ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কার্বন বাজার উন্মুক্ত করণের ওপর প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩ এপ্রিল ২০২১, ২২:১২ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৭

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়-ক্ষতি রোধের উপায় খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার উন্মুক্ত করণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

বিখ্যাত ‘ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগজিনে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘ঢাকা-গ্লাসগো সিভিএফ-সিওপি২৬ সংহতি জোরদার’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তিনি এ গুরুত্বারোপ করেন। ম্যাগাজিনটির এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত এই নিবন্ধে শেখ হাসিনা প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে অর্থবহ করে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

নিবন্ধে তিনি আরো লিখেন, কান্তিকালীন জলবায়ু সহযোগিতা জোরদার এবং ক্ষয় ক্ষতি ও জলবায়ুর অবিচার রোধের উপায় খুঁজে বের করতে আমরা উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক কার্বন কার্বন বাজার দেখতে চাই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-এর সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মতো সিভিএফের প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রেরই বলার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপূরণীয় ক্ষয় ক্ষতির কথা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, কিন্তু এসব দেশ বৈশ্বৈক কার্বন নিঃস্বরনে খুব কমই ভূমিকা রাখছে। জলবায়ুর এই অবিচার দূর করার সময় এখনই। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সকলে এক জোট না হলে আমরা হেরে যাব।

তিনি বলেন, মানুষ সচেতনভাবে আমাদের বেঁচে থাকার সহায়ক পরিবেশ ধ্বংস করছে। তিনি বলেন, আমরা গ্রেটা থুনবার্গ কিংবা বাংলাদেশ কোস্টাল ইয়ুথ একশান হাবের লোকজনের জন্যে কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি? সিওপি২৬-এর বিষয়ে আমরা তাদের ব্যর্থ করে দিতে পারি না।

শেখ হাসিনা আরো বলেন, আমরা জলবায়ু তহবিল অবমুক্ত দেখতে চাই। আর তা কেবল কম কার্বন নিঃস্বরনকারী দেশগুলোর জন্যে নয় বরং অঙ্গীকারকৃত ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড় এবং এর ৫০ শতাংশ জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরির জন্যে ব্যয় করা হোক। তিনি বলেন, সিভিপি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১শ’ কোটিরও বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব করছে। সমুদ্র স্তরের সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন ঘুর্ণিঝড় ও দ্রুত মরুকরণের কারণে এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

তিনি বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে বলেন, এই দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের ক্ষেত্রে প্রায়শই ‘গ্রাউন্ড জিরো’ হিসেবে উল্লেখিত হয়। এখানে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের কোটি কোটি সাহসী ও সহিষ্ণু জনগণের অস্তিত্বের লড়াই যাদের বাড়িঘর, জমি ও শস্য প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক ক্রোধে ধ্বংস হচ্ছে।

তিনি তার লেখায় আরো বলেন, প্রতি বছর জিডিপি’র ২ শতাংশ চরম জলবায়ুর প্রভাজনিত কারণে ব্যয় হয়। শতাব্দী শেষে এটি ৯ শতাংশে দাঁড়াবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় ১৭ শতাংশেরও বেশি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এতে ৩ কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এছাড়া, কক্সবাজারের পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল্য দিয়ে এই দেশ এখনো মিয়ানামার থেকে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়দানের চাপ বহন করছে।‘এই ক্ষয় ক্ষতির মূল্য কে দেবে? প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ুর ওপর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়টিকে প্রাধান্য না দেয়ায়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তিতে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক তহবিল গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল- তা থেকে অর্থায়ন অনেক কম হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে কম-কার্বন নিঃসরণ প্রকল্পগুলোতে সহায়তা করতে কার্বন-মার্কেটে আর্থিক সহায়তা দিতে জি-২০ সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আর যেখানে কার্বন নিঃসরণ কমাতেই এদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, সেখানে ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এই জি-২০ সদস্য দেশগুলোই শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতটি ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’ এর মতো এসে পড়েছে। এর ফলে এখন বিশ্ববাসীর সামনে তিনটি মারাত্মক সমস্যার উদয় হয়েছে- জলবায়ু, স্বাস্থ্য ও প্রকৃতি। শেষ পর্যন্ত একটি অত্যন্ত কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব আমার এই সতর্কবার্তা আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে যে- জলবায়ু সংকট একটি অত্যন্ত গুরুতর ও জরুরি সমস্যা।

যে কোন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সবুজ, প্রকৃতি-বান্ধব ও টেকসই হতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফ সভাপতি হিসেবে এ লক্ষ্যে আমার প্রথম কাজ ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের বিষটিকে ‘বিশ্বের জন্য জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সে. এর মধ্যে রাখতে সকলের প্রতি ‘লড়াইয়ে অংশ’ নেয়ার আহ্বান জানানো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালের শরতকাল পর্যন্ত আমি খুব অল্প সংখ্যক এনডিসি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস) অবদান দেখেছি এবং কপ২৬ স্থগিত করা হয়। তাই আমি সিভিএফ লিডার্স সামিটে ‘মিডনাইট সারভাইভাল ডেডলাইন ফর দ্য ক্লাইমেট’ প্রস্তাব উত্থাপন করি।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎসাহব্যঞ্জক হিসেবে অভিহিত করেন।

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু যারা সিভিএফ’এর মধ্যরাতের ডেডলাইন পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন, আমি তাদের প্রতি কপ২৬-কে সামনে রেখে উচ্চাভিলাষী এনডিসি অবদান রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। বার্বাডোস, কোস্টারিকা ও মালদ্বীপসহ সিভিএফ এর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সদস্য-রাষ্ট্রসমূহ ২০৩০ সাল নাগাদ শূণ্যের কাছাকাছি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিভিএফ সদস্য-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে জনবহুল দেশ। বাংলাদেশ মিথেন নিঃসরণ হ্রাসে প্যারিস চুক্তির শর্তাবলী পূরণের পাশাপাশি অন্তবর্তীকালীন এনডিসি হালনাগাদ করেছে।

শেখ হাসিনা আরো বলেন, বাংলাদেশ ও সিভিএফ সদস্য দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের জনগণকে রক্ষায় অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাই আমাদের ‘টিকে থাকার জন্য’ টেকসই জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসে অর্থায়ন প্রাধান্য পাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘নিজেকে রক্ষা করুন’ এবং এ ব্যাপারে কারো জন্য অপেক্ষা করবেন না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতা আমাদের ‘ক্ষমা’ করবে না। জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর সরকারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরেই চ্যাম্পিয়ন হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, এর মূল কৃতিত্ব বিশেষত নারী ও তরুণদের।

সাইক্লেন আমফানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ৫ ক্যাটাগরির সাইক্লোনটি বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর আঘাত হানল, তখন মাত্র পাঁচ দিনেরও কম সময়ে বাংলাদেশ ২.৪ মিলিয়ন মানুষ ও ৫ লাখ গবাদী পশুকে নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছিল। একই বছর, মহামারির মধ্যেই আকস্মিক বন্যায় বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ স্থান পানিতে ডুবে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, এই দুটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে জিডিপি’র ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হলেও দুর্যোগ-পূর্ব সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতির ফলে বাংলাদেশ কয়েক লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নেই জলবায়ু প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে শিখেছে। সরকার ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। আমরা প্রতি বছর আমাদের ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপি থেকে গড়ে ২.৫% জলবায়ু পরিবর্তন সহনীয় টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য ব্যয় করছি।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১৬.৪ কি.মি. সমুদ্র তীরবর্তী বাঁধ নির্মাণ, ১২ হাজার সাইক্লোন আশ্রায়ন কেন্দ্র নির্মাণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে ২ লাখ হেক্টর জায়গায় বনায়ন করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশী বিজ্ঞানীরা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য লবনাক্ততা ও চাপ সহিষ্ণু শস্য উদ্ভাবন করেছেন। সরকার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জলাধার ও পুকুর-বালি-ফিল্টার, ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি ও ভ্রাম্যমান পানি শোধানাগার নির্মাণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা এখন জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবেলায় চাম্পিয়ন। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-শত বার্ষিকীতে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি ডিকেড ২০৩০’ নামকরণ করে অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সিভিএফ দেশগুলোর প্রতি ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান’ চালু করার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জলবায়ু পরিকল্পনার আওতায় ইতোমধ্যেই ১১.৫ মিলিয়ন গাছ লাগিয়েছি।

বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, একটি শক্তিশালী সিভিএফ-সিওপি সংহতি গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। নভেম্বরের সম্মেলনে আমরা একটি ঢাকা-গ্লাসগো-সিভিএফ-কপ২৬ ঘোষণা চাই। আমরা জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো কপ২৬ এর আগেই জি২০ দেশগুলোর পক্ষ থেকে উচ্চাভিলাষী এনডিসিএস শর্ত পূরণ দেখতে চাই।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত