বিক্রমপুর জীবনের ইতিকথাঃ শিমুল ফুলের হাতছানি

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২১, ১১:১৮ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩

মুজিব রহমান
------------------------------

শাহজাহান স্যার বিক্রমপুর নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। বিভিন্নভাবেই তিনি বিক্রমপুরকে অনুসন্ধান করেছেন। সেটা যেমন বিক্রমপুরে করেছেন আবার করেছেন বিক্রমপুরের বাইরে। তাঁর প্রতিটি অনুসন্ধানই গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিনী অবলা বসুকে নিয়ে লিখেছেন ‘অবলা বসুর খোঁজে বিক্রমপুর, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনকূল- পৈতৃক বাড়ি, মামা বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি বিক্রমপুরে। কিন্তু তাঁর পৈতৃক বাড়ির ভিটার খোঁজ এখনো মিলেনি। স্যার তাকে নিয়ে লিখেছেন ‘মানিকের খোঁজে বিক্রমপুর’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে একটি স্মারকগ্রন্থও তিনি সম্পাদনা করেছেন। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া খ্যাত সরোজিনী নাইডুর পিতা দার্শনিক-শিক্ষাবিদ-বিজ্ঞানী অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং স্বভাব কবি গোবিন্দ দাসকেও বিক্রমপুরে খোঁজ করে বই লিখেছেন। বিক্রমপুরের বহু মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন স্থায়ীভাবে। তাদের নিয়ে লিখেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গে বিক্রমপুর অনুসন্ধান’। এজন্য তিনি বেশ কয়েকবার ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ও নিবিড়ভাবে পশ্চিমবঙ্গে খোঁজ করেছেন। এছাড়া সিরাজদিখান উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন। হরগঙ্গা কলেজের তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন কলেজের সত্তর বছর পূর্তি সংখ্যা সম্পাদনা করেন এবং বিক্রমপুরের পাগল হরকুমার রচনা সংগ্রহ সম্পাদনা করেন। তিনি ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর এর বেশ কয়েকটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। বিক্রমপুরের বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মকাণ্ডের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রথমাংশের তিনটি বিষয়ের খণ্ডচিত্র তুলে ধরে লিখেছেন এক অসামান্য স্মৃতিকথা- ‘শিমুল ফুলের হাতছানি’।

প্রথম অংশে লিখেছেন তারই বাল্যকালের এক সহচর সেরুকে নিয়ে। সেরু ছিল দুষ্টুর শিরোমনি। আমরা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রনাথ আর রামের সুমতির রামের মিশ্রণ হল সেরু। মার্ক টোয়েনের অমর সৃষ্টি হাকলবেরি ফিন ও টম সয়্যার এর সাথেও মেলানো যায় সেরুকে। অদম্য কিশোর সেরুর বাঁধনছাড়া ডাক স্যারকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেত। অমন হাতছানি এড়ানো সহজ নয়। সেই সেরুর সাথে ঘটা কতো বিচিত্র ঘটনা, গভীর রাতে মাছ ধরতে যাওয়া, টিনের বাক্স ভেঙ্গে টাকা নিয়ে মামা বাড়ি বেড়াতে যাওয়া কত কি! সেরুর দস্যিপনা আর দুষ্টুমিপূর্ণ জীবনের সাথে রয়েছে তার তীব্র দারিদ্রতা, প্রেম, বিয়ে আর অতি সংক্ষেপে বাকি জীবনের কথা। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সব ঘটনা রয়েছে এখানে। পড়ে মন ভরে উঠেছে এবং পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়েই অধ্যায়টুকু শেষ করেছি পড়ে। এই কিশোর জীবন নিয়ে দুর্দান্ত শর্টফ্লিমও করা যায়।

দ্বিতীয় অধ্যায়টি তার জীবনের প্রথম চাকরি ব্রাহ্মণগাঁও স্কুলের শিক্ষকতার সময়কাল নিয়ে। তবে এখানে তিনি ওই সময়ে লেখা কিছু ডাইরির পাতাই হুবহু তুলে দিয়েছেন। ওই সময়ে তার কাচা হাতের লেখা এবং ঘটনা গভীরভাবে তুলে না আনাটা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে রেখে আসা নতুন বউ, সন্তান শুভর জন্ম, চাকরির চেষ্টা ও এর আগের বেকারত্বর কথা লিখেছেন। উঠে এসেছে তার পরিবারের অনেক কথা। পিতার ব্যবসা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন ইত্যাদিও রয়েছে ওই ডাইরীতে। অংশটুকু খুব আকর্ষণীয়ভাবে লেখা হয়নি, একটু খাপছাড়াও মনে হয়েছে। তবে ওই সময়ের একটি চিত্র আমরা পাই।

তৃতীয় অধ্যায়টি স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশনে স্বল্পকালীন শিক্ষকতা নিয়ে লেখা। এটি হয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রাঢ়ীখাল ও স্কুলের ইতিহাস, ঐতিহ্যও উঠে এসেছে অসাধারণ ভাবে। গ্রামটি এমনিতেই বিখ্যাত স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও হুমায়ুন আজাদের কারণে। আরো বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্ম এখানে। তিনি স্ত্রী-পুত্রসহ থাকতেন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অম্বিকা সাহার বাড়িতে। সেই বাড়িতে থাকতেন অম্বিকা সাহার পরিবারের দুই বয়স্কা বিধবা নারী। সন্তানহীনা দুই নারী কিভাবে তাকে সন্তান হিসেবেই দেখতে শুরু করে তা হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি যখন রাঢ়ীখাল ছেড়ে আসতে নৌকায় ওঠেন তখন তাদের একজন যাকে স্যার জেঠিমা বলতেন তিনি নৌকার রশিটি ধরে ফেললেন। স্যার নেমে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘আর জনমে আমি যেন আপনার পেটের সন্তান হয়ে জন্মাই। আপনি আমাকে এই আশীর্বাদটুকু করে দিন’। তিনি নৌকায় ফিরে গেলেও জেঠিমা রশিটি হাতে ধরে রাখেন। মাঝি লগিতে ভর দিচ্ছে- জেঠিমাও জলে নামছেন। একসময় রশিটি হাত থেকে খসে পড়ল। বন্ধনমুক্ত নৌকা ছেড়ে গেল রাঢ়ীখাল! রাঢ়ীখালের মানুষকে, শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষকদের তিনি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন তারাও তাকে ভালবেসেছিল উজার করে। সেইসব কথা কী অসাধারণ দক্ষতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা বইটি না পড়লে উপলব্ধি হবে না। রাঢ়ীখালবাসীর জন্য এক মনোমুগ্ধকর বর্ণনা রেখে গেছেন। যদি কখনো রাঢ়ীখালের ইতিহাস লেখা হয় তখন এই বইটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার। স্যার সুফিবাদী দর্শনের মানুষ। রাঢ়ীখালে তিনি কজন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষের সান্নিধ্যে আসেন। তারা তাকে অনেক গান শুনিয়েছে। এই গান ও প্রকৃতি তার ভিতরে প্রবেশ করেছিল হয়তো রাঢ়ীখালেই।

স্যার বইটির শেষ দিকে কৈফয়ত দিয়েছেন এক পাতার। সেখানে রাঢ়ীখাল বানানটির পক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন ৪৩ বছর আগের কথা লেখার সময় ভ্রান্তিদোষ স্পর্শ করতে পারে। সে দায় তিনি দিয়েছেন সময়কে। কারণ- সময় মুছিয়া দেয় সব কিছু। তবুও কিছু ভ্রান্তির কথা বলি- যেমন- ঈশ্বর পালের বাইচের নৌকার নাম জলবিন্দু। কিন্তু ভাগ্যকুল জমিদারদের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের নামে তাদের বাইচের নৌকাটির মালিকানার কথাও বলেছেন ঈশ্বরপালের। ঈশ্বর পালের তিন পুত্র অরুন, বরুন ও তরুণ পাল। স্যার্ দুই সন্তানের কথা বলেছেন। আড়িয়াল বিলটির দুটি বানান স্যার লিখেছেন আরিয়ল ও আড়িয়ল। কিন্তু হবে আড়িয়াল। এসব খুব সামান্যই ভুল ভ্রান্তি। একটি অসাধারণ রচনার কাছে এমন ভ্রান্তি উপেক্ষনীয়।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত