রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার ঐতিহ্যের আধার

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ১২:১৭ |  আপডেট  : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৩

মোহাম্মদ আবুল খায়ের মৃধা

--------------------------

          হানিফ বেজির তাড়া খেয়ে এখনো ধাতস্ত হতে পারেনি। ভয়ে আচমকা-মুখে-পুরে-ফেলা পান চিবোচ্ছে আর হড়বড় করে কথা বলছে। পানের রস ফেলছে না, পুরোটাই গিলছে। ওর কথার তোড়ে পানের কয়েকটা কণা আমার বাঁ হাতের ওপর এসে পড়ল। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, থাকার কথাও না। এখন টেনশনে আছে, টেনশনমুক্ত হলেই সে একেবারে যত্নশীল মানুষ। কার কী লাগবে, কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে কী না, ক্ষুধা পেয়েছে কী না—ইত্যাদি তত্ত্বতালাশে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

         এদিকে জুয়েলের ডান পায়ের গোড়ালিতে বাঁশ কাঠির সামান্য আঁচড় লেগেছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। নচ্ছার বেজিটাই যত গণ্ডগোলের হোতা; কেন যে পানবরজে আসতে গেল, ভেবে পাই না। এমনিতে জুয়েল হাহুতাশ করার লোক, তার ওপর আবার এই মসিবত। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল সে। বোধহয় হানিফ আর আমাকে উদ্দেশ করে গালাগাল দিচ্ছিল—কেন আমরা তাকে জোর-জবরদস্তি করে পানের বরজে নিয়ে এসেছি। জুয়েল ও হানিফের এসব কাণ্ড দেখতে দেখতে আমার মনে এক ভাবনা এলো: যেহেতু বেজি পানের বরজে ঘুরঘুর করছে, সেহেতু নিশ্চয়ই কোনো সাপ আছে। সাপ যে আছে তার অকাট্য প্রমাণ আমার হাতে নেই। ব্যাঙ, ইঁদুর ও অন্যান্য পোকামাকড়ও বেজি গপাগপ খায়—এসবের লোভেও সে আসতে পারে।

        পুলঘাটার এই পানবরজ দেখার পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী যাব রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার। হাতে সময় কম। দিনের আলো থাকতে থাকতে বাকি স্পটগুলো ঘুরে ঘুরে দেখব। শরীরটা আমার পানবরজে রেখে ঝাঁপটা একটু ফাঁক করে মাথা বের করি; মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই, দেখি আশেপাশে কেউ নেই। জুয়েল ও হানিফকে ইশারায় আমার সঙ্গে বের হতে বলি, ওরা পিছু পিছু বের হয়। তারপর আলতো করে ধরে পাটকাঠির ঝাঁপটা লাগিয়ে দিই। এত লুকোচুরির কারণ আমরা অনুমতি নিয়ে পানবরজে ঢুকিনি। আশেপাশে অনুমতি নেওয়ার মতো লোক ছিলও না তখন।

        যেহেতু অনুমতি নিয়ে পানবরজে ঢুকিনি তাই কে কী বলে, না কি মারধর করে, বলা তো যায় না। আগন্তুকদের অসহায় পেয়ে ছুতো করে না কি মোবাইল ফোন রেখে দেয়। উত্তেজিত জনতাদের থামাবে কে? কিছু উৎসুক জনতা চেয়ে চেয়ে দেখবে আর উপভোগ করবে। পাঁচজন মারবে তো পঞ্চাশজন তামাশা দেখবে। থামাবার নাম করবে না। দাঁত কেলিয়ে হাসবে। কেউ বা লাঠি এগিয়ে দেবে। ঢিল ছুড়ে মারবে। জামার কোণ ধরে টানবে। কিল-ঘুষিতে শরিক হবে। যখন মারতে মারতে ক্লান্ত হবে তখন ভিড় থেকে কেউ বা বলবে, ‘ছেড়ে দে। যথেষ্ট হয়েছে। মারা পড়লে থানা-পুলিশের ঝামেলা হবে।’ তারপর থামবে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে শাসাবে, থানা-পুলিশ যেন না হয়—সেকথা আদায় করে নেবে। এরপর অনেকদিন ধরে বন্ধুদের আড্ডায় রসিয়ে রসিয়ে গল্প করবে। সেদিন আগন্তুকদের কে কয়টা কিল-ঘুষি মেরেছে সেই নিয়ে তর্কাতর্কি চলবে। কিল-ঘুষির সংখ্যায় একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বৃথাই চেষ্টা করবে। কল্পনাবিলাসী মন আমার এসব ভাবনায় ডুবে রইল কিছুক্ষণ। 

 

       পানের বরজ থেকে বের হয়ে রিজার্ভ ইজিবাইকে করে হাতিমারা চৌরাস্তায় আসি। রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারে যাওয়ার রাস্তা চিনতে না পেরে মুন্সীগঞ্জের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে, ফের হাতিমারা চৌরাস্তায় এসে বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে সুখবাসপুর দিঘির কাছে ইজিবাইক থামাতে বলি। এই দিঘির পাশ দিয়ে যে কতবার মুন্সীগঞ্জ সদরে আসা-যাওয়া করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সাইনবোর্ড ছিল না বলে এতদিন চিনতে পারিনি ।

 

      ওরা সবাই গাড়িতে ছিল, নামার গরজ দেখাল না। ব্যস্ত রাস্তা। শাঁই শাঁই করে গাড়ি আসছে-যাচ্ছে। একটু অসাবধান হলেই...। তাই খুব সন্তর্পণে একাই নামি। দিঘির পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলি। লোকমুখে জানা যায় রামপাল যখন পাল ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল, তখন প্রজাদের পানীয়জলের অভাব দূর করার জন্য সুখবাসপুর দিঘিটি খনন করা হয়। এত পুরোনো দিঘি এখনো দখলমুক্ত আছে। বোধহয় ভূমিদস্যুদের নজরে পড়েনি, পড়লেও সুবিধা করতে পারেনি। শ্যাওলা-সবুজ পানি আর গাছগাছালির সবুজ মিলেমিশে নিপুণ শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা এক স্থির ছবি যেন দিঘিটি। শীতকালে পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখরিত থাকে পুরো দিঘির আশপাশ। মনে মনে পণ করেছি, যে করেই হোক শীতে একবার ঘুরে যেতে হবে।

        সুখবাসপুর দিঘির কাছে তেমাথায় সাইনবোর্ডে বজ্রযোগিনী ও রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারে যাওয়ার পথ নির্দেশ করা আছে। আমরা সেই নির্দেশিত পথে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আরেকটা সাইনবোর্ড দেখতে পাই। বাঁ দিকে রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার এবং সোজা গিয়ে ডান দিকে অতীশের ভিটা। আমরা রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারের দিকে যাই।

       মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম রঘুরামপুর। আর এ গ্রামেই হাজার বছরের পুরোনো বিক্রমপুরী বিহার, যা এখন রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার নামে পরিচিত। বিহারটি এতকাল মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ ও ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’ এ দুটো প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এ বৌদ্ধবিহারের সন্ধান মেলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধান করেন এবং আর্থিক সহযোগিতা দেয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ।

       

      মোটামুটি বড়সড় একটা জায়গা। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পুরো ভূমি। তারমধ্যে মাটি ভেদ করে কয়েকফুট উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো কক্ষের আদলে রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করতেন। তখনকার বৌদ্ধবিহার মানে আধুনিক কালের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। রঘুরামপুর আর বজ্রযোগিনী পাশাপাশি দুটো গ্রাম। আর এই বজ্রযোগিনীতেই পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জন্মভিটা। গবেষকদের ধারনা অতীশ দীপঙ্করের সঙ্গে এই বিহারের যোগসূত্র ছিল।

       নাটেশ্বর বৌদ্ধমন্দির ও স্তুপের মতো রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার পলিথিনের বস্তায় মুড়ে রাখা হয়নি। এখানে ছবিসম্বলিত বর্ণনামূলক কোনো সাইনবোর্ডও চোখে পড়ল না, যেটা নাটেশ্বর বৌদ্ধমন্দির ও স্তুপে দেখেছিলাম। দর্শনার্থীদের সতর্ক করে শুধু একটা সাইনবোর্ড ছিল। দেখলাম দুজন দর্শনার্থী এসেছে। বেশভূষায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনে হলো। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিল।

     

      হাসপি খুব নিষ্ঠার সাথে আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছিল। সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় ওর ওপর হরহামেশাই মাতব্বরি চলে। অবশ্য কাজের প্রতি নিজের প্যাশন না থাকলে অন্যের মাতব্বরিতে তেমন কাজ হয় না। আমরা যখন যে যার মতো ফটো তোলায় ব্যস্ত, বিপ্লব ঠিক তখনই খায়ের ভাই খায়ের ভাই করে চেঁচিয়ে ওঠল। ওর কাছে গিয়ে দেখি একটা বিরাটাকায় গুইসাপ। এত বড় গুইসাপ আর কখনো দেখিনি। অনেকটা বিস্মিত হতে হতে ক্যামেরা প্রস্তুত করতে করতেই দৃশ্যপট থেকে ওধাও। ঝোঁপজঙ্গলে ঘেরা একটা ডোবার শুকনো পাড়ে কুমিরের মতো করে নিশ্চিন্তে রোদ পোহাচ্ছিল সে। বোধহয় খাবারের খোঁজে এসেছিল। কালচে রঙের দেহে, হলুদ রঙের রিংয়ে, চ্যাপ্টা লেজে তাকে কুমিরের সহোদর বলে মনে হচ্ছিল।

       সূর্য তখন মধ্য গগনে। রোদে খা খা করছে চারদিক। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-রোদে সবাই যখন কাহিল, এমন সময়ে এক মধ্যবয়সী গৃহস্থকে দেখলাম, চাঙাড়ি করে অনেকগুলো কাঁঠাল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, সে কাঁঠাল বিক্রি করবে কি না। জুয়েল রাখঢাক না করে খাওয়ার প্রস্তাব করে বসল। বিপ্লব আপত্তি করায় হালে পানি পেল না। যদিও আমার ক্ষুধা পেয়েছে, তবুও আমি ছোঁব না। কয়েকবার খেয়ে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়েছে, তাই এ সতর্কতা। কাঁঠাল কিনলে ক্ষুধার চোটে জুয়েল যে ও-বস্তুটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তা ওর করুণ চাহনিই বলে দেয়। (চলবে)

       প্রয়োজনীয় তথ্য: ঢাকার গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের সামনে থেকে বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে ঢাকা-মাওয়া রোডে মুন্সীগঞ্জগামী গাঙচিল পরিবহনের বাস কিছুক্ষণ পরপর বালিগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৭০ টাকা। সেখান থেকে ইজিবাইকে সুখবাসপুর দিঘি পর্যন্ত ভাড়া নেবে ৩০ টাকা । সুখবাসপুর দিঘি থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার ১৫ টাকা ভাড়া। আর যদি বালিগাঁও থেকে ইজিবাইক রিজার্ভ নিতে চান, তবে আপডাউন ভাড়া পড়বে কমবেশি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এক্ষেত্রে দরদাম করে নেবেন। তা ছাড়া নৌপথে ঢাকার সদরঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চে করেও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ভাড়া পড়বে ৫০ টাকার মতো। বালিগাঁও, সিপাহিপাড়া ও মুক্তারপুর ব্রিজের কাছে কয়েকটি খাবার হোটেল আছে। আপনার সুবিধা মতো জায়গায় খাওয়াদাওয়া করে নেবেন। দিনে গিয়ে দিনেই ঘুরে আসতে পারবেন। আর যদি থাকার ইচ্ছে হয়, তবে মুন্সীগঞ্জ শহরে কিছু মোটামুটি মানের হোটেল আছে—সেখানে খোঁজখবর নিয়ে পছন্দ মতো হোটেলে থাকতে পারেন।

বিক্রমপুরের হীরা-মানিকের খোঁজে' পূর্ববর্তী পর্বের লিংকগুলো পেতে নিচে ক্লিক করুনঃ

(পর্ব-১)  https://cutt.ly/RQSRLZS

(পর্ব-২)  https://cutt.ly/PQSR6Ue

(পর্ব-৩)  https://cutt.ly/3QSTfo7

(পর্ব-৪)  https://bit.ly/3yqUsmh

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত