বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ-যানজটের শহর ঢাকা

  সাধন সরকার

প্রকাশ: ৩ এপ্রিল ২০২২, ১১:২৩ |  আপডেট  : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৩৪

বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষণের শহর কোনটি? বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের শহর কোনটি? উত্তর একটাই-‘ঢাকা’। ঢাকা শহরের সুখ্যাতি-সুপরিচিতি-সুনাম দিনে দিনে নষ্ট করে ফেলছে দূষণ আর যানজট। যতই দিন যাচ্ছে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ঢাকা শহর যেন এক আতঙ্কের নাম উঠছে। গত এক দশক আগেও ঢাকার সমস্যা এত প্রকট আকার ধারণ করেনি। ঢাকা শহর মানে যানজটে আটকে থাকা, ঢাকা শহর মানে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের কবলে পড়া। দেশে-বিদেশে  রাজধানী ঢাকা শহর এখন পরিচিতি পেয়েছে এবং পাচ্ছে বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ-যানজটের শহর হিসেবে। ঢাকা শহরকে মানুষ এখন ভয় পায়! বিপদে পড়ে তবুও এই শহরে মানুষকে আসতে হয়। কেননা সুশিক্ষা, সুচিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বলতে গেলে প্রায় সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ‘শব্দদূষণ’ নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। সুইজারল্যান্ডের দূষণরোধকারী প্রযুক্তি সেবাদাতা সংস্থা আইকিউএয়ারের বিশ্ব বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১’ এ বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। আর ঢাকা বিশ্বের মধ্যে দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয়। যানজটের কারণে ঢাকাবাসীর প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। তথ্য মতে, যানজটের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। অথচ এই টাকা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব! 
     
ঢাকা শহরের সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বাড়ছে। একটি সমস্যা সমাধান করতে করতে নতুন সমস্যা এসে হাজির হচ্ছে। ঢাকায় উড়ালসড়ক হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে কিন্তু যানজট যানজটের মতো থেকে যাচ্ছে। আসন্ন মেট্রোরেলের চমকও যানজট সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা বলা মুশকিল! বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ-যানজটের সম্মিলিত নেতিবাচক প্রভাবে ঢাকা শহর একটি অসুস্থ নগরে পরিণত হয়েছে। বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ-যানজটের অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। অথচ ঢাকা শহরের দূষণ ও যানজট নিরসন করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো এগিয়ে যেত। ঢাকা শহরের শিশুরা এই দূষণের মধ্যে বড় হচ্ছে। দূষণের মধ্যে বাস করতে করতে নগরবাসী নিজের অজান্তেই জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। রাজধানীর কত মেয়র এলো গেল, কত আশ্বাস ঢাকা শহরের দূষিত বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই! ঢাকা শহরের যানজট ও দূষণ কোনোটাই হয়তো দেশের নীতিনির্ধারকেদের স্পর্শ করে না! তা যদি করত তাহলে এতদিন ঢাকা শহরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো। দেশের নীতিনির্ধারকরা তো চলেন এসি গাড়িতে। তারা যে রাস্তা দিয়ে যায় সে রাস্তা আগে থেকেই জনগণ সরিয়ে (জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে) ফাঁকা করে রাখা হয়। তবে আসলেই কি ঢাকা শহরের দূষণ ও যানজটের মতো বৃহৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব? নাকি ঢাকা শহর পরিত্যক্ত ঘোষণার সময় এসেছে! কেননা এভাবে সমস্যাবহুল ঢাকা শহরে দিনের পর দিন বাস করে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি ও জনভোগান্তি করে লাভ কী? ঢাকা শহরের সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা দরকার। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের বিদ্যমান আইয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে দূষণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু আইন তো কাগজে-কলমেই পড়ে থাকে! বাস্তবে আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। দিনে দিনে বসবাসের অযোগ্য শহর হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। অথচ রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখা গেলে ধুলাদূষণ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যেত। গাড়িতে বর্জ্য পরিবহনের সময় বর্জ্য ঢেকে রাখার কথা থাকলেও তা মানা হয় না। নির্মাণকাজের সময় মালামাল ঢেকে রাখা হয় না। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে রাস্তায় পানি ছিটানো হয় না। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সময় দরপত্রের শর্তও মানা হয়। ঢাকা শহরের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা, গাফিলতি ও অবহেলার কারণে ঢাকার এই করুন দশা। সমস্যা জর্জরিত বসবাসঅযোগ্য ঢাকার এই বেহাল দশা নিয়ে  কোনো সংস্থাকেই দায় নিতে দেখিনি, কাউকে জবাবদিহি করতে শুনিনি! শব্দদূষণের নিয়মকানুন কতজন বাসের চালক ও নগরবাসী জানে? আর জানলেও তা মানে না! সোজা কথায়, আইনের প্রয়োগ থাকলে দেশের রাজধানী শহরের এমন অবনতি হতো না। আইন  প্রয়োগ ও মানার চর্চা থাকলে শহরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। দূষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক পূর্ণ সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে অচিরেই ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নয়তো শব্দদূষণ-বায়ুদূষণ আর যানজটের শহরে বসবাস দেশের সুস্বাস্থ্যপূর্ণ গড় আয়ু ও সার্বিক অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিবে।  

লেখক :  শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত