ভারতমাতা চিত্রের নির্মাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশ: ৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৩৫ | আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৮
ইউরোপীয় ইতিহাসে নবজাগরণের মতো ভারতীয় ইতিহাসে নবজাগরণ ঘটেছিল। ইউরোপের ইতিহাস কে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন অর্থনীতিবীদ, বিভিন্ন চিত্রকরের প্রকাশিত হওয়া বই ও বিভিন্ন ছবিকে ঘিরে নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল। ঠিক একই রকম ভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও চিত্র ভারতীয়দের একতাবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল। এই সকল চিত্রের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি চিত্র ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতা চিত্র টি। ভারতমাতা চিত্র টির মধ্যে ছিল সমস্ত ভারতের বৈশিষ্ট্য, যেমন চিত্রটিতে ভারত মাতার চার হাতে রয়েছে বেদ, ধানের শীস, জপের মালা ও শ্বেত বস্ত্র পরিধান। চিত্রটিতে এই রূপের কারণে খুব সহজেই ভারতবাসীদের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই আগস্ট, ১৮৭১- ৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫১) একজন খ্যাতিমান ভারতীয় বাঙালি চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র হলেন অবনীন্দ্রনাথ। পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়; এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অফ লিটারেচার ডিগ্রি প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্যরূপে দায়িত্ব পালন করেন। ৮৯৭ সালে আঁকলেন শুক্লাভিসার- রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ণ কবি গোবিন্দ দাসের পঙ্ক্তিমালা, যা ছিল পাশ্চাত্য নিয়মের সাথে ভারতীয় রীতির নবতর সংশ্লেষণ; যোজন-বিয়োজন। ১৯০০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরো দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের ছবি শিল্পরসিকদের মাঝে আগ্রহের জন্ম দেয়। তার শাজাহানের অন্তিমকাল মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা,যেখানে শাজাহানের অন্তিম সারবত্তা করুণ রসের। ক্রমান্বয়ে আকঁলেন বুদ্ধ ও সুজাতা [১৯০১], কালীদাসের ঋতুসঙ্ঘার বিষয়ক চিত্রকলা [১৯০১], চতুর্ভুজা ভারতমাতা[১৯০৫], কচদেবযানি [১৯০৬], শেষযাত্রা [১৯১৪]। জাপানি প্রভাবে অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওমর খৈয়াম [১৯৩০]চিত্রাবলি। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন কুটুম কাটাম – আকারনিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অণুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত। কবিগুরু ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র কর্মসুচী শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন,
ছোটদের পড়বার মত বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।
‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র প্রথম ও তৃতীয় বই অবনীন্দ্রনাথের শকুন্তলা ও ক্ষীরেরপুতুল। অবনীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নবযুগ’পত্রে ১৩১১ শ্রাবণে, ‘নবদুর্ব্বা’ নামে। রানী বাগেশ্বরী অধ্যাপক থাকার সময় ১৯২১-১৯২৯ সালের মধ্যে যে ঊনত্রিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪১ সালে ‘বাগেশ্বরীশিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।বাংলা ভাষায় লিখিত ভারতীয় নন্দন তত্ত্বের একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে যা বিবেচিত হয়। চিত্রকলায় ধারাবাহিকতায় লেখালেখির জগতেও আপন ঐতিহ্যের অনুরাগী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।তিনি বেশ কিছু যাত্রাপালা ও পুথি রচনা করেন। যার মধ্যে ‘অরণ্যকান্ত পালা’কঞ্জুশের পালা,কাক ও পানির পালা,ঋষিযাত্রা,মারুতির পুথী,চাইবুড়োর পুথি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৫১ সালে ৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত