মুন্সীগঞ্জে আড়াই হাজার ‘মিনি গার্মেন্ট’, নিবন্ধন নেই একটিরও
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৩৫
ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জে গেলো কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে প্রায় আড়াই হাজার তৈরি পোশাকের ছোট কারখানা। শীত মৌসুম ও ঈদের আগে এসব কারখানা থাকে জমজমাট। এসব কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন ৩০ হাজার শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব কারখানার কোনোটিরই নিবন্ধনই নেই। সরকারি কোনও নীতিমালার আওতায় না থাকায় ন্যায্য-মজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা। মজুরি নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে মালিকরা বলছেন, সেভাবে মুনাফা করতে না পারায় তারাও অপারগ। আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা অবশ্য এগুলোকে কারখানা বলতেই নারাজ। তারা বলছেন, এগুলো মূলত দর্জি দোকান। এদের তেমন নাম-ঠিকানা নেই। তাই তাদের শৃঙ্খলার আওতায় আনা যাচ্ছে না।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার, রামপাল, মিরকাদিম ও বজ্রযোগিনীতে গেলে চোখে পড়বে এমন অসংখ্য মিনি গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকের ক্ষুদ্র কারখানা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাবে, বর্তমানে এসব কারখানার সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। গত কিছুদিন ধরেই শীত মৌসুমকে সামনে রেখে সেখানে তৈরি হচ্ছে শিশুদের বাহারি ডিজাইনের শীতকালীন পোশাক। দিনরাত চলছে কারখানার মেশিন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাপের সময় অনেকেই ১৮ ঘণ্টাও কাজ করেন। তবে আশানুরূপ মজুরি পান না তারা। এমনকি সবকিছুর দাম বাড়লেও, গত ৫ বছরে বাড়েনি তাদের অনেকের মজুরি। আবার ‘অফ সিজনে’ কয়েক মাস এসব কারখানা বন্ধ থাকায় আরেক সঙ্কটে পড়তে হয় এই শ্রমিকদের। বছর শেষে অনেকের ঘাড়েই চাপে ঋণের বোঝা।
একজন শ্রমিক তার সহযোগীকে নিয়ে দৈনিক এক ডজন পোশাক সেলাই করতে পারেন। আর আকারভেদে এক ডজন এ সব পোশাকের মজুরি পায় তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা।
মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুন্নি এলাকার মাহবুব মিনি গার্মেন্টসের শ্রমিক মো. মিনহাজ জানান, ‘আমাদের সহযোগী নিয়ে কাজ করতে হয়। তাকে বেতন দিতে হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই কাজ করি। তার মধ্যে পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। মেসে খাওয়ার বিল আছে দুজনের (সহযোগীসহ) ৩০০ টাকা। তার ওপর সংসার চালাতে হয়। এই টাকায় আমি হেলপারকে কী দেবো, আর আমিই বা কী রাখবো? আমরা এখানে যতটুকু টাইমে কাজ করি, সেই সময় অন্য কোথাও কাজ করলে আরও বেশি বেতন পাবো।’
একই গার্মেন্টসের শ্রমিক আলী এহসান জানান, এই কাজ যে নতুন কোনও মানুষকে শেখাবো, সেটাতেও মানুষের আগ্রহ নেই। কারণ এ কাজে পরিশ্রম বেশি, বেতন কম। আমরা প্রতিদিন সকাল ৮টায় কাজে বসি। শেষ হতে হতে প্রায় রাত ৩টা, ৪টা বা ৫টাও বাজে। সেই হিসাবে আমরা বেতন পাই মাত্র ৫০০ টাকা। তার মধ্যে হেলপারকে দিতে হয় ২০০ টাকা আর ৩০০ টাকায় আমরা এই ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে কীভাবে চলবো? তার চাইতে যদি কোনও মাটি কাটার কাজ করি ৫ ঘণ্টা সেখানে ১ হাজার টাকার কাজ করতে পারবো। আবার সে কাজ করে চাইলে অন্য কাজও করতে পারবো।
পঞ্চসার ইউনিয়নের শাঁখারিবাজার এলাকার আরেকটির কারখানার শ্রমিক রাজিব হাসান বলেন, ‘এখন শীতের মাল তৈরি করছি। এই সময়ে চাহিদা অনেক বেশি থাকে, এজন্য কাজের অনেক চাপ। এগুলো ৩ মাস থেকে শুরু করে ৬ বছরের বাচ্চা পর্যন্ত পড়তে পারবে। এই মাল বানাতে তুলা, সুতা, চেইন ও ইলাস্টিকসহ আরও অনেক কিছু কাঁচামাল লাগে। মালিকরা নারায়ণগঞ্জ থেকে এই মালামাল এনে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘মাল আনার পর কাটিং-মাস্টার কাটিং করে তারপর আমরা সেলাই করি। মাল তৈরি করে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কালীগঞ্জে বিক্রি করি। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যায় পাইকাররা। মূলত আমরা ১৬ থেকে ৩৮ সাইজ পর্যন্ত জামা-কাপড় বানিয়ে থাকি।’
রামপাল ইউনিয়নের সুখবাসপুর এলাকার রাসেল মিনি গার্মেন্টসের শ্রমিক (কাটিং মাস্টার) আবেদ আলী জানান, এখানে আমি প্রায় ১১ বছর যাবত কাজ করি। আমি মাসে বেতন পাই সাড়ে ১১ হাজার টাকা। দেশের সব শ্রমিকদের বেতন বাড়লেও আমাদের এখানে বেতন বাড়েনি। আর আমাদের এই কাজ শুধু শীত মৌসুমে ও রমজানের ঈদের আগে। বাকি তিন-চার মাস বসে থাকতে হয়। আর তার কারণেই ৪ মাস মালিকের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলতে হয়। সেই কারণেই বছর শেষে মালিকের কাছে আমরা ঋণগ্রস্ত থাকি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে এই মজুরিতে চলতে অনেক কষ্ট হয়। প্রশাসনের কাছে দাবি, তারা যেন ব্যাপারটিতে নজর দেয়। আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পড়ে যেন থাকতে পারি। কারণ এই কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ শিখিনি।
রাসেল গার্মেন্টসের মহিলা শ্রমিক শিলা আক্তার জানান, আমরা এখানে মাল প্যাকেট করি। আমরা প্রতিদিন ৩০ ডজন করে মাল প্যাকেট করি। তবে যখন বেশি সেল হয়, প্যাকেটিং বেশি করতে হয়। সেসময় আমাদের আয় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে হয়। আর যখন কম থাকে তখন আমাদের আয়ও কমে যায়। এখানে আমি এবং আমার স্বামী দুজনই কাজ করি।
বেশিরভাগ মালিকপক্ষ এই অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও কেউ কেউ জানান, বাজারে পোশাকের দাম না বাড়ায়, মজুরি বাড়ানো সম্ভব হয় না।
মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুন্নি এলাকার মো. মাহবুব আলম মিনি গার্মেন্টসের মালিক জানান, এখন আমরা শীতের পোশাক তৈরি করছি। এখন শীতের পোশাকের অনেক চাহিদা। এছাড়াও আমরা রমজানের ঈদেও পোশাক তৈরি করি। সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাঁচামালের দামও অনেক বেড়ে গেছে। এই ঊর্ধ্বমূল্যের জন্য সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পোশাক শিল্প। কাপড়-সুতা এগুলোর দাম অনেক বেড়েছে কিন্তু আমরা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারি না। অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতারা বেশি দামের কারণে পুরনো কাপড় দিয়েও চালিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করে। তারপরেও কিছু কিছু মালে আমাদের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ আমাদের শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়।
রাসেল মিনি গার্মেন্টসের মালিক মো. রাসেল শেখ জানান, এখন মূলত শীতের কাপড় তৈরি হচ্ছে। এগুলো আমরা মূলত নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকার সদরঘাট, টাঙ্গাইলের করোটিয়াহাট, কিশোরগঞ্জের ভৈরবহাটে-ই মূলত বেশি বিক্রি করি। এই ব্যবসায় প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়। এখানে প্রচুর খরচ হয় কিন্তু সে অনুপাতে ব্যবসা হয় না।
এদিকে স্থানীয় বিসিক ক্ষুদ্র শিল্প বাঁচাতে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানালেও, শ্রমিক মজুরির বিষয়ে কল-কারকানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়। সেখানে কথা বলতে গিয়ে জানা গেলো, আড়াই হাজার রেডিমেড কারখানার কোনোটারই নিবন্ধন নেই। এ বছর এ নিয়ে কোনও কাজ করেনি এ অধিদফতরটি।
মুন্সীগঞ্জ বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলায় অসংখ্য মিনি গার্মেন্টস রয়েছে। এখানে তারা শিশুদের শীতের পোশাক তৈরি করে। আসন্ন শীত মৌসুমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রায় আড়াই সহস্রাধিক রেডিমেড কারখানা রয়েছে, যারা শীতের সিজনে শীতের পোশাক তৈরি করে থাকে। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ সদরের রামপাল পঞ্চসার ইউনিয়নের ও মিরকাদিম পৌরসভায় আড়াই সহস্রাধিক রেডিমেড কারখানা রয়েছে। তারা শিশুদের শীতকালীন পোশাক তৈরি করে থাকে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে কিনে নিয়ে যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার মোকামে এখানের পণ্যগুলো বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে আড়াই সহস্রাধিক শিল্প কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক শীতকালীন পোশাক তৈরির কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘এ বছর ৭০-৮০ কোটি টাকার শিশুদের শীতকালীন পোশাক বিক্রির টার্গেট রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিশুদের শীতকালীন পোশাকের যে চাহিদা আছে সেটা মিটাতে সক্ষম হবে।’
তিনি আরও বলেন, মুন্সীগঞ্জে রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প কারখানাগুলোর পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে পণ্য অবিক্রিত থাকে না। তাদের উন্নত ডিজাইন কোয়ালিটি রয়েছে তার জন্য এই পোশাকের চাহিদাও বেশি। বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিক-এর পক্ষ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মার্কেটিং ফেসিলিটি প্রদান করা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
শ্রমিক মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক জাবেদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মুন্সীগঞ্জের সদরের ২ হাজার ৫ শ ক্ষুদ্র কারখানার নিবন্ধন নেই। আমরা প্রতিটি কারখানাকে নোটিশ প্রদান করবো। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের জবাব দিতে সময় বেঁধে দেবো। বেতনের বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদের ডেকে সমাধান করার চেষ্টা করা হবে।
“বেতনের বিষয়ে কোনও শ্রমিক অভিযোগ করেনি তারপরও আমাদের কর্মকর্তা গিয়ে দেখে এসেছে। উনারা দর্জি দোকানের মতো করে নিয়েছে। সেটিকে মিনি গার্মেন্টস বললেও ভুল হবে, আসলে এরকম কোনও শব্দই নেই। মুন্সীগঞ্জে এরকম কোনও ফ্যাক্টরিও নেই। এটিকে আপনি দর্জি কারখানা বলতে পারেন। কারখানার কাজ করে মিনিমাম ৫ জন শ্রমিক থাকতে হবে, প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা এবং মালিকেরও নাম থাকতে হবে। সেখানে কিছুই নেই। তবে এগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি, আপনার প্রতিষ্ঠানের একটি নাম দিতে হবে। যেহেতু নাম-ঠিকানা নেই, সেহেতু কোনও কিছুই করতে পারছি না। একটি লাইসেন্স করতে গেলেও নাম লাগে। এই বিষয়ে ৭-৮ জনের একটি কমিটি গঠন করা হবে। তখন আরও ভালোভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যাবে।”
তিনি আরও জানান, জোরপূর্বক আইনি ব্যবস্থা বা এরকম কোনও সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। শ্রমিকরা যদি অভিযোগ করে তাহলে উভয়পক্ষকে ডেকে সমঝোতার করার চেষ্টা করবো।
সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন
কা/আ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত