পুলঘাটার ঘনসবুজ পানবরজে       

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২১, ১২:৩৩ |  আপডেট  : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৪৮

মোহাম্মদ আবুল খায়ের মৃধা
------------------------------------------

গা পোড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েও বালকগুলোর পানিতে ঝাপাঝাপির ছবি তুলছি। হাসপি বাদে অন্য সঙ্গীরা ইতোমধ্যে গাড়িতে গিয়ে বসে বাদাম ও কোমলপানীয় গিলছে। হাসপি কোথা থেকে যেন চেষ্টা-চরিত করে এই সকল আহার সামগ্রী জোগাড় করে নিয়ে এসেছে; ফুট-ফরমায়েশে ওস্তাদ সে। অবশ্য দোষ ওদের দিচ্ছি না। শুধু শুধু রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিক। খামোখা ক্যালরি পুড়িয়ে লাভ কী? এ-ই ভালো বসে বসে জিহ্বা চালাক, শরীর ও মনের শ্রান্তি দূর করুক।

দুরন্ত বালকগুলো নির্দেশ মতো বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সেতু থেকে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়ছিল। যেন কোনো ছায়াছবির ডিরেক্টর নির্দেশনা দিচ্ছে আর শিল্পীগণ সেই মতো কাজ করছে। কোনো এনজি শট যেন (নট গুড শট) হতে দেবে না তারা, সেই পণ করে শুটিংয়ে নেমেছে। আমিও ক্যামেরাকে বার্সট মুডে রেখে শাটার বাটন চেপে ধরেছি, সাধারণত চলমান বস্তুর ছবি তুলতে এ অপশন বেশ কার্যকর। বালকগুলোর বেশ কিছু ছবি তুলে চলে আসছি এমন সময় ওদের মধ্য থেকে একজন (ওরা সেতুর ওপরে ছিল,আমরা নিচে) চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ফেসবুকে দিয়ে দিয়েন।’ স্থানীয় কয়েকজন আড্ডারত তরুণ ওর এই পাকামো দেখে আমাদের চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসে। ইঁচড়েপাকা একটা — কৌতুক মেশানো মুচকি হাসিতে তরুণেরা এ কথাই যেন বলতে চাইল ।

মিরকাদিম সেতুর নিচের খালটায় খুব বেশি পানি নেই। তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে বোধহয়। নইলে পানি এত কম থাকার কথা নয়। ভরা বর্ষায় পানি কম থাকলে শুকনো মৌসুমে কী হয় কে জানে। শহরের খালগুলোর কথা বাদই দিলাম, পল্লীর খালগুলোরও আজ এমন করুণ দশা! দখল-দূষণে জেরবার অবস্থা। হরিলুটের বাতাসার মতো যে যেভাবে পারছে, লুট করছে। যার যত পেশি শক্তি, তার তত দখলে মুনশিয়ানা। খালগুলোর ড্রেজিং হয় না ঠিক মতো,বরাদ্দ পেলেও না। দায়সারা গোছের কাজ-কারবার করে টাকা তুলে নিয়ে পগারপার। কিছু কিছু জায়গায় খালগুলো ভরাট করে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো রাস্তায় কালভার্ট থাকা সত্ত্বেও পানি সরার জন্য কোনো জায়গা নেই; দুপাশেই মাটিভরাট করে বাড়িঘর কিংবা কোনো না কোনো স্থাপনা তৈরি করা আছে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, এসব অকেজো কালভার্ট মেরামতের জন্য আবার বরাদ্দও আসে মাঝেমধ্যে। অদরকারী এসব কালভার্ট ভেঙে মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করে নিলেই হয়, কিন্তু সেদিকে সংশ্লিষ্টদের মন নেই ।

গাড়িতে ফেরার সময় খালের পাড়ে কচুরির ভিটায় হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল। সেখানে একটা কানিবক দাঁড়িয়ে আছে। তপস্যা করছে মাছের ধান্দায়। ভিটার গা ঘেঁষে খালের পানি নেমে যাওয়ার সময় সামান্য বাধা পেয়ে বিচিত্র নকশা তৈরি করে কুল কুল শব্দ তুলে বিরামহীন বয়ে চলেছে গন্তব্যে। কী মাছ যেন দেখে কানিবকটা নড়েচড়ে ওঠল। বোধহয় প্রস্তুতি ছিল না — ছো মারবে। কোনো কারণে মনোযোগ হারিয়েছিল। তাই সুবিধা করতে না পেরে সামান্য নড়ে শুধু জায়গা বদল করল । দেখতে না দেখতেই একটা পুঁটি মাছ টুপ করে ঠোঁটে গুজে দুপা পেছনে টেনে দূর দিগন্তে হারিয়ে গেল ধবধবে শাদা পাখিটা। যতদূর দেখা গেল অভিভূতের ন্যায় চেয়ে চেয়ে দেখলাম।

আমাদের পাড়ায় মাঠের ধারে বলরাম দাদাদের বাঁশঝাড়ে বকপাখি কলোনি করে থাকত। প্রজনন ঋতুতে বাসা বাঁধত। ছেলেবেলায় এক বর্ষায় শখ করে আমার পরপর বড় দু’ভাই বকের ছানা এনে দিয়েছিলেন পোষতে। পেলে-পুষে বড় করার চেষ্টা করেছিলাম ছানাটিকে। রঙের প্লাস্টিকের কৌটোয় খরকুটো জড়ো করে ছানাটিকে থাকতে দিয়েছিলাম। রোজ নিয়ম করে মাছ খাওয়াতাম। ঠোঁট দুটো হা করিয়ে মাছ পুরে দিতাম। এমন সেবা-যত্নে কিছুদিন চলল। এইভাবে আমার আদর-আপ্যায়ন পেয়ে পেয়ে শেষে একদিন মারা পড়ল। মরা ছানাটিকে নিয়ে এক নতুন খেলায় মেতে ওঠেছিলাম; মাটি খুঁড়ে মানুষের কবরের মতো সমাহিত করে সমবয়সীদের নিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে তোবারক হিসেবে লজেন্স বিতরণ করেছিলাম। 

কিছুদিন আগে স্কুলে আমার ক্লাসে দুই ডানপিটে ছাত্র কোথা থেকে যেন এক কানিবক ধরে এনেছে। সম্ভবত পাশের ডোবা থেকে ঢিল ছুড়ে আহত করে নিয়ে এসেছে। ভেবেছিল ওদের বীরত্বে বেশ বাহবা দেব। উল্টো ওদের অবাক করে দিয়ে বললাম, ‘এটা আমি ছেড়ে দেব।’ ওদের রক্তাভ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, ভেতরে ভেতরে বেশ চটেছে; শুধু শিক্ষক বলেই কিছু বলতে পারছে না। বলবেই বা কী করে, ওদের সকলের সঙ্গেই আমার স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক। তা ছাড়া কানিবকটি নিয়ে যে পালাবে, সে সুযোগটিও আমি রাখিনি। ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব আমি তখনই করেছি, যখন কানিবকটি আমার অধিকারে নিয়েছি, মানে আমার হাতে নেওয়ার পরে বলেছি। কিন্তু নচ্ছার কানিবকটার যেন সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, বারকয়েক আমার আঙুল ঠুকরে দিল। ওই ছাত্র দুজনকে সঙ্গে করে আরও কিছু ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে শেষে কানিবকটা ছেড়ে দিই। সকলের সঙ্গে ওরা দুজনও তখন হাত তালি দিয়ে ওঠল। যাক, ছেলেবেলায় বকের ছানা পুষতে গিয়ে যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ হলো বোধ হয়।

গাড়িটির কাছে আসতেই দেখি খুব হল্লা হচ্ছে। একজনের হাত থেকে নিয়ে অন্যজন কোমলপানীয় খাচ্ছে, এভাবে একেকজনের হাত ঘুরে ঘুরে অন্যজনের হাতে আসছে। জুয়েল এবার এক কাণ্ড করে বসে, বিপ্লবের টেকো মাথায় সামান্য কোমলপানীয় ঢেলে  দেয়। বিপ্লবের বিব্রত-লাজুক মুখ দেখে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে, হাসির দমকে জুয়েলের মুখের সাথে তার (জুয়েলের) ক্রমবর্ধমান ভুড়ি খিলখিলিয়ে হাসে। হাসির প্রাবল্য জুয়েলেরই বেশি, কারণ বোধহয় বিপ্লবের বিব্রত মুখের কৃতিত্বের দাবিদার সে, হয়তো মনে মনে বন্য আনন্দও পেয়েছে কিছুটা। সকলের হাত ঘুরে কোমলপানীয়ের বোতল যখন বিপ্লবের হাতে আসে, তখন সে ঠোঁট চোখা করে মুখ থেকে সামান্য কোমলপানীয় জুয়েলের গায়ে ছুড়ে মারে। বিপ্লবের অভাবিত এমন আচমকা আচরণে ওদের মধ্যে আরও তীব্র বেগে হাসির রোল পড়ে যায়। জুয়েল ভ্যাবাচেকা খেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। সব বুড়ো হাবড়াদের মনের মধ্যেই বুঝি ছেলেমানুষী খেলা করে, নাহলে নিজেদের বয়স ভুলে বাচ্চা ছেলেপিলেদের মতো করতে যাবে কেন?

নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে হানিফও ওদের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেছে। হরবড় করে কথা বলছে। এটা হানিফের স্বাভাবিক অবস্থা নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় সে চুপচাপ, কথা কম বলা লোক। গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন থাকলে সে হরবড় করে কথা বলে, হাসিতে কলকলিয়ে ওঠে, ফুর্তির আতিশয্যে সে মেতে ওঠে। সে যখন স্বভাব বিরুদ্ধ আনন্দে উত্তেজিত থাকে, তখন বুঝতে হবে কোনো গুরুতর বিষয় নিয়ে ভাবছে, মনে মনে কোনো অঙ্ক কষছে। গরুর খামার দেখে এসে নিশ্চয়ই সে ভাবনায় হিসেবের টালিখাতা খুলে বসেছে। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে হিসেব মেলাচ্ছে। মনের ভেতর ঘটে যাওয়া এসব লুকোতেই বোধহয় সে এমন আচরণ করছে সচেতনভাবে অথবা অবচেতনে।

মুুন্সীগঞ্জ শহরে যাওয়ার পথে দূর থেকে বহুবার পানের বরজ দেখেছি। অনেক দিনের সাধ ভেতরে গিয়ে দেখি। আজ সে সুযোগ পেয়েছি, হাতছাড়া কেন করব? মিরকাদিম সেতুর (পানাম-পুলঘাটা সেতুর) কাছে মিরকাদিম-আব্দুল্লাহপুর রোড হয়ে হাতিমারার দিকে যেতে পথের ডান পাশে কয়েকটি পানের বরজ। হানিফ আর আমি এর একটিতে ঢুকব। অন্য সঙ্গীদের সাধলে অসম্মতি জানায়। জুয়েলকে এক প্রকার জোর-জবরদস্তি করেই সঙ্গে নিলাম। বিপ্লব, হাসপি ও ড্রাইভার ছোঁড়াটা গাড়িতে বসে রইল। গরম আর হৈ-হুল্লোরে একরকম কাবু হয়ে পড়েছে ওরা। 

পানের বরজে ঢুকে আমার এত দিনের সাধ মিটল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে থাকলাম। চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কীভাবে সাজানো হয়েছে বরজটাকে। কী তার চাষপদ্ধতি, সবই খেয়াল করলাম। প্রতিটি পানের পাতা রোদের আলোয় ঝকমকিয়ে ওঠছিল। পাতাগুলো তখনো পরিণত হয়নি, তুলবার মতো বয়স হয়নি। নবীন পাতাগুলো নতুন-ঘাসসবুজ, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পাতাগুলো ঘনসবুজ। প্রতিটি পানলতা বাঁশ কাঠির সাথে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ওপরে বেয়ে বেয়ে ওঠার জন্য। কী সুন্দর সারিবদ্ধ তার বিন্যাস! এর কয়েকটি পাতায় আমি হাত বুলালাম, এর শিরা-উপশিরায় আমার হাতের আঙুল চালালাম। আঙুলের ডগা ভেদ করে এর সকল রস-সজীবতা যেন আমাতে প্রবেশ করে শিরা-উপশিরায় পৌঁছে গিয়ে আমাকে চঞ্চল করে তুলল। আমি এখন ক্ষুধা-তৃঞ্চা ভুলে আরও বেশি চনমনে-উদ্যমী। কোনো কষ্ট-পরিশ্রম-কায়-ক্লেশ এখন আর আমাকে দমাতে পারবে না। দরদর করে ঘাম বের হবে, মাথা ভিজে যাবে, ভিজে জামা-কাপড় শরীরে লেপ্টে থাকবে, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইলেও আজ আমি নির্জীব-নিস্প্রভ হয়ে বসে থাকব না। আজ আমি প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের রস অকৃপণ চিত্তে গ্রহণ করব।

আমার জানামতে লৌহজংয়ে পানের বরজ নেই। মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ি, শ্রীনগর ও সিরাজদিখানে পানের চাষ হয়। গজারিয়ায় হয় কি না জানা নেই। দেখলাম বরজকে প্রবল বাতাস ও আলো থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে পাট কাঠির বেড়া দেওয়া হয়েছে। বাঁশের মাচার ওপর ছন আর খড়-কুটো দিয়ে ছাউনি তৈরি করা হয়েছে, সরাসরি সূর্যের আলো যেন পানগাছে না পড়ে। আমরা ছবি তুলব, বারবার আলো ওঠা-নামা করছে, মুখের ওপর পানপাতার ছায়া পড়ছে। চারদিকে বেড়াবেষ্টিত থাকায় গুমোট গরম লাগছে, কিন্তু সেদিকে আমি পাত্তা দিচ্ছি না । আজ আমার চনমনে থাকার দিন। বরজের মালিকের দেখা পাইনি। অনুমতি নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। দ্বিধায় ছিলাম, কেউ কিছু বলে কি না। তিনজন একসঙ্গে ছবি তুলব, কিন্তু তুলে দেবে কে? হাসপি তো সঙ্গে আসেনি। তাই সেলফিই ভরসা। একটা সেলফি তুলব ক্যামেরায় মুখ রেখেছি এমন সময় হাতদুয়েক দূরে কতগুলো পানপাতা একসঙ্গে শনশন শব্দে দুলে ওঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জুয়েল আমার গায়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের তিনজনেরই দৃষ্টি সেদিকে। দেখি ক্ষিপ্র গতিতে একটা বেজি আমাদের পায়ের প্রায় কাছ দিয়ে রাগত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে শরীরের লোমগুলো ফুলিয়ে তেজি ঘোড়ার মতো দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, জুয়েল পলো শার্টের বোতাম খুলে তিনবার শব্দ করে বুকে থুথু দিল, হানিফ কী করবে ভেবে না পেয়ে দুটো পানপাতা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে দ্রুত মুখে পুরে দিল, আর ভয় কাটাতে হরবড় করে কথা বলা শুরু করল। (চলবে)

 

'বিক্রমপুরের হিরা-মানিক খোঁজে' পূর্ববর্তী পর্বের লিংকগুলো পেতে নিচে ক্লিক করুনঃ

(পর্ব-১)  https://cutt.ly/RQSRLZS

(পর্ব-২)  https://cutt.ly/PQSR6Ue

(পর্ব-৩)  https://cutt.ly/3QSTfo7

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত