হিন্দি নাচ-গানের আসর বসানো হচ্ছে! ... এরাই আবার অপসংস্কৃতি অপসংস্কৃতি বলে চিৎকার করবে। ... আমরা গান শিখে গান গাইতে এসেছি। যখন প্রথম গান শুরু করি, বাংলা গানের কী সমাদর, কী সম্মান, কত শ্রোতা ! ... শুধু বাংলায় নয়, রাজধানী দিল্লিতে বাংলা গানের সম্মেলন হতো। দিল্লিতে "Bengali Music Conference"-এ প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য ভি আই পি-রা বাংলা গান শুনতে আসতেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাস ভবনে আমাদের আমন্ত্রণ করতেন। সেখানে গান-বাজনা হতো। ... বাংলা গানের কতো বিচিত্র ধারা ----- জারি-সারি-ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি-রবীন্দ্র-নজরুল-অতুল-দ্বিজেন্দ্র-রজনী-রামপ্রসাদ-লালন-হাসনরাজা ... কত বলবো ! কোন জাতির এমন সম্পদ আছে ?
আমরা নিজেরাই আমাদের সব সম্পদ নষ্ট করে, বাইরের পঁচা জিনিস গ্রহণ করছি। এ জন্য দায়ি তো আমরা নিজেরাই । তাই প্রথম লড়াইটা আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে, এবং বাংলার জন্য কিছু করতে গেলে, বাঁধাটাও আসবে আমাদের নিজেদের ভিতর থেকেই, কারণ চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতিতে আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ... এই যে জাতীয় অনুষ্ঠানের নামে দূরদর্শনে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হলো, কোনো প্রতিবাদ হয়েছে ? সব মেনে নিচ্ছি ।
আমি বাংলাদেশে গেছি, সেখানকার ছবিতে গান গেয়েছি। বাংলা ভাষার প্রতি বাংলাদেশের বাঙালিদের যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখেছি, তা আমাদের নেই।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যখন কথাগুলো বলছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন বহুদিনের ক্ষোভ তিনি উগরে দিচ্ছেন। ফিরে আসার সময় তাঁকে বলে ছিলাম, আপনি যদি বলা কথাগুলো লিখে দেন ...। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'তুমি আমার নাম করে লিখে বলে দিও যে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এ সব বলেছেন। আর দরকার হলে আমি সই করে দেব'।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত