বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ভাষণ

  জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ৭ মার্চ ২০২৩, ১১:০১ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:৫৬

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ভাষণ
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জাদুকরী ভাষণ দেশের জনগণের মাঝে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে প্রতিটি বাঙ্গালী কোন না কোন ভাবে এই ভাষন শুনতেন বা স্মৃতিচারণ করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ২৫ মে, ১৯৭১ নজরুল জন্মজয়ন্তীতে চালু হয়। ঐদিন থেকেই ‘বজ্রকন্ঠ’ নামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অংশ প্রচার করা হতো। এম আর আখতার মুকুলের রচিত ও পঠিত ‘চরমপত্র’- এর পরেই ‘বজ্রকন্ঠ’ ছিল স্বাধীন বাংলার জনপ্রিয় পর্ব। কোনদিন চরমপত্র প্রচারিত না হলে অনেক মুরুব্বীজন মন খারাপ করে উঠে যেতেন। আমার মন খারাপ হতো কোনদিন ‘বজ্রকন্ঠ’ প্রচার না হলে। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭০ সালের গ্রীষ্মকালে মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ মাঠে প্রথম দেখেই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে উঠি। আওয়ামী লীগের সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে বিক্রমপুরের নেতা কর্মীরা ভাই…… ভাই…… বলে শ্লোগান দিতে লাগল। শ্লোগান শুনে বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বললেন ‘স্টপ দিস ননসেন্স’- ধমকের পরেই মাঠে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। আমি আর সাধন বঙ্গবন্ধুর ধমকে কেঁপে উঠেছিলাম।

১ মার্চ, ১৯৭১ কলেজে ক্লাস নিতে এসে রউফ খান জানান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন। স্যারের মুখে এই কথা শুনেই আমরা রিভল্ট করি। কলেজের সকল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবাদ করি- মিছিল করি- এরপর থেকে আমাদের দিন কাটে আন্দোলন সংগ্রাম করে। ৭মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত হবে এ ঘোষণায় আমরা খুবই আনন্দিত হয়ে দুপুরের পর পরই রেডিও নিয়ে বসে যাই। কিন্তু ২/৩ টি দেশাত্মবোধক গান দিয়ে কোন ঘোষনা ছাড়াই হঠাত বেতার বন্ধ হয়ে যায়। এতে মন খারাপ করে আমরা যার যার ঘরে ফিরে আসি।

রাতে ঘোষণা আসে ৮ মার্চ সকালে বাংলা খবরের পরে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করা হবে। ভাষণ শ্রীনগরের সকল মানুষকে শোনানোর জন্য আমরা আশু পোদ্দারের মাইক এনে দুটি হর্ণ কাঠপট্টির দু’দিকে লাগাই। কাঠব্যবসায়ী হায়দার আলী তার ফিলিপস রেডিওতে নতুন ব্যাটারি ভরে দিলেন। ভাষণের আগে আমরা জনগণকে আহবান জানাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আসার জন্য। খবরে পরই ঘোষণা হলো- ‘এখন গত কালে রেকর্ডকৃত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হচ্ছে’। বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে- “ভাইয়েরা আমার জয় বাংলা” মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধু শুনেই গেলাম। শব্দ, উচ্চারণ, লয় সব সাবলীল। যেখানে জোর দেওয়া দরকার সেখান জোর, যেখানে একটু সহনশীল হওয়া দরকার সেখানে সহনশীল। কারো প্রতি বিরূপ মনোভাব নেই। ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রত্যেককে সম্মান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। আমরা ধারণা করেছিলাম বঙ্গবন্ধু  সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিবেন। কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ঘোষনা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের  মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অলিখিত। গেটিসবার্গে আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ ছিল লিখিত। তাও আবার ১০/১২ বার কাটাকাটি ও সংশোধনের পর। সে অর্থে ৭ মার্চের ভাষণ অসাধারণ ও অভূতপূর্ব। এই বিবেচনা থেকেই ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো বিশ্বের অন্যতম ভাষণ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। এ ভাষণ যত্রতত্র যখন তখন বাজানো ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অর্জন বাংলাদেশ আর ৭ মার্চের ভাষণ। যা অনুপ্রেরণা দিবে দেশকে সমৃদ্ধ করতে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত