বিদ্যুৎ গিলছে ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা

  ওসমান গনি

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ১১:৪৫ |  আপডেট  : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৫০

সারাদেশে চলছে বিদ্যুৎ এর লোডশেডিং ও সংকট। বিদ্যুৎ সংকটের কারনে সারাদেশের মানুষের মধ্যে চলছে হতাশা। রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে চলছে অর্থনৈতিক মন্দাভাব। জ্বালানি হতে শুরু করে সব জিনিসের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। য়ুদ্ধের এ প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী আলোচ্য বিষয় হলো বিদ্যুৎ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশকে শতভাগ বিদ্যুৎ এর আওতায় আনার ঘোষনা  দেশের অনেক জেলায় শতভাগ সফল হয়েছে।এই সফলতার মধ্যে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ খাতে চরম বিপর্যয়ের কারনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের বিদ্যুৎ এর অবস্থা আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে শতভাগ ভালো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেকটা কম। আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ ঘাটতির একটা প্রধান কারন সকলের চোখে দৃশ্যমান।  তাহলো ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। তিন চাকার এই রিক্সা আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিল কারখানা বন্ধ রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়ে থাকে বিকল্প পন্থায় চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা উৎপাদন চালানো হবে। এখন কথা হলো বিকল্প পন্থায় চালানো হবে ঠিক আছে তার উৎপাদন ব্যায় কতটুকু পরবে। যখন উৎপাদন ব্যায় বেড়ে যাবে তখন এর প্রভাব পরবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের উপর। যুদ্ধসহ নানাবিধ কারনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারনে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখম মানুষের মরি মরি অবস্থা।

বিদ্যুৎ এর কারনে যদি দেশের কল কারখানা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এখানে মানুষের মরন ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। তাই যেকোন মূল্যেই হউক বিদ্যুৎ এর উৎপাদন ঠিক রাখতে হবে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সকলকে দেশের জাতীয় স্বার্থে মিতব্যয়ী হতে হবে। আর ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা বন্ধ করে পায়ে চেপে চালানো প্যাডেল রিক্সা চালু করতে হবে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ২০ লাখের মতো ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করছে। ব্যাটারী চালিত সহজ বিধায় এব পরিবহনের বেশীর ভাগ চালক হলো শিশু। যাদের অধিকাংশের বয়স হলো ১৮ বছরের নীচে। তারা হলো শিশুশ্রমের আওতাভুক্ত। যা আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ। ব্যাটারী চালিত বিধায় তারা এসব পরিবহন অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যার কারনে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই মারা যাচ্ছে আবার অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গুত্ববরণ করছে।

রাজধানীর আহাম্মদবাগ এলাকার দারোগার বাড়ির মোড়ের গলিপথে বেশ কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ। এ রকম গ্যারেজের কমতি নেই পাশের মহল্লা থেকে শুরু করে মুগদাপাড়া, যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, বাসাবোসহ খিলগাঁও এলাকায়। এ অটোরিকশা কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে ব্যবসা করছে। মূলত লাভবান হচ্ছে ফাঁকেফাঁকে যারা এ ব্যবসা করছে। তারা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাটারি চার্জের জন্য বিদ্যুতের বিশেষ লাইন নামিয়ে  চার্জের ব্যবসা করছে।

সরকারীভাবে এসব পরিবহন কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছিল কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো,  যদি এসব যানবাহন নিষিদ্ধ হয় তবে কিভাবে এসব পরিবহন  উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন না হলে তো মানুষ কিনতো না। সাধারণ মানুষ কে ঠেকানোর আগে উৎপাদন ঠেকানো জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মহল। শুধু রাজধানী ঢাকা বলে কথা নয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়েও এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইকের ছড়াছড়ি। রাজপথ থেকে মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ এসব যানবাহন। অথচ এসব যানের সরকারি অনুমোদন নেই। সড়ক দুর্ঘটনার জন্যও তিন চাকার এসব যানবাহন বিশেষভাবে দায়ি বলছেন যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।

করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের ব্যবস্থা করাসহ নতুন করে আরও আট দফা সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

এই অবস্থায় দেশে বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক বন্ধ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরাসহ যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে কমপক্ষে ২০ লাখ এমন পরিবহন চলছে। যা ২০১৬ সালের ছিল ১০ লাখ। ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে চলছে এসব যান। বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, সারা দেশে দিনে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পেছনে।

২০১৬ সাল থেকে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনের ওপর গবেষণা করছেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান। তিনি জানান, দেশে প্রায় ২৯ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট।

 একটি ইজিবাইকে ৪/৫টি ব্যাটারী থাকে। ১২ ভোল্টের প্রতিটি ব্যাটারির জন্য ৮০০ থেকে এক হাজার ১০০ ওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।

এদিকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে মাসব্যাপী অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকবে। মূলত গ্যারেজগুলোকে টার্গেট করে অভিযান চালানোর কথা জানান তারা। পাশাপাশি রাস্তায় বসবে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সারা দেশে ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তাছাড়া ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন আমদানি ও বিক্রির উপরেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। এর আগে দেশে মোটরচালিত সব রিকশা থেকে ব্যাটারি ও অন্যান্য মেশিনারি যন্ত্রপাতি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।

সড়ক পরিবহন খাতে ব্যবস্থাপনা জোরদার করা এবং হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গত বছরের ২৩ জুন গঠিত টাস্কফোর্সের মিটিং শেষে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে মোটরচালিত, মেশিনচালিত, ইঞ্জিনচালিত কিংবা ব্যাটারিচালিত সব ধরনের যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৭ সালেও একবার উচ্চ আদালত সড়কে অনুমোদনহীন বা তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে।

দেশের জাতীয় স্বার্থে উন্নয়নের চলমান ধারাকে স্থিতিশীল রাখতে সারাদেশে একযোগে সরকারীভাবে ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন করা হয়েছিল সড়ক- মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সিএনজি বিরুদ্ধে। অটোরিকশা বন্ধ হলে বাচবে আমাদের বিদ্যুৎ আর নিপতিত হবে শিশুশ্রমের। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের অটোরিকশা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অটোরিকশা বন্ধ হলে ছোট ছোট শিশুরা যাদের বয়স ১৮ বছরের নীচে তারা মুক্তি পাবে কঠোর পরিশ্রম থেকে। তারা তখন শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করবে। দেশে শিক্ষার মান বাড়বে। ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা বন্ধ হলে আমাদের জাতীয় সম্পদ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, সড়কে দুর্ঘটনা কমবে, শিশুশ্রম কমবে, বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলে দেশের উৎপাদনমূখী কল কারখানা চলমান থাকবে। 

লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত