প্রতিদিন উত্তরবঙ্গের শ্রমিকদের শ্রম বিক্রির হাট মিলছে মুন্সীগঞ্জে              

  কাজী দীপু, মুন্সীগঞ্জ 

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২১, ১৭:১৬ |  আপডেট  : ১৯ মে ২০২৪, ০৭:১১

পদ্মা নদী ঘেষাঁ মুন্সীগঞ্জ সদরের চরাঞ্চলের শিলই ইউনিয়নের দেওয়ানকান্দি গ্রাম। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে এই গ্রামের সড়কে ও ব্রিজের ওপর কয়েক শতাধিক নারী-পুরুষ জটলা পাকিঁয়ে দাড়িয়ে থাকার দৃশ্য দুর থেকে দেখলে সকলেরই মনে হবে কিছু একটা হয়েছে সেখানে। তাই এগিয়ে কাছে গিয়ে জানা গেলো, দেওয়ানকান্দি গ্রামে কিছুই হয়নি, মানুষের ভীড় থাকা স্থানে দাড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা। তারা জীবিকার তাগিদে এ অঞ্চলে এসেছে আলু তোলার কাজে। আর তাই প্রতিদিন সকালের ন্যায় গতকাল সকালেও শ্রম বিক্রির বেচাকেনার হাটে বসেছে দেওয়ানকান্দি গ্রামের এই সড়ক পথে। সরেজমিন দেখা গেলো, দেওয়ানকান্দি গ্রামের একাধিক কৃষকের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিকরা চুক্তি অথবা দিনব্যাপী শ্রম বিক্রির পারিশ্রমিক নিয়ে দর-কষাকষি করছে। আবার শ্রম বিক্রির চুক্তি শেষে কৃষকের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে রোপন করা আলু জমির দিকে চলে যাচ্ছেন। শ্রমিকরা ১৫ থেকে ২০ জনের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আলু তোলার কাজে যুক্তদের মধ্যে নারী শ্রমিকও রয়েছে। গ্রামের যুবক সুলতান আরিফ জানান, প্রতিদিন সকালেই শ্রম বিক্রির হাট বসে দেওয়ানকান্দি গ্রামসহ আশপাশ গ্রামের পথে-প্রান্তরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা নদী ঘেষাঁ এই গ্রামের মতো মুন্সীগঞ্জ জেলার ৬৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ও হাট-বাজার গুলোতে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নিলফামারী, কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় লক্ষাধিক পুরুষ ও নারী শ্রমিকের শ্রম বিক্রির বেচাকেনার হাট বসে থাকে। চুক্তি এবং দিন প্রতি পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ হয়েই আলু তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এসব শ্রমিকরা। জেলার কৃষককূলও স্থানীয় শ্রমিক সঙ্কটের কারনে উত্তরবঙ্গের এসব শ্রমিকদের পেয়ে আলু তোলার কাজে তাদেরকে সম্পৃক্ত করছেন। আর এই শ্রমিকরাই আলু তোলা শেষে জমি থেকে হিমাগারে ও বাড়ির আঙ্গিনায় পৌছে দেওয়ার কাজ করছে। ফলে জেলার বিস্তীর্ন কৃষি জমি গুলো এখন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের পদচারনায় মুখর হয়ে উঠেছে। আর কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বাড়ির গৃহীনি ও শিশুরাও জমিতে আলু তোলার আনন্দে উদ্বেলিত। তবে তাদের অভিযোগ, স্থানীয় শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেশী দিলেও তাদের দেওয়া হচ্ছে কম, অথচ তারা একই পরিশ্রম করছে। গাইবন্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার একাধিক পুরুষ ও নারী শ্রমিকের সঙ্গে। নারী শ্রমিক কাজলী দাস বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের মতো তারা একই পরিশ্রম করছেন। কিন্তুু তাদের মজুরী দেওয়া হয় ৩০০ টাকা আর পুরুষ শ্রমিকদের ৪০০ টাকা। মজুরি বৈষম্যের এ বিষয়টি নিয়ে কাজলী দাস, রূপসী রানী দাসসহ অপর নারী শ্রমিকরা মনের কষ্টের কথা তুলে ধরেন।

সরেজিমন দেখা গেছে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পুরানদাহ গ্রামের শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র দাস ও স্ত্রী রূপসী রানী দাস গত ১০ দিন ধরে আলু তোলার কাজে মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই এখন আলু শ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন রৌদ্রের প্রখর তাপ মাড়িয়ে রোপন করা জমিতে আলু উত্তোলন করছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আলু তোলার কাজে মজুরী হিসেবে স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে প্রতিদিন আয় করছে ৭শ’ টাকা। এ মতো আরও এক দম্পত্তির শ্রী নন্দ কুমার দাস ও শ্রীমতি হোসনা রানীও দুই সন্তান নিয়ে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার ধামারণ গ্রামের বিল্লাল মাদবরের বাড়ীতে ভাড়া বাসা নিয়ে আলু তোলার কাজ করে যাচ্ছেন।

টঙ্গিবাড়ীর ধামারণ গ্রামের কৃষক কবির হাওলাদার জানান, তিনিও তার জমিতে রোপন করা আলু তুলতে উত্তরবঙ্গের শ্রমিক নিয়োগ করেছেন। স্থানীয় ভাবে শ্রমিকের সংখ্যা কম হওয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শ্রমিকদের আলু তোলার সময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ১৫ থেকে ২০ জন দলভূক্ত হয়ে আলুর জেলা হিসেবে খ্যাত মুন্সীগঞ্জের বিস্তীর্ন জমিতে আলু তোলার কাজে ভীড় জমিয়ে তুলেছে। তারা কৃষকের নির্দেশনা মতো আলু উত্তোলন, জমি থেকে হিমাগারে ও বাড়ির আঙ্গিনায় পৌছে দেওয়ার কাজ করছেন।

কৃষক সাহাবুদিন হাওলাদার আরও জানান, পুরো মার্চ ও এপ্রিল মাসের দুই সপ্তাহ জুড়েই আলু তোলার কাজে শ্রমিকদের নিয়ে জমিতে থাকতে হবে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত হাজার হাজার নারী ও পুরুশ শ্রমিকের সঙ্গে তার বাড়ির গৃহিনী ও শিশুরা জমিতে নেমে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আলু তুলছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. আল মামুন জানান, জেলায় ৭৮ হাজার কৃষক পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার সদস্য কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এ বছর জেলায় ৩৯ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমি আলু চাষ হয়েছে। গত বছর ৩৮ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়ে ছিলো। আলু উৎপন্ন হয়ে ছিলো ১৩ লাখ ৫১ হাজার ১২৯ মেট্রিক টন। আর উৎপাদিত আলুর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু হিসেবে জেলার ৬৮টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। আর হিমাগার গুলোর ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি অফিস সূত্র আর জানায়, হিমাগারে সংরক্ষন করার পাশাপাশি অনেক কৃষক টাকার প্রয়োজনে জমিতেই আলু বিক্রি করে ফেলবেন আবার অনেক কৃষক দেশীয় পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত