ভোটের খরায় লৌহজংয়ে প্লাবন- মহিউদ্দিন খান মোহন

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:৫২ |  আপডেট  : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১২

২১ মে ছিল বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার নির্বাচন। একই দলের দুই জাঁদরেল প্রার্থীর মধ্যে ভোটের লড়াইটা কেমন হয়, তা দেখার একটি ঔৎসুক্য ছিল। লৌহজং উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ শিকদার (কাপ পিরিচ) এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বি এম শোয়েব (দোয়াত কলম) ছিলেন মূল প্রতিদ্বন্দী। বিত্তশালী এই দুই স্থানীয় রাজনীতিকের প্রতিদ্বন্দীতা ছিল গত কয়েক মাসের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নেতাকর্মীরা স্বভাবতই দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুই প্রার্থীই বিস্তর টাকা খরচ করেছেন। কারও কারও মতে নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের নির্বাচনী খরচের যে সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে, উভয় প্রার্থীর খরচের অংক তার একশ গুণ ছাড়িয়ে গেছে। বলে নেওয়া দরকার, লৌহজং আমাদের পাশ্ববর্তী উপজেলা।

সকাল সকাল রওয়ানা হয়ে সাড়ে নয়টায় পৌঁছে গেলাম উপজেলার কুমারভোগ গ্রামে। আমি সহযাত্রী হয়েছিলাম বিশিষ্ট সমাজসেবী মাহবুবুল হোসেন (বাহন) সাহেবের। ওই গ্রামেই তার বাড়ি। সাথে ছিলেন তার এক বন্ধু সাতক্ষীরার সাবেক বিএনপি নেতা আবদুল কাদের। একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম কুমারভোগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ধরেই নিয়েছিলাম, কেন্দ্র ফাঁকা দেখব। অথবা দু’চার দশজন ভোটারকে দেখা যাবে। কিন্তু আমার ধারণা ছিল ভুল। ভোটকেন্দ্রে শত শত লোকের উপস্থিতিতে জমজমাট অবস্থা। বুথের সামনে নারী- পুরুষের লম্বা লাইন। তখন সকাল দশটার মতো। ভোটাররা দলে দলে আসছে, প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে স্লিপ নিচ্ছে, তারপর লাইনে দাঁড়াচ্ছে ভোট দেওয়ার জন্য। দুই প্রতিদ্বন্দী চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রতীক সম্বলিত ব্যাজ গলায় ঝোলানো কর্মীরা ব্যস্ত ভোটারদের সেবা দিতে। কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশা শুধু ভোটারদের আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত। আক্ষরিক অর্থেই একটি উৎসবমুখর পরিবেশ। ভোটকেন্দ্রের বাইরে দেখা হলো বন্ধু নজরুল ইসলাম হান্নানসহ অনেকের সাথে। বিএনপির অনেক স্থানীয় কর্মীও ছিলেন তাদের মধ্যে। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের দল তো নির্বাচন বর্জন করেছে, তোমরা ভোট দিতে এলে কেন? উত্তরে তারা বলল, একই ওষুধ সব রোগে চলে না। এটা স্থানীয় নির্বাচন। আমরা গ্রামে থাকি। বিপদে-আপদে, নানা প্রয়োজনে স্থানীয় নেতাদের কাছে যেতে হয়। আজ নির্বাচন বর্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে ভোট দেব না, কাল আমার দরকারে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াব? তিনি যদি তখন বলেন, তুমি তো ভোটই দেও নাই, আমাকে তো তুমি চেয়ারম্যান বলে স্বীকারই করো না, তখন কী জবাব দেব? নামটি প্রকাশ না করতে বারবার অনুরোধ করে স্থানীয় ওই বিএনপি কর্মী বললেন, এই যে এখানে যত মহিলা-পুরুষ ভোটার দেখছেন, তাদের প্রায় অর্ধেক বিএনপি সমর্থক। এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে রশিদ সাহেব বা শোয়েব সাহেবের সঙ্গে সম্পর্কিত। কেউ আত্মীয়তা সূত্রে, কেউ বন্ধুত্বের সূত্রে, আবার কেউ সামাজিক সম্পর্কে। এখানে রাজনীতি বড় কথা নয়, সামাজিক সম্পর্কটাই প্রধান। খবর নিয়ে জানলাম, সবখানেই ভোটাররা আনন্দঘন পরিবেশে ভোট দিতে জড়ো হচ্ছে। উপস্থিত লোকদের ধারণা ৫০-৫৫ শতাংশ ভোট পড়তে পারে এই উপজেলায়। 

পরদিন (২২ মে) বন্ধু অলক কুমার মিত্র জানালো, বি এম শোয়েব ৫৬ হাজার ৪৬৭ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী আবদুর রশিদ শিকদার পেয়েছেন ২০ হাজার ৮১৪ ভোট। আর ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ। ভোটের চলতি খরায় লৌহজং উপজেলা নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ ভোট কাস্ট হওয়াকে প্লাবন বলা অযৌক্তিক হবে না। সন্দেহের অবকাশ নেই, বিএনপির বিপুল সংখ্যক কর্মী- সমর্থক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করে ভোটে অংশ নেওয়ায় এটা ঘটেছে। লৌহজং উপজেলায় ভোটারদের এই স্বতঃস্ফুর্ত ভোট প্রদান বাংলাদেশের মানুষের ভোটের প্রতি আগ্রহেরই প্রতিফলন। 

আমার লেখা যাঁরা পড়েন তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, গোড়া থেকেই আমি বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আসছি। দর কষাকষি করে ন্যুনতম দাবি আদায় করে হলেও বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত- একথা আমি অনেকবার বলেছি। তবে আমার মতো মানুষদের বলা না বলায় এখন এ দলটির কিছু আসে যায় না। আমার এক সময়ের দল বিএনপিতে এখন অনেক ‘পন্ডিত, মহাপন্ডিতের ছড়াছড়ি। তারা হয়তো ভাবছেন বর্জন থেকেই তা বিশাল কিছু অর্জন করবেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, নির্বাচন বর্জন করে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলই কখনও সুফল অর্জন করতে পারেনি। বরং তারা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে। বিএনপি এখন নির্বাচন বর্জনকে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করে নিজেদের অস্তিত্বকেই বিসর্জন দিতে বসেছে, এমনটি মনে করেন রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা। নির্বাচন বর্জনের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত তাদেরকে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির মূল স্রোত থেকে নির্বাসিত করে ফেলতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে।

বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে নির্বাচনের যে স্বাভাবিক চিত্র দেখা গেছে, দেশের অন্যান্য এলাকার চিত্র সেরকম ছিল না। ২২ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বেড়েছে অনিয়ম-সংঘর্ষ, কমেছে ভোটের হার’। খবরে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলার নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৩০ শতাংশের কিছু বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। প্রথম ধাপের নির্বাচনে এ হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন শান্তিপূর্ণও থাকেনি। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, গণসিল মারা, বুথ দখলসহ নানা অনিয়ম সংঘঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে।

কক্সবাজারে একজন নিহত হয়েছে। অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোটারশূন্য ছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে অলস সময় কাটাতে। মোট কথা নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। কোথাও কোথাও উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও বেশিরভাগ এলাকায় ছিল একধরনের বিষন্নতা। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির অনুপস্থিতিই এর প্রধান কারণ। বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই বলবান প্রার্থী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন বলে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ ও অর্থবহ হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না। তাই লৌহজংকে দিয়ে সমগ্র দেশের উপজেলা নির্বাচনকে বিচার করা সমীচীন হবে না। দুই বা ততোধিক প্রার্থীর সরব অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে যেমন অর্থবহ নির্বাচন হয়না, তেমনি গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে সরকার ও বিরোধী দলের সমান ভূমিকা অপরিহার্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে গণতন্ত্র হোচট খায়, কখনও বা হয় বিপর্যস্ত।

 

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক, মহিউদ্দিন খান মোহন

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত