পদ্মা সেতু দেশের অনন্য অর্জন

  এম আর ফারজানা

প্রকাশ: ১ জুন ২০২২, ১৪:০৪ |  আপডেট  : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৩২

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন। একটা বৃহত্তর প্রজেক্ট। ছিল স্বপ্ন, হয়েছে বাস্তব। বিশ্বের অনেক বড় সেতুর মধ্যে এখন পদ্মা সেতুও অন্যতম। এই সেতু করা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল, একটা প্রতিবাদ ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারা পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। প্রস্তাব দেয় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার। কিন্তু বনিবনা না হওয়ার ফলে দুর্নীতির অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে মামলা হয় কানাডার আদালতে। সমালোচনার মুখে তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন তার মন্ত্রিত্ব হারান। কিন্তু মামলায় জয়ী হয় বাংলাদেশ। কোনো প্রকার দুর্নীতির অভিযোগ পায় না তারা। সারা বিশ্ব দেখে, আসলে এটা ছিল একটা জাল বিছানো চক্রের কারসাজি। দেশের ভেতরের কিছু মানুষ, বাইরের দেশের কিছু মানুষ কখনোই চায়নি এই সেতু হোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন। বললেন, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করব এবং তিনি করে দেখালেন পুরো বিশ্বকে। আজ পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী প্রায়। এই সেতু চালু হচ্ছে জুন মাসেই।

পদ্মা সেতু নির্মাণে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির। এতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা প্রায়। যদিও প্রথম দিকে শুধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল কিন্তু পরে রেলের নকশাও সংযোজন করা হয়। সমালোচকেরা বলছে, অন্যান্য দেশে তো এমন সেতু করতে এত ব্যয় হয়নি? কিন্তু এটাও ভাবতে হবে, আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া, পরিবেশ অন্য দেশের মতো নয়। পদ্মা সেতুর ভিত এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে সাত-আট মাত্রার ভূমিকম্প হলেও যেন তার আঁচড় না পড়ে সেতুর ওপর। এই সেতু টিকে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী বিশেষজ্ঞদের মতে, কাজ শুরুর প্রথম দিকে তারা পদ্মা সেতুর তলদেশে স্বাভাবিক মাটি খুঁজে পাননি, যা সেতুর জন্য উপযুক্ত ছিল। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা দেয়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটি বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার বসানোর চেষ্টা করেন। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়। ফলে মাটি লোড বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে এবং গাঁথা হয় পিলার।

এই পদ্ধতির ব্যবহার বিশ্বে তেমন একটা নেই এবং বাংলাদেশেও এই প্রথম। ফলে ব্যয়ও বেড়ে যায়। পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং ছয়টি। মোট পাইলিং সংখ্যা ২৬৪। সেতুর পিলার সংখ্যা ৪২। তা ছাড়া খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা। আর বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় এত বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ বলা হচ্ছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, যত গুড় তত মিষ্টি। অর্থাৎ সেতু বলেন আর বাড়ি বলেন, মূল ভিত্তি যত মজবুত হবে, ততই শক্তিশালী হবে ভিত। বাড়ি করার সময় আমরা ফাউন্ডেশন মজবুত করে দিতে চাই, যাতে শত শত বছর বাড়িটি টিকে থাকে। তেমনিভাবে বৃহত্তর এই সেতুর গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। সমালোচনা করা সহজ কিন্তু বাংলাদেশের মতো এমন একটা মধ্যম আয়ের দেশ এমন সেতু করতে পারবে, তা কেউ ভাবতেই পারেনি। কারণ, এই পদ্মা সেতু এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক সেতুর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ। এটা বাংলাদেশের একটা অনন্য অর্জন।

একাগ্রতা থাকলে, আন্তরিকতা থাকলে, ধৈর্য থাকলে কাজে সফল হওয়া যায়। একসময় যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তিরস্কার করেছে, তারাও জানল বাংলাদেশ এখন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে জানে। মেরুদণ্ড শক্ত করে প্রতিবাদ করতে জানে। পদ্মা সেতু হয়েছে বলেই ভবিষ্যতে আমরা আরো অনেক বড় বড় এমন প্রকল্প হাতে নিতে সাহস পাব। আসলে একবার সাহস করে ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দেখা যায় অনেক কাজ করা যায়। আমরা পারব, এই মনোবল কিন্তু তৈরি হয়েছে। এই সেতু অনেক বাধা পেরিয়ে আজ দৃশ্যমান। দ্বিতল এই সেতুতে ২২ মিটার প্রশস্ত চারটি লেনে যানবাহন চলতে পারবে। মূলত পদ্মা সেতু একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। আর রেল চলবে এক লাইনে, তবে ওই এক লাইনেই মিটারগেজ, ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলাচল করতে পারবে। কত গভীরতায় কত মাপে তৈরি হলো তারচেয়ে বড় কথা জীবনের গভীরতা যেন এই সেতুর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আমি টাকার চেয়ে ভাবছি সেই অঞ্চলের মানুষগুলোর কথা, তাদের জীবনযাত্রার কথা। একজন অসুস্থ, মুমূর্ষু রোগী নিয়ে পদ্মা পার হতে গিয়ে কত ভোগান্তি, সময় ব্যয়। অনেকে তো এ জন্য তাদের আপনজনও হারিয়েছে। তাই পদ্মা সেতুর ফলে এখন খুব দ্রুত যেতে পারবে। সময়, ভোগান্তি থেকে বাঁচবে। এটা দেশের সম্পদ,এটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে, পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে মোটরসাইকেলে ১০০ টাকা, কার বা জিপে ৭৫০ টাকা, পিকআপে ১ হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসে ১ হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) ২ হাজার টাকা, বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাকে লাগবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া ছোট ট্রাকে (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (৫ টনের বেশি থেকে ৮ টন) ২ হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (৮ টনের বেশি থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা ও ট্রেইলার (৪ এক্সেলের বেশি) ৬ হাজারের সঙ্গে প্রতি এক্সেলে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে যোগ করে টোল দিতে হবে।

এই টোল নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বিরোধিতা করছে অনেকে। যারা এর বিরোধিতা করছে, তারা শুধু বিরোধিতার জন্যই তা করছে। তারা মানুষের জীবনযাত্রার সুবিধার কথা ভাবছে না। অনেকে বলেছে, টোল দেবে কেন? আচ্ছা, আপনারা যখন ইঞ্জিনচালিত বোটে করে বা লঞ্চে করে পদ্মা পার হতেন, তখন কি ভাড়া দিতেন না? তখন কি টাকা খরচ হয়নি? হয়েছে। তাহলে এখন দিতে সমস্যা কোথায়? আপনাকে ভাবতে হবে উন্নত জীবনের সুবিধা পেতে হলে সেটার জন্য খরচও আছে। বিদেশে শুধু বড় বড় সেতুতেই টোল দেয় না, হাইওয়েতেও টোল দেয়। দিতে বাধ্য। সরকারিভাবে নির্ধারণ করা থাকে। হ্যাঁ, আপনি চাইলে অনুরোধ করতে পারেন যে টোল সীমিত আকারে কমাতে পারে। কিন্তু টোল দিতে নারাজ আবার চাইবেন উন্নত ব্রিজ, তা কী করে সম্ভব? নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সি যে ভ্যারাইজোন ব্রিজ, সেখানেও টোল দিতে হয়। আমেরিকার প্রতিটি শহরেই বড় বড় ব্রিজ ও হাইওয়েতে টোল বাধ্যতামূলক। আমি চাইব আমার দেশ উন্নত হোক কিন্তু নাগরিক হিসেবে টোল দেব না কেন? অনেকে বলছেন, নিজের টাকায়, তাহলে কেন টোলের প্রশ্ন। নিজের টাকায় হোক বা লোনের টাকায়, সেতু করতে তো খরচ হয়েছে, সেটা আমাদের দিতে হবে। আপনি সেতুর সুবিধা পাবেন আর টোল দেবেন না, তা হয় কী করে। আপনি যখন হিসাব করেন ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার, আমি তখন ভাবি এই সেতুর ফলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুতে যখন যান চলাচল শুরু হবে, তখন সড়কপথে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি ২১ জেলার মানুষের যোগাযোগ তৈরি হবে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি হবে। কৃষিতে সাড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এর প্রভাব সারা দেশেই পড়বে। একজন কৃষক তার কৃষিপণ্য অনায়াসে পৌঁছে দিতে পারবেন রাজধানী বা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে। তাকে সকালের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে আর বলতে হবে না, সূর্য হেলে দুপুর তো হয়ে গেল, এখনো পদ্মা পার হইতে পারলাম না। যাবই-বা কখন আর ফেরবই-বা কখন। এই সেতুর ফলে সে এখন নিশ্চিত আর যা-ই হোক তার সময় বাঁচবে।

সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সকালের হাটে ঠিকভাবে না পৌঁছালে কিংবা বিকালের বাজার না ধরতে পারলে পণ্য বিক্রি করা কঠিন হয়ে যায়। ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদা অনুসারে যে সময়কে সঠিকভাবে ধরতে পারে, সে-ই তার ব্যবসায় সফল হয়। পদ্মা সেতুর ফলে এই সময়টাকেই আঁকড়ে ধরতে পারবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা। এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা। আর পণ্য চাহিদামতো বিক্রি হলে দারিদ্র্যের হারও কমবে সে অঞ্চলের মানুষদের। একজন কৃষক বাঁচবে, একজন ব্যবসায়ী বাঁচবে, তাদের চোখে যে স্বপ্ন ছিল, তা এখন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে। আর পদ্মা সেতুর সাথে রেলপথও সংযুক্ত। পদ্মার একেকটা প্রবল ঢেউ এসে পাড় ভাঙে। আমরা পাড় ভাঙার শব্দ শুনি। সেই সাথে ভাঙে পদ্মাপাড়ের মানুষের ঘরবাড়ি। ভাঙে মানুষের স্বপ্ন। বুকের গহিনে চাপা কান্নার শব্দ আমরা শুনতে পাই না। মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পদ্মার পাড়ের মানুষেরা জানে, পদ্মার এই জোয়ার-ভাটার খেলায় কত জীবন, কত প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে। চোখের সামনে তলিয়ে যায় কত কিছু। অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়েছে কত জীবন, মুহূর্তেই যেন জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। দিশেহারা হয়েছে পদ্মাপাড়ের মানুষেরা। তাই তো শিল্পী দুঃখ করে দরদভরা কণ্ঠে গেয়েছেন ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই বল আমারে তোর কি রে আর কূলকিনারা নাই’। আসলেই পদ্মা সর্বনাশা। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়, একটি স্বপ্ন, জীবনযাত্রার সোপান বলা যায়। তাদের কাছে এই সেতু অপরিহার্য। অনেকে অর্থের হিসাব কষছে, কত শ্রমিক কাজ করল দেখছে আর আমি দেখছি সেখানকার মানুষের দুই পাড়ের সংযোগ।

এই সংযোগের ফলে সেতুকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে এপার-ওপার ভিত মজবুত করা নানা রকমের বাড়িঘর, দোকানপাট। এই সেতুর ফলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি সাধন হবে নিঃসন্দেহে। অনেকে ব্যবসায় নামবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চাইলে সেখানকার মানুষেরা তাদের চাহিদামতো রাজধানীর সাথে ব্যবসার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে পারবে, যা ছিল অতীতে স্বপ্ন আর কল্পনা। আসলে একটা দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্ক। এই পদ্মা সেতু অনেক সমস্যার সমাধান করে দেবে।

ভবিষ্যতে হয়তো কোনো কবি-লেখক এই পদ্মা সেতু দিয়ে চলতে গিয়ে রচনা করবে কবিতা, গান, গল্প। দেখবে একটা ঢেউ কীভাবে এসে আরেকটা ঢেউয়ের সাথে মিশে যায়। শুনবে পদ্মার গর্জন। চলার পথে হয়তো কোনো প্রেমিক তার প্রেয়সীকে নিয়ে সেলফি তোলায় মত্ত হবে। বলবে, দেখো, এই পদ্মা পার হতে গিয়ে কত না ভোগান্তি পেয়েছি, আজ তার ওপর দিয়ে চলেছি। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ, ভালো থাকুক দেশের মানুষÑএই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : কলামিস্ট, নিউজার্সি।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত