নৈইলগা আর অষ্টক গানের দল
বাস্তুদেবের বাহন কুমিরের পূজা
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১১:০৩ | আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১৩
তাপতী বসু
--------------------
পৌষের উত্তরা বাতাস আর রোদ গায়ে মেখে মাঠের ধান কাটত মাঝি পাড়ার নিতাই,বুলু ,কালু....সাথে থাকত ধলু,রতন,কৃষ্ণ আরও কতজন৷ দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে এদের মিলিত "নৈইলগা"গানের দল হারিকেনের আলোয় হেঁটে আসত পরিচিত রাস্তা ধরে৷ রায়েরকাঠি,ওদনকাঠি,লখাকাঠি,পান্তাডুবি..ঘুরে ঘুরে গান শোনাতো তারা৷পৌরানিক ঘটনার ছোট্ট একটা টুকরোকে টেনে টেনে মিলিত স্বরে বলে যেতো—
"যখন কৃষ্ণ জন্ম নিলো দেবকি উদরে৷
মথুরাতে দেব গন পুষ্পবৃষ্টি করে৷৷
বসুদেব রাখিয়া আইলো নন্দের আলয়ে৷
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে..... ৷৷"
অথবা
"লক্ষণ পড়লো শক্তিশেলে,
কান্দে সোনার রাম!
সীতা গেলে সীতা পাবো
প্রতি ঘরে ঘরে ,
প্রাণের ভাই লক্ষণ গেলে ভাই বলিব কারে"...
"ননী খাইল কেরে গোপাল,ননী খাইল কে?
আমি ননী খাইনিরে মাগো,বলাই খেয়েছে!
বলাই যদি খাআতোরে ননী,খাইত আধা আধা
তুমি ননী খাইছরে গোপাল,ভান্ড করি সাদা"...
প্রশ্ন-উত্তর-প্রতি উত্তরে গান শেষে থাকত সবার জন্যে একই শুভ কামনা-
"এই বাড়ির বড়ো বাবু বড়ই ভাগ্যবান৷
ওরে ধনে-জনে পরিপুন্ন গোলা ভরা ধান৷
বাস্তুদেবীর নামে কিছু পয়সা করেন দান,
শত বচ্ছর বাইচে থাকুক কোলে সোনার চান৷"
কবে,কোন কথক প্রথম এই মাটির গান মুখে মুখে বানিয়ে ছিলেন কে তা জানে৷? সুরারোপে নৈইলগার' দল নিয়ে পৌষ উৎসব পালনে ঘুরতেন এগ্রাম থেকে ও গ্রাম৷এঁরাই আবার "অষ্টক"দল হয়ে রাম-সীতা,কৃষ্ণ-রাধা সেজে পায়ে নূপুর আর লোকজ বাজনার সাথে গান আর নাচ করতেন৷
নাচ গান শেষে দেওয়া চাল হাটে বিক্রি করে মাঠে নিজেরাই গড়ে নিত মাটির কুমির৷নদীর পাড়ে বসবাস৷কুমিরের সাথে সখ্য করতে "কুমির পুজো"৷প্রকৃতির প্রতিটি গাছ বা প্রানির সাথে ভালোবাসা আর সহমর্মিতা না থাকলে যে মানুষেরই বিপদ৷সেই চিন্তার প্রতিবিম্বের আর একটি রূপ এই "কুমির পুজো৷" মূল নাম 'বাস্তুপূজা' - শতাধিক বছরের বাস্তুভিটা রক্ষায় বাস্তুমাকে সন্তুষ্ট করতেই বাংলায় বছরের পৌষ সংক্রান্তিতে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।লোক সংষ্কৃতিতে বাস্তু বাহন কুমিরের পিঠে পূজিত হতে আসেন।
কুমিরই প্রধান অনুসঙ্গ হওয়ায় মুখে মুখে এ পূজো কুমির পূজা নামে ও প্রচলিত। যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা লোক কাহিনী।পূজা শেষে মাটির তৈরি কুমিরের গলাকেটে প্রতীকী হত্যা করা না হলে মাটির কুমির জীবন্ত হয়ে জনপদের মানুষকে আক্রমন করতে পারে বলে রয়েছে জনশ্রুতি৷
রায়েরকাঠি গ্রামে দেখেছিলাম এই নৈইলগা আর অষ্টক দলের নাচ আর গান--আঠাশ বছর আগে!সেবার দলে ছিল ছোটো রাধা-কৃষ্ণ! রাধা ভাসুরের ছেলে অমিত আর কৃষ্ণ সেজেছিল নাতনি সম্পর্কের ইন্দ্রানী৷ আঠাশ বছর চলে গেছে তারপর৷ এবার খোঁজ নিয়ে জানলাম অষ্টক বা নৈইলগার কোনো দল নেই৷ মাঝি পাড়ার যাদের নাম লিখেছি ,এবং আরো অনেকে-কেউ বেঁচে নেই৷ একটা গান যোগাড় করে দিয়েছে অমিত। এখানে কুমির পুজো এখন আর হয় না৷
ঝালকাঠি সময় পত্রিকার সম্পাদক লিখেছেন,
‘মাটির কুমিরকে কুপিয়ে হত্যা করতে হয়, `নয়তো জীবিত হয়ে কামড়ে দেয়’
মাটির কুমিরকে কুপিয়ে হত্যা করাই রীতি, নয়ত জীবন্ত কুমিড় হয়ে কামড়ে দিতে পারে জনপদের বাসিন্দাদের। আর সে বিশ্বাস থেকেই যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে যে পূজা তা লোকমুখে কুমির পূজা নামে পরিচিত পেয়েছে।তবে এ পূজার নাম বাস্তু পূজা। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় প্রতি বছর এ উৎসব পালন করে আসছে। ঝালকাঠি জেলা শহর সহ বিভিন্ন এলাকায় শুক্রবার দিনব্যাপী লোকজ সংস্কৃতির এ কুমির পূজা নানা আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়।
বাস্তু পূজা শেষে ঝালকাঠি লোকনাথ মন্দিরের পুরোহিত অমল ভট্টাচার্য্য বলেন, বর্তমানে কুমির পূজা নামে পরিচিত হলেও মূলত পূজার নাম বাস্তু পূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদের বসৎভিটা কিংবা স্থাপনা রয়েছে তারাই বছরের বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিন এ পূজার আয়োজন করে আসছেন যুগযুগ ধরে। জনপদে বাস্তভিটা রক্ষায় বাস্তু দেবিকে সন্তুষ্টু করতেই আয়োজন করা হয় নানা আচার। আর বাহন কুমিরের পিঠে চরে পূজিত হন দেবি বাস্তু।
এদিকে মিথ রয়েছে, পূজা শেষে দেবির বাহন কুমিরটিকে কুপিয়ে প্রতীকী হত্যা করতে হবে, নয়তো মাটির কুমির জীবন্ত হয়ে কামড়ে দিতে পারে মানুষজনকে বিশেষ করে শিশুদের- এ ব্যাপারে পুরহিত অমল ভট্টাচার্য্য বলেন, মূলত প্রতীকী বলি দিয়ে অমঙ্গ বা অশুভকে তাড়াতেই কুমিরকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। জনপদের বাসিন্দাদের বাস্তুভিটা রক্ষায় বিশেষ এ ধর্মীয় আচার আনুষ্ঠান তাই কুমির পূজা নামে পরিচিতি পেয়েছে, বলেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার জেলা শহরের লোকনাথ মন্দির, জেলে পাড়া, বাঁশপট্টি, কাঁশারীপট্টিসহ শহর ও গ্রামাঞ্চলর বিভিন্ন এলাকায় বাস্ত পূজা অনুষ্ঠিত হয়।তবে করোনার কারণে অনেকা জনসমাগম কম করে আয়োজন করেন আয়োজকরা। পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণেরও আয়োজন করা হয়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত