বিচার বিভাগের জন্য সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৪৫ |  আপডেট  : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৩

বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের স্বাক্ষরের পর রোববার (২৭ অক্টোবর) এই প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৭ সালে। ঐ বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। কিন্তু গত ১৭ বছরেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যােগ নেওয়া হয়নি। 

দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা নেন। সেই লক্ষ্যে গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ প্রদান করেন।

প্রধান বিচারপতি তার অভিভাষণে দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।

অভিভাষণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য তিনি শিগগিরই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত গ্রহণপূর্বক বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আজ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।

নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির প্রয়োগ ও চর্চার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ কার্যকররূপে বাস্তবায়িত না হলে রাষ্ট্রে সংবিধানের সুসংহত চর্চা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। এর ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগগুলোর মধ্যে ক্ষমতার শুদ্ধ ভারসাম্য বজায় রাখার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা একদিকে যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে, দীর্ঘদিন যাবত বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রবণতার যে চর্চা অব্যাহত রয়েছে তা রোধ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এর ফলে স্বাধীনতার পর হতে অদ্যবধি আমাদের দেশে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা চর্চার সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ, আমাদের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

তাই দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এদেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (যা মাসদার হোসেন মামলা নামেই অধিক সমাদৃত) নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে।

উক্ত রায়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে একাধিকবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রসঙ্গ এসেছে। আর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সর্বোত্তম কার্যকর উপায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কারণে উক্ত মামলার রায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমানে প্রচলিত দ্বৈত-শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

এ কথা সত্য যে, বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্ভবপর হয়নি। একারণে বিগত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সময় হচ্ছে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের শ্রেষ্ঠ সময়। এ প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ হতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। কেননা, কেবলমাত্র পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমাদের দেশে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন বিচার কাজের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের উপর অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি অধস্তন আদালতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তথা হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।

এছাড়া, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সংখ্যা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি, অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মপরিধি পূর্বের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয় স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে কেবলমাত্র পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতের বিচারকগণের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত