পঞ্চগড়ে মানবতার ফেরিওয়ালা মতিন এখন আলোচিত মানুষ
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:৪৮ | আপডেট : ৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৯
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট একটি টং দোকান। তবে সাইন বোর্ডে বড় করে লেখা “মানবতার দেয়াল”। কাছে যেতেই দেখা গেল, এটি আসলে বিনামুল্যের পোশাক আর কাপড়ের দোকান। এখান থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের চাহিদামত বই, খাতা, কলম এবং দুঃস্থদের প্রয়োজনীয় নতুন-পুরাতন কাপড় বিনামুল্যে দেওয়া হচ্ছে। মাসব্যাপি এই মানবাতার দেয়াল থেকে ৩৪০ শিক্ষার্থী বইপত্র এবং পাঁচ শতাধীক দুঃস্থ মানুষ শার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার, শাড়ি, লুঙ্গিসহ বিভিন্ন পোশাক নিয়েছেন।
সরেজমিনে উক্ত ময়দানদীঘি ইউনিয়নের প গড়-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক ঘেঁষে দোকানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন দুস্থ নিজেদের জন্য কাপড় পছন্দ করছেন। এদের মধ্যে স্থানীয় জয়নুল ইসলাম নামে একজন নিজের জন্য একটি প্যান্ট পছন্দ করলেন এবং তার হাতে যত্নসহকারে স্বেচ্ছাসেবীরা প্যান্টটি তুলে দিলেন। একই সাথে আরও দুই শিক্ষার্থী একটি করে গল্পের বই নিলেন। পছন্দের পোশাক খুঁজে দেখছিলেন ময়দানদীঘি এলাকার নুর ইসলামের স্ত্রী জান্নাতুন নাহার।স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মানবতার দেয়ালের উদ্যোক্তা মতিন ইসলাম একজন হোটেল বয়। ময়দানদীঘি বাজারের একটি হোটেলে সকাল সন্ধ্যা বয় এর কাজ করে। ময়দানদীঘি হলদিয়া পুকুর এলাকার অতি দ্ররিদ্র ঘরের সন্তান মতিন হোটেলে কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়াও করে। বর্তমানে সে পঞ্চগড় সদরের জগদল ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। হোটেলে কাজ আর লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোট থেকেই মতিন মানবসেবার চেষ্টা করতো। ২০২১ সালের ১৪ জুন ‘আত্মার বন্ধন ব্লাড ফাউন্ডেশন’ নামে একটি রক্তদানের সংগঠন গড়ে তুলে। এই সংগঠনের অর্ধশত সদস্য জেলা বিভিন্ন এলাকাসহ জেলার বাইরেও দুঃস্থ রোগীদের বিনামুল্যে রক্তদান করে। সংগঠনটি বছরজুড়ে বিনামুল্যে রক্তের গ্রুপিং, রক্তদান, মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা ক্যাম্পেইন, রমজান মাসে ইফতার বিতরণ, প্রতি ঈদে দুঃস্থদের মাঝে ঈদ উপহার বিতরণ, ২১ ফেব্রয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসেও নানা কর্মসূচী পালন করে। সংগঠনের সদস্যরা তাদের নিজেদের চাঁদা, উপদেষ্টাদের আর্থিক সহায়তা ছাড়াও স্থানীয় মানুষ নানাভাবে তাদের এমন উদ্যোগে সহায়তা করেন।
এর ধারাবাহিকতায় গত ৬ নভেম্বর থেকে অপ্রয়োজনীয় পোশাক ও বইপত্র দিয়ে যান এবং প্রয়োজনীয় পোশাক ও বইপত্র নিয়ে যান শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় মাসব্যাপি ‘মানবতার দেয়াল’ ক্যাম্পেইন শুরু করে সংগঠনটি। মাসজুড়ে মানবতার দেয়ালে স্থানীয় ৩৬ জন তাদের অপ্রয়োজনীয় পোশাক এবং বইপত্র জমা দেন। সংগঠনের সদস্যরা মধ্যে নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত পন্য বিতরণ করে। বুধবার (৬ ডিসেম্বর) এক মাসের এই ক্যাম্পেইন শেষ হয়।
ময়দানদীঘি এলাকার বগুড়া হেয়ার কাটিং সেলুন এর সত্বাধিকারী পবিত্র দাস বলেন, মতিন গরীব হলেও সেবামুলক কাজ করে। সে কারো বিপদ শুনলেই ছুটে যায় এবং নানাভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করে। আমরা দেখতেছি একমাস ধরে এই দোকান থেকে অনেকেই বিনামুল্যে কাপড় এবং বইখাতা নিয়ে যান।ময়দানদীঘি এলাকার জাম্বুরা পাড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেনের স্ত্রী নুরিমা আকতার বলেন, সংগঠনের সদস্যরা সকলেই মানবিক কাজ করে। যাদের রক্ত লাগে, তাদের বিনামুল্যে রক্ত দেয়। শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করে। তারা একেক জনের কাছে নিয়ে আবার দুস্থদের কাছে বিতরণ করে।সংগঠনের সদস্য ও ময়দানদিঘী ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ইতি আক্তার বলেন, আমি তিন মাস হলো সংগঠনের সাথে কাজ করছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের অপ্রয়োজনীয় পোষাক এখানে দেই। যাদের প্রয়োজন হয় তারা সেই পোশাক নিয়ে যান। মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পারছি, এজন্য মনে সময় সময় আনন্দ লেগে থাকে।আরেক সদস্য ও একই কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব ইসলাম বলেন, সংগঠনের সদস্য ছাড়াও উপদেষ্টা এবং স্থানীয় মানুষরা আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেন। এজন্য আমরা মাসব্যাপি মানবতার দেয়াল নামে আমাদের ক্যাম্পেইন চালু রাখতে পেরেছি।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বছর জুড়েই আমাদের মানব সেবামুলক বিভিন্ন কর্মসূচি থাকে। আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নতুন প্রজন্মের জন্য বীরত্বগাঁথা অনুষ্ঠানের পরিকছল্পনা রয়েছে। এছাড়া দুই এক দিনের মধ্যে দুঃস্থদের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ শুরু করা হবে। আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শীত বস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম এর সমাপ্ত করা হবে।।
আত্মার বন্ধন ব্লাড ফাউন্ডেশন এর সভাপতি মতিন ইসলাম বলেন, আমার বাবা একজন দিনমুজুর। সংসারে অভাব আছে। এজন্য হোটেলে কাজ করি। সেই আয় দিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারে দেই। গরীব হলেও ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু একটা করার জন্য ছটফট করতাম। দুঃস্থ মানুষদের দুঃখকষ্ট সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেতো। এজন্য তিন বছর আগে মিলন রানাসহ সংগঠনটি গড়ে তুলি। আমি প্রায় প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১২ এবং বিকাল ৪ টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত হোটেলে কাজ করি। সেই আয়ের কিছু অংশ সংগঠনের কাজেও ব্যায় করি। মানুষের উপকারে কিছু একটা করতে পারলেই মনে শান্তি লাগে। আমাদের সদস্যরাও বেশ উদ্যোগী এবং আন্তরিক। আমরা এভাবেই চলতে চাই, মানুষের সেবায় থাকতে চাই।
ই
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত