ভারতে কোভিডের তৃতীয় টেউয়ের শঙ্কা, টিকা নিয়েও উদ্বেগ!
প্রকাশ: ৬ জুন ২০২১, ০৮:৩০ | আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২১
কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারির মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের প্রায় ‘নিষ্ফলা’ যুক্তরাষ্ট্র সফর ভারতকে চিন্তায় রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে সার্বিক টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি আদৌ পালিত হবে কি না, সে বিষয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এরই মধ্যে প্রতীক্ষা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের। টিকা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত ‘এক দেশ এক নীতি’র নিদান দিলে সরকারের কাছে সেটা হয়ে দাঁড়াবে বাড়তি চাপ। এই দুশ্চিন্তার মধ্যে সামান্য স্বস্তি এনে দিয়েছে কোভিড প্রতিষেধকের কাঁচামাল জোগানোর ক্ষেত্রে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের আশ্বাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার নিশ্চিত নয়, বছর শেষে ঠিক কত শতাংশ দেশবাসীকে কোভিডের টিকা দেওয়া যাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের যুক্তরাষ্ট্র সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল টিকার জোগান বৃদ্ধি। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আপাতত যা দিচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা বিন্দুতে সিন্ধুসম। মোট ৮ কোটি ডোজের মধ্যে প্রথম দফায় যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে আড়াই কোটি। এর মধ্যে ৭০ লাখ ভাগাভাগি করা হবে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্তত ১৬টি দেশের মধ্যে। ভারতের ভাগে যা পড়বে, তাতে কোনো এক বড় শহরের এক দিনের প্রয়োজনও মিটবে না।
টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে মাঝারি ও নিম্ন আয়ের দেশের প্রতি বেশি যত্নবান, তা জানিয়েছেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তা ও ‘গ্লোবাল কোভিড রেসপন্স টিমের’ কো-অর্ডিনেটর গেইল স্মিথ। এর ফলে জয়শঙ্করের সফর যে প্রায় ‘নিষ্ফলা’ সেই চর্চা সাউথ ব্লকে শুরু হয়েছে। যদিও কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া কমলা হ্যারিসের আশ্বাস। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের কথায়, কাঁচামালের জোগানে দেশজ টিকা উৎপাদনে গতি আসবে। সেরাম ইনস্টিটিউটের কর্ণধার আদর পুনাওয়ালাও এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
জয়শঙ্করের সফরের পর ভারত সরকারের চিন্তা বেড়েছে প্রধানত দুটি কারণে। প্রথম কারণ কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি। বিশেষজ্ঞ বিনোদ পল সতর্ক করে জানিয়েছেন, গণটিকাকরণ শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা চলে আসতে পারে। সেই সংক্রমণের চরিত্র কেমন হবে, তার আগাম আন্দাজ এখনো করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় তরঙ্গে ত্রাহি ত্রাহি ফেলে দিয়েছে ডেল্টা স্ট্রেইন, যার পোশাকি নাম ‘বি.১.৬১৭.২’। ভারতের সম্ভাব্য তৃতীয় তরঙ্গে সেই ভাইরাস কোন আকার ধারণ করবে, তা এখনো অজানা। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’সহ প্রায় সবার অভিমত, গণটিকাকরণ ছাড়া তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলা অসম্ভব। টিকার ওপর জোর দেওয়ার কারণ দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস’-এর সমীক্ষা। তাতে দেখা গেছে, টিকা নেওয়া মানুষজনের পক্ষে কোভিডের মোকাবিলা করা সহজতর হয়েছে। মৃত্যুহারও এই মানুষদের মধ্যে কম।
সরকারের দ্বিতীয় চিন্তা টিকা নিয়ে আগাম ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। মে মাসের ৩০ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুন মাসে দেশের ১২ কোটি টিকার জোগান নিশ্চিত হবে এবং ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। প্রশ্ন উঠেছে এই বাড়াবাড়ি রকমের আশাব্যঞ্জক ঘোষণাকে কেন্দ্র করে।
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক আর রামকুমার তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, যেভাবে চলছে, তাতে কোনোভাবেই এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এই আশঙ্কা সত্য হলে সেটা হবে দেশের নাগরিকের প্রতি সরকারের আরও এক মিথ্যাচার।
কেন সম্ভব নয়, সেই হিসাব দাখিল করে রামকুমার দেখিয়েছেন, মে মাস পর্যন্ত সেরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেক প্রস্তুত করেছে মোট ৫ কোটি ৯৮ লাখ ডোজ টিকা। অথচ তাদের উৎপাদনক্ষমতা ছিল সাড়ে ৮ কোটির। এক মাসে কী করে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে, সবকিছু যখন একই রকম রয়েছে? ‘স্পুতনিক-ভি’ ভারতে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু এখনো তার আমদানি শুরু হয়নি। বড় আকারে রাশিয়ার এই টিকা দেশে আমদানি করা হবে আগস্ট মাস থেকে। ‘কোভ্যাক্সিন’ তৈরির অনুমতি পেয়েছে তিনটি নতুন সংস্থা। কিন্তু নভেম্বর ও ডিসেম্বরের আগে তাদের উৎপাদন শুরু করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে কী করে সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে? অধ্যাপক রামকুমারের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর সরকারের কাছে নেই।
নেই বলেই রাহুল গান্ধীসহ বিরোধী নেতারা সরকারের আরও এক ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতির’ সমালোচনা করেছেন। চলতি মাসের শেষে সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্রকে টিকাসংক্রান্ত যাবতীয় হিসাব দাখিল করতে বলেছেন। তাতেও বোঝা যাবে সরকারের ঘোষণা ও বাস্তবের ফারাক কতখানি। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত মাত্র ১২ শতাংশ ভারতীয় একটি ডোজ টিকা পেয়েছেন। দুটি ডোজ পেয়েছেন ৩ শতাংশের মতো। তুলনায় ব্রিটেনে প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন ৫৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ ও জার্মানিতে ৪৩ শতাংশ মানুষ।
যে গতিতে টিকাকরণের কাজ চলছে, আগামী দিনে তাতে অবশ্যই গতি আসবে। সেরাম ইনস্টিটিউট আমেরিকার ‘নোভোভ্যাক্স’-এর উৎপাদন শুরু করবে ‘কোভোভ্যাক্স’ নাম দিয়ে। পুনের অন্য এক সংস্থা জেন্নোভা বায়োফার্মাসিউটিক্যালস ‘এইচজিসি০১৯’ নামে এক টিকা তৈরি করেছে, যার ট্রায়াল এখনো চলছে। গুজরাটের জাইডাস ক্যাডিলা তৈরি করেছে ‘জাইকভ ডি’ নামের এক টিকা।
হায়দরাবাদের বায়োলজিক্যাল ই সংস্থা তৈরি করেছে তিনটি টিকা। ‘কোর্বেভ্যাক্স’ ‘পিটিএস-কোভিড১৯বি’ ও জনসন অ্যান্ড জনসনের ‘জ্যানসেন’। এতে অবশ্যই বছর শেষে টিকার উৎপাদন ও জোগান বাড়বে। কিন্তু কোনোভাবেই ২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয় বলে রামকুমারের ধারণা। তাঁর মতে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের টিকা দিতে গেলে ২০২৬ সাল পেরিয়ে যাবে।
দরিদ্রদের জন্য টিকা বিনা পয়সায় দিতে না পারলে সংক্রমণের আশঙ্কাও কমবে না। তবু কেন সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবাইকে টিকা দেওয়ার কথা জানাল? রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, আগামী বছরের গোড়ায় উত্তর প্রদেশের ভোটের দিকে তাকিয়েই এই প্রতিশ্রুতি, যে রাজ্যে শাসক বিজেপির আসন এই মুহূর্তে যথেষ্ট টলমল।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত