বাংলাদেশের সরকারি ওষুধ কিভাবে গেল ভারতীয় হাসপাতালে?
প্রকাশ: ৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৩১ | আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৬
দেশের সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে যে ওষুধ রোগীদেরকে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা, তা ভারতীয় এক হাসপাতালে রোগীদেরকে দেওয়ার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকরা। দুই দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে প্রশ্নজট বাড়ছে।
বাংলাদেশের সরকারের উৎপাদিত বিভিন্ন ওষুধ ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেসব ওষুধ ভারতের সরকারি কোনো হাসপাতালে কখনো দেওয়া হয় না। এমনটা সাম্প্রতিক অতীতে কখনো শোনাও যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের উৎপাদিত ওষুধ দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক মহকুমা হাসপাতালে, গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য প্রকাশ করে আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতীয় বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত আছে যেসব প্রদেশের, সেসব প্রদেশের গ্রামীণ এলাকার নারীদের কাছে বাংলাদেশের সরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সুখী’র খুব চাহিদা। ভারতীয় জরিপেও বিষয়টি উঠে এসেছে। দেশটির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিষয়টি বিভিন্ন সময় স্বীকার করেন। প্রতিবছর সুখী ভারতে পাচার হয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে। সীমান্তে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাচারকালে প্রায়ই তা ধরাও পড়ে। যথাযথ উদ্যোগের অভাবে পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।
গত ৩১ মার্চ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে ভারতে পাচারকালে ১৯ হাজার ২২১টি সুখী বড়ির পাতা জব্দ করে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি)। এর আগে ৮ মার্চ ওই জেলার সীমান্ত থেকে ভারতে পাচারের সময় বিপুল পরিমাণ সুখী জব্দ করে বিজিবি। জব্দ হওয়া এসব সরকারি বড়ির বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
আনন্দদবাজার পত্রিকা ২০১৮ সালে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সমীক্ষা প্রতিবেদনের বরাতে জানায়, আসামে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে বাংলাদেশই! সমীক্ষা বলছে, ওই রাজ্যের নারীরা, বিশেষ করে বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকায় গর্ভনিরোধক হিসেবে ভারতীয় ‘মালা-ডি’ নয়, নির্ভর করে বাংলাদেশি সুখী’র উপরেই।
পাচার হয়ে যাওয়া গর্ভনিরোধক সুখী ভারতে স্বীকৃত নয়। তাতে সাধারণ মানুষের কী-ই বা এসে যায়! চাইলেই মালা-ডি তো পাওয়া যায় না। সরবরাহ প্রায় নেই। হাতের কাছে অঢেল সুখী। বাংলাদেশে বিনামূল্যে দেওয়া হলেও ভারতে পাচার হয়ে আসা দশটি ট্যাবলেটের সুখী’র একটি পাতার দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা। অন্যদিকে, বাজার চলতি গর্ভনিরোধকের প্রতি পাতার দাম পড়ে ৭৫ থেকে ১০০ টাকা।
রাজ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ, প্রসূতি মৃত্যুসহ মহিলা স্বাস্থ্যের উপরে সাম্প্রতিক এক আলোচনাচক্রের সূত্র ধরে সামনে এসেছে এসব তথ্য। গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান আর কে তালুকদার তখন আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান, রাজ্যের হাসপাতালে ভারতীয় গর্ভনিরোধক বড়ির অনিয়মিত সরবরাহ আর ওই বড়ি নিয়ে ছড়ানো বিভিন্ন গুজবের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার মহিলারা বাংলাদেশ থেকে আসা সুখীকেই বেছে নিচ্ছেন।
সুখীর ব্যবহার শুধু আসাম নয়, পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর। মা ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্তা সুজয় রায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান, উত্তরবঙ্গেও বিভিন্ন এলাকায় সুখী বহুল প্রচলিত। সেখানকার দোকানগুলো বেআইনি জেনেও সুখী বিক্রি করছেন। জানা গিয়েছে, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় ভারতীয় মালা-ডির চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় সুখী। বাংলায় গেদে, বানপুর, বনগাঁ হয়েও ঢুকছে সুখী। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য রাজ্যে সুখীর রমরমা মানতে চাননি।
পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালে বাংলাদেশি যে সরকারি ওষুধ দেওয়ার ঘটনা ঘটে, সেটা ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, মূত্র ও জননতন্ত্রের সংক্রমণ, সিফিলিসের সংক্রমণ, কলেরা, ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া, ব্রণ, ফোঁড়া ইত্যাদি রোগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এ ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। দেশীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ গ্রুপের দুটি মাত্রার ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়। ১০০ ও ৫০ এমজির। সরকারের উৎপাদিত এ গ্রুপের ওষুধ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজ বুধবার বিকেলে মত ও পথকে বলেন, ‘ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বাংলাদেশ সরকার ওষুধের বড় চালান পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তখন ওই ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ভুলক্রমে সেই ওষুধ হয়তো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ হাসপাতালে পাঠিয়ে থাকতে পারে।’
ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো জানায়, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমা হাসপাতালের বহির্বিভাগে গতকাল অনেক রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। সরকারি নিয়ম মতো তাদের মধ্যে অনেকে ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) লেখা ওষুধ পেয়েছিলেন হাসপাতালের তরফে। কেউ কেউ পেয়েছিলেন ‘ডক্সিসাইক্লিন’। ওই ক্যাপসুলের পাউচের গায়ে বাংলা হরফে লেখা, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ, ক্রয় বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয়’। বিষয়টি নজরে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় কাঁথিতে। কী ভাবে এমনটা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন।
কৃতজ্ঞতায় :
মত ও পথ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত