বিভূতি বাবুর প্রথম উপন্যাস ছাপা হওয়ার গল্প
প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৩৫ | আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৫১
ভাগলপুরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি। ঐ জায়গাটার নাম বাঙালীটোলা। শরৎবাবুর মামা ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওকালতি পড়ে, ভাগলপুরে গিয়ে ওকালতি পেশা শুরু করেছেন। ওকালতির পাশাপাশি উনি সন্ধ্যা বেলায় সাহিত্য আড্ডা বসাতেন। সেখানে একটি অপরিচিত বাঙালী যুবক এসে চুপচাপ বসে থাকতো। পরনে গোড়ালি ছুঁই ছুঁই ধুতি, ইস্ত্রীবিহীন নিজ হাতে কাচা মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবী। একহাতে লাঠি, আরেক হাতে লণ্ঠন। প্রতিদিন আসতো, আর আড্ডায় পিছনে বসে চুপচাপ থেকে চলে যেতো। এইভাবে বর্ষা থেকে বসন্ত চলে গিয়ে গ্রীষ্ম চলে এল। কোর্ট বন্ধ। উপেন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখছেন আর সন্ধ্যায় আড্ডার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। চারদিক কালো করে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় আসছে, উপেন্দ্রনাথের মন খারাপ।
আজ আর আড্ডায় কেউ আসবে না। ঝড়ের দাপট কিছু কম, দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময় দেখলেন দূরে লণ্ঠন জ্বালিয়ে একজন আসছে। যাহোক, একজন তো আসছে। কিছুক্ষণ পরেই মানুষটি কাছে আসা মাত্র উপেন্দ্রনাথ দমে গেলেন। যে মানুষটি এসেছে, তাকে গত পাঁচ ছয় মাস যাবৎ দেখছেন বটে, কিন্তু সে গম্ভীর ও লাজুক স্বভাবের। এর সাথে সাহিত্য আলোচনা কি হবে, রঙ্গরস তো ছেড়েই দিলেন।
উপেন বাবুর স্বভাব হচ্ছে মানুষের মধ্যে উপন্যাসের চরিত্র খোঁজা, তাই ভাবলেন এই মানুষটির মাঝেও এমন কোন ঘটনা আছে, যা পরে উপন্যাসে কাজে লাগবে। তাই, উনি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
ঘরে ঢুকেই মানুষটি হাতের লাঠি ও লণ্ঠন দেওয়ালের এক কোণে রেখে নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় বসলেন। উপেন্দ্রনাথ বললেন- আহা! অত দূরে কেন কাছে এসে বসুন। মানুষটি বললো, না, আর কেউ যদি আসে। আরে, না এই ঝড় বৃষ্টি দিয়ে আর কেউ আসবে না। কাছে এসে বসুন।
উপেন বাবু জিজ্ঞেস করলেন- আমাদের আড্ডায় আপনি রোজ আসেন, নাম জানা হলো না। অবশ্য এই আড্ডার তো পরিচয়ের দরকার হয় না। মুখচেনা হলেই চিরচেনা। তা-আপনার নামটি জানতে পারি।
-আজ্ঞে, আমার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
- এখানে কি করা হয়?
- কলকাতা থেকে এখানে এসেছি চাকরী নিয়ে।
- কলকাতা থেকে চাকরি নিয়ে এসেছেন ভাগলপুরে! কলকাতায় কিছু জুটলো না।
- আজ্ঞে, মাস্টারি একটা জুটেছিল, কিন্তু পোষালো না। তাই খেলাত ঘোষদের জমিদারীর সেরেস্তায় নায়েবের চাকরি নিয়ে এসেছি।
- খেলাত ঘোষদের জমিদারী! এখান থেকে তো চার পাঁচ মাইল দূরে। পথে আবার ঘন বন জঙ্গল আছে। সেখান থেকে এত পথ ভেঙে আসেন। বনে তো হিংস্র জন্তু আছে, আছে সাপখোপ। আপনার ভয় করে না?
বিভূতি বাবু সলজ্জ হাসি দিয়ে বললেন - না, ভয় পাওয়ার কি আছে, জন্তু জানোয়ার থাকলেই বা কি। ওদের আক্রমণ না করলে, ওরাও আক্রমণ করে না।
আর তাছাড়া জঙ্গলের একটি মোহ আছে, মায়া আছে যা আমাকে আকর্ষণ করে। আর সাপখোপের কথা বলছেন, ঐ লাঠি আছে না।
উপেন বাবু মনে মনে খুশী হলেন, ওনার মনের মত মানুষ পেয়ে।
জিগ্যেস করলেন - আপনি আড্ডায় রোজ আসেন, চুপচাপ থাকেন। কেন আসেন, কিসের টানে?
বিভূতি বাবু - কিসের টানে! কলকাতায় থাকতে আপনাদের বাঙালীটোলার আড্ডার কথা শুনেছি। আর এখানে শরৎ বাবু বড় হয়েছেন, আড্ডা জমিয়েছেন। এখানে অনুরূপা দেবী, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আড্ডা জমিয়েছেন। এটা তো আমার জন্য তীর্থক্ষেত্র। তার উপর আছেন আপনি।
উপেনবাবু বুঝলেন, মানুষটির ভিতরে ভিতরে একটি শৈল্পিক মন আছে।
উপেনবাবু আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করলেন- আপনার গোপনে আবার সাহিত্যচর্চা আছে না কি?
বিভূতি বাবু একটু লজ্জিত হয়ে বললেন- না না, তেমন না, একটু আধটু।
উপেনবাবু - আহা! লজ্জা কি, বলে ফেলুন। যখন অরণ্যের নির্জনতায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন দুই একটি কবিতা অবশ্যই লিখেছেন।
বিভূতি বাবু - যদি অভয় দেন, সাহস পেলে বলি।
উপেনবাবু -বের করুন, বের করুন। আমার কাছে অনেকেই আসে বুক পকেটে কবিতা নিয়ে কারেক্ট করানোর জন্য। আপনার কবিতা বের করুন। আমি পড়ে দেখতে চাই।
বিভূতি বাবু - আজ্ঞে কবিতা না, উপন্যাস।
উপেন বাবু - উপন্যাস লিখেছেন! আ-আপনি। একেবারে হাতে খড়ি না হতেই।
বিভূতি বাবু - হাতে খড়ি!
উপেনবাবু - আলবত, হাতেখড়ি। আপনার কোন লেখা কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে? গল্প, কবিতা? নিদেনপক্ষে প্ৰবন্ধ।
বিভূতি বাবু - না।
উপেন বাবু - আপনার কোন লেখাই ছাপা হলো না, আর আপনি লিখে ফেলছেন উপন্যাস। এই আমার কথাই ধরুন। প্ৰথম কবিতা দিয়ে শুরু। শুধু আমি কেন, বঙ্কিমবাবু পর্যন্ত কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন, ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকরে ছাপা হয়েছিলো। রবীন্দ্র নাথের কথা নাই বললাম। আমার ভাগনে শরৎ পর্যন্ত কবিতা দিয়ে শুরু করেছিল।
বিভূতি বাবু - শরৎ বাবু কবিতা লিখতেন! জানতাম না তো।
উপেনবাবু - শরৎচন্দ্র কবিতা লিখতো, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমাদের কিশোরবেলায় একটি পত্রিকা বের করতাম, সেখানে লিখেছিল।
তাই বলছিলাম, দুই একটি কবিতা লিখে এদিক সেদিক ছাপিয়ে নামটি একটু পরিচিত করে উপন্যাসে হাত দিলে ভালো হতো না।
বিভূতি বাবু - আসলে অনেকদিন থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম। আমার দেশের গ্রাম, প্রকৃতি নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে। গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করতাম, হাতে সময় ছিলো। তাই, লিখে ফেলছি।
উপেনবাবু - তা বেশ করেছেন। একা একা থাকেন, সময় কাটাতে হবে তো। তা লিখলেই হবে না। নিয়ম-কানুন বজায় রাখতে হবে তো, সেগুলো রেখেছেন। কত বড় উপন্যাস?
বিভূতি বাবু - তা একটু বড়। আমার হাতে লেখা ছোট, সেই লেখায়ই চারশো পাতা।
উপেনবাবু - তাতো হবেই, একা একা আছেন। পাতার পর পাতা, দিস্তার পর দিস্তা, রিমের পর রিম লেখা ছাড়া আর কাজ কি? তা, আপনার উপন্যাসে পরিচ্ছেদ আছে তো?
বিভূতি বাবু - আছে।
উপেন বাবু - অঙ্ক মিলিয়েছেন তো?
বিভূতি বাবু - অঙ্ক!
উপেন বাবু - হ্যাঁ অঙ্ক। ম্যাথমেটিকস। প্রথম পরিচ্ছেদে যত শব্দ থাকবে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তত শব্দ। এইভাবে সব পরিচ্ছেদে একই সংখ্যার শব্দ থাকবে। গুনে দেখেছেন?
বিভূতি বাবু - আজ্ঞে গুনে দেখি নাই।
উপেনবাবু - আজ ছয়মাসের উপর আমার এখানে আসা-যাওয়া করছেন, একবারটি মুখ ফুটে কিছু বললেন না। এখন সব পন্ডশ্রম। কবিতার যেমন যতি, ছন্দ মিল থাকা চাই। উপন্যাসেরও তেমনই। নাহলে, উপন্যাস বেসামাল হয়ে যায়।
বিভূতি বাবু - এখন উপায়?
উপেন বাবু - উপায় একটি আছে, আজ রাতে যেয়েই শব্দ গুনে ফেলবেন।
বিভূতি বাবু মন খারাপ করে ফেললো, এত যত্নের উপন্যাস এখন সংখ্যার কারণে বাতিল হচ্ছে।
উপেন বাবু দেখে বুঝলেন। বিভূতি বাবুর পিঠে হাত দিয়ে বললেন, আরে ভেঙে পরার কিছু নেই। আমি আছি তো। আমি সব ঠিক করে দেবো। আপনি কাল উপন্যাসটি নিয়ে আসবেন। একটু আগে আগে আসবেন আর আসার সময় আপনার উপন্যাসটি নিয়ে আসবেন।
বিভূতি বাবু বললেন, ঠিক আছে। এই বলে ম্যাচ জ্বালিয়ে লন্ঠন ধরালেন, লাঠি হাতে তারপর ঘর থেকে বারান্দায় নেমে এলেন। উপেন বাবু, বিভূতি বাবু কে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বারান্দায় নেমে এলেন। অন্ধকার রাত, বিভূতি বাবু হেঁটে যাচ্ছেন উপেনবাবু পিছন থেকে তাকিয়ে আছেন। লণ্ঠনের টিমটিমে আলো দূরে সরে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। কিন্তু, কে জানে এই লণ্ঠনের আলো জ্যোতি হয়ে বাংলার সাহিত্যের আকাশে আলোকিত করবে, আর লণ্ঠনের মানুষটি তারা হয়ে ইতিহাসে জায়গা নেবেন।
সেদিন রাতে বিভূতি বাবুর ঘুম নেই, শুধু পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ গুনছেন। কোন পরিচ্ছেদে এক হাজার শব্দ, কোন পরিচ্ছেদে পনেরসো, কোন পরিচ্ছেদে দুই হাজার শব্দ।
পরের দিন, বিভূতি বাবু আগেই চলে গেছেন। উপেনবাবু খাতা উল্টে পাল্টে দেখলেন, দেখে বললেন। যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই। পরিচ্ছেদের মধ্যে তো শব্দ সংখ্যার মিল নেই। ভালোমতো গুনে দেখেছেন তো?
বিভূতি বাবু বললেন, গুনে দেখেছি আগাগোড়াই ভুল।
উপেনবাবু কিছু একটি ভাবলেন, কি জানি বলতে যেয়েও বললেন না। আড্ডার অন্যান্য সদস্যরা এসে যাচ্ছে। তাই শুধু বললেন, আমার কাছে রেখে যান। আমি একটু পড়ে দেখি। এই বলে, খাতাটি ড্রয়ারে রাখলেন।
দিন আসে, দিন যায়। উপেনবাবু সেই পাণ্ডুলিপির কথা কিছু বলেন না, বিভূতি বাবুও কিছু জিগ্যেস করে না। এইভাবে মাসদুয়েক যাওয়ার পর। একদিন উপেনবাবু বললেন, বিভূতি বাবু আপনি একটু পরে যান কথা আছে। বিভূতি বাবুর মন সংশয়ে দোলা দিয়ে উঠলো, কি বলে উপেনবাবু। উপেনবাবু খাতাটি বের করলেন।
বললেন-আমি আগাগোড়া পড়েছি। আপনার হবে। হবে কেন বলছি, আপনার হয়েছে।
বিভূতি বাবু বললেন- কিন্তু অঙ্ক।
উপেনবাবু - অঙ্কে ভুল আছে। সেটা সমস্যা না। আমি কাটছাঁট করে ঠিক করে দেবো। আর সব লেখা কি অঙ্কে বিচার করা কি ঠিক, না কি বিচারে আসে? ব্যতিক্রম তো হতেই পারে। আচ্ছা, আপনি কোথাও ছাপানোর কথা ভেবেছেন কি?
বিভূতি বাবু মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- কলকাতার প্রভাতী পত্রিকায় দিয়েছিলাম। এখানে আসার আগে খবর নিতে যেতে ফেরত পেলাম।
গুম হয়ে গেলেন উপেনবাবু। মজলিশী মেজাজের হাসিখুশী উপেন চুপ হয়ে গেলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন - বিভূতি বাবু ভাববেন না, আপনার উপন্যাস আমি ছাপানোর ব্যবস্থা করবো। ধরে নেন, এই উপন্যাস আপনার একটি মাত্র সন্তান। তাকে আমিই আজ থেকে দায়িত্ব নিলাম। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান।
বিভূতি বাবুর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো। ধুলো মাখা কোচর দিয়ে চোখের কোন মুছে বললো- লেখা ছাপা হোক আর না হোক,মনে আমার আর কোন খেদ নেই।
আরও মাস দুই পার হওয়ার পর একদিন উপেনবাবু নিভৃতে বিভূতি বাবুকে বললেন - আমি আবার কলকাতায় চলে যাচ্ছি। এই জায়গার আড্ডার কাউকে বলবেন না, বাগড়া দেবে।
বিভূতি বাবু অবাক হয়ে গেলেন।
উপেনবাবু বললেন - অবাক হচ্ছেন তো, শুনুন আমি পত্রিকা বের করছি।
বিভূতি বাবু বললেন- সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।
উপেন বাবু হেসে বললেন - সেটা আমার জামাইয়ের ব্যাপার। তার অনেক টাকা। ভুলিয়ে ভালিয়ে তো এই লাইনে নামিয়েছি। এখন শুধু রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্র কে একসঙ্গে নামাতে পারলে কেল্লাফতে। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, আমি আপনার উপন্যাস ছাপব।
সত্যি সত্যি উপেনবাবু কলকাতায় চলে গেলেন, তারপর বাংলার সাহিত্য জগতে ধূমকেতুর মত আবিভার্ব হলো বিচিত্রা পত্রিকা। টালা থেকে টালিগঞ্জ পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেলো।
ওদিকে ভাগলপুরে নির্জনে বসে বিভূতি বাবু আশা নিয়ে মাস পার করছেন, কিন্তু পত্রিকা আর বের হয় না। সাহস করে চিঠি লেখেন না, পাছে উপেনবাবু বিরক্ত হন।
ধৈর্য্যর একটা সহ্যশক্তির সীমা আছে।
কি একটা উপলক্ষে বিভূতি বাবুর কিছুদিন ছুটি থাকায়, উনি কলকাতা যাওয়া স্থির করলেন।
ঝামা পুকুর লেনের একটি অফিসে সোফায় বসে জনা পাঁচেক সুটেট বুটেট ভদ্রলোক মুখে দামী সিগারেট, জোর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছে। পাশেই ধুতি পাঞ্জাবী পরা একটি যুবক নিবিষ্ট মনে প্রুফ দেখছে, আড্ডায় মন নেই। যুবকটি পরবর্তীতে বেদ উপন্যাস লেখা ও কল্লোল পত্রিকার সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।
এমন সময় দরজার ওপাশে একজন ভদ্রলোক উঁকি মারতেই পাঁচ জোড়া চোখ সেই আগুন্তুক ভদ্রলোকের উপর পড়লো। এত বাঙালী সাহেব সুবো দেখে আগুন্তক ঘাবড়ে গিয়ে দরজার ওপারেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আর ঢুকলেন না। পরনে আধময়লা ধুতি হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, গায়ে পাঞ্জাবী, কয়েক জায়গায় রিপু কর্ম করা। পায়ে এক জোড়া চটি ব্রাউন না ব্ল্যাক, কলকাতার ধুলোতে বুঝার উপায় নেই, হাতে চটের থলি।
ঘর থেকে একজন তাচ্ছিল্যভাব নিয়ে জিগ্যেস করলো, কি চান এখানে? আপনি কি এজেন্ট? কোথাকার এজেন্ট? দশ কপির বেশী দিতে পারবো না। ভয়ানক ডিমান্ড। যান, ওই কোনের ভদ্রলোকের কাছে টাকা জমা দিন।
আগুন্তক বললেন, না, আমি এজেন্ট না।
ঘর থেকে আবার বললো- তবে কি লেখক? কবিতা লিখেছেন? যান, ওই কোনের ভদ্রলোকের কাছে নাম ঠিকানাসহ জমা দিয়ে যান।
আগুন্তক বললেন- আমি লেখকও নই, কবিতাও দিতে আসি নাই। আমি একটু পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করবো।
আবার উত্তর এলো- ও, উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর সাথে দেখা করবেন, উনি এখনও আসেননি। দেরী হবে। আপনার যা বলার ঐ কোনের ভদ্রলোক কে বলে যান। এই বলে, আবার আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলো।
আগুন্তক ভাবছে, চলে যাবে কি যাবে না। এমন সময় উপেনবাবু এসে হাজির। আর এসেই আগুন্তক কে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, এবং বললেন - আরে
বিভূতি বাবু, কবে এলেন কলকাতায়?
বিভূতি বাবু বললেন- আজ সকালে এসেছি, সন্ধ্যার গাড়ীতে গ্রামে ফিরে যাবো। তাই একটু দেখা করতে এলাম।
উপেন বাবু বিভূতি বাবুকে ঘরে নিয়ে বসাতে চাইলেন আড্ডায় মশগুল সাহিত্যিক আলোচকদের মাঝে। বিভূতি বাবু বসলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। উপেনবাবু বললেন- এসেছেন ভালো করেছেন। আগামী সপ্তাহে থেকে আপনার উপন্যাস ছাপা শুরু হবে।
আড্ডার ব্যক্তিরা হতবাক হয়ে বিভূতি বাবুর দিকে চেয়ে রইলো, একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বিভূতি বাবু এক মুহূর্ত থমকে রইলেন। তারপরই এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। আনন্দে কলকাতার রাস্তায় ছুটতে থাকলেন।
বিভূতি বাবু অনেককেই বলেছেন- তোমাদের কলকাতা শহর আমার কোনদিনও ভালো লাগেনি। গ্রাম, প্রকৃতি আমার ভালো লাগে। শুধু ঐ একদিনই আমি কলকাতাকে ভালোবেসেছি। যেদিন উপেনবাবু বললেন আমার উপন্যাস ছাপা হবে পরের সপ্তাহ থেকে।
পরের সপ্তাহ থেকেই বিচিত্রা পত্রিকায় বের হওয়া শুরু হলো উপন্যাস। বাঙালী পাঠক পেলো এক কালজয়ী উপন্যাস। বাঙালী দর্শক পেলো এক কালজয়ী সিনেমা, যার পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সৃষ্টি হলো দুর্গা ও অপু, দুই সহোদর-সহোদরা।
হ্যাঁ, এই হলো `পথের পাঁচালি’ উপন্যাস। এই হলো সাহিত্যিক `বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ আত্মপ্রকাশ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত