নেতানিয়াহুর পক্ষাবলম্বন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২১, ১০:০৪ |  আপডেট  : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৪৩

যখন গাজা থেকে রকেট হামলার জবাবে ভয়াবহ সামরিক শক্তি ব্যবহার করছে ইসরাইল সরকার, তখন ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং রিপাবলিকান প্রশাসন- উভয়ের পক্ষ থেকেই এই শব্দগুলো উচ্চারণ করতে শুনতে পাই আমরা।

আসুন বিষয়টি পরিষ্কার হই। ইসরাইল বা অন্য কোনো সরকারের আত্মরক্ষার অধিকার নেই বা তার জনগণকে সুরক্ষিত রাখার অধিকার নেই এমন যুক্তি কেউই দিচ্ছেন না। তাহলে কেন বছরের পর বছর, যুদ্ধের পর যুদ্ধে এই শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে? কেন কখনোই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না যে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার কি?’ কেন তাহলে আমরা শুধু যখন ইসরাইলে রকেট পতিত হয় তখনই দৃশ্যত ইসরাইলে এবং ফিলিস্তিনে সহিংসতার বিষয়টি নোটিশ করি?

বর্তমান এই সঙ্কটময় মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো। আমাদেরকে এটাও অনুধাবন করা উচিত যে, ইসরাইলে হামাসের রকেট হামলা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আজকের এই লড়াই তো রকেট হামলা দিয়ে শুরু হয়নি। বছরে পর বছর ধরে জেরুজালেমের শেখ জারাহ বসতিতে থাকা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো উচ্ছেদ হুমকিতে রয়েছেন। তাদেরকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার এক আইনি ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে উগ্রপন্থি (ইহুদি) বসতি স্থাপনকারীরা তাদেরকে উচ্ছেদ করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

ট্রাজিক্যালি বা বিয়োগান্তক বিষয় হলো, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের বিস্তৃত ব্যবস্থার মাত্র একটি অংশ হলো এই উচ্ছেদ পরিকল্পনা। বছরে পর বছর ধরে আমরা পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলের দখলদারিত্বকে আরো গভীর হতে দেখছি। একই সঙ্গে তারা গাজার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে ব্লকেড বা অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সেখানে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের কাছে জীবন ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। গাজায় প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ তরুণ, যুবক বেকার। ভবিষ্যত নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আশা নেই বললেই চলে।
 
উপরন্তু আমরা দেখেছি ইসরাইলে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের একপেশে ও অসাড় করে দিতে দেখছি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারকে। তারা বসতি স্থাপন বিষয়ক নীতি এমনভাবে নিয়েছে যে, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা ছিল তা বন্ধ হচ্ছে। এ ছাড়া তার সরকার এমন সব আইন পাস করছে, যা ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমিকভাবে ইসরাইলে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।

হামাসের হামলার নেপথ্যে এর কোনটিই অজুহাত নয়। হামাস জেরুজালেমে অশান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। অথবা তারা ফিলিস্তিনের দুর্নীতিপরায়ণ এবং অকার্যকর সরকারের ব্যর্থতাকে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিন সরকার দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত নির্বাচন সম্প্রতি আবার স্থগিত করেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি ভূখ-ে একটি সার্বভৌম কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে ইসরাইল। তারা শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রস্তুতির চেয়ে অসমতা এবং অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে বিস্তৃত করেছে।

নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থি শাসন এক দশকেরও বেশি সময় বিদ্যমান ইসরাইলে। এ সময়ে নেতানিয়াহু ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং কর্তৃত্বপরায়ণ বর্ণবাদী জাতীয়তাকে লালনপালন করেছেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচারকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি উগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি ইতমার বেন গভির এবং উগ্রপন্থি জিউস পাওয়ার পার্টিসহ এসব শক্তিকে তার সরকারে নিয়েছেন এবং বৈধতা দিয়েছেন এ জন্যই। জেরুজালেমের রাস্তায় ফিলিস্তিনিদের ওপর যেসব বর্ণবাদী দাঙ্গাবাজ হামলা করেছে, হতাশাজনক ও দুঃখজনক হলো তারা আবার ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে প্রতিনিধিত্ব করছে।

এই বিপজ্জনক প্রবণতা ইসরাইলে ব্যতিক্রম কিছু নয়। বিশ্বজুড়ে, ইউরোপে, এশিয়ায়, দক্ষিণ আমেরিকায় এবং এখানে এই যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা দেখেছি একই রকম জাতীয়তাবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ মুভমেন্টের উত্থান। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উন্নতি, ন্যায়বিচার এবং শান্তি নিশ্চিত করার চেয়ে মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে এসব আন্দোলন বা মুভমেন্ট থেকে জাতিগত বা বর্ণবাদী ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হয়। গত চার বছরে এই মুভমেন্টকারীরা তাদের একজন বন্ধু পেয়েছিলেন হোয়াইট হাউজে।

একই সময়ে, আমরা নতুন একটি প্রজন্মের অধিকারকর্মীদের উত্থান দেখতে পাচ্ছি, যারা মানবিক প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চান। এসব অধিকারকর্মীদের আমরা দেখেছি গত গ্রীষ্মে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে জেগে উঠতে। আমরা তাদেরকে দেখছি ইসরাইলে। ফিলিস্তিনি ভূখন্ডেও তাদেরকে দেখছি আমরা।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন একজন নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায়। ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে নতুন একটি উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন একটি সুযোগ এসেছে। হতে পারে সেটা দরিদ্র দেশগুলোকে (করোনার) টিকা পেতে সাহায্য করা। হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া। হতে পারে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই। সংঘাতের বিরুদ্ধে সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমরা বছরে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দিই ইসরাইলকে। ফলে নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থি সরকার, তাদের অগণতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী আচরণের দায় আমরা আমরা বহন করতে পারি না। আমাদেরকে অবশ্যই এই ধারা পরিবর্তন করতে হবে এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। যে নিরপেক্ষ ভূমিকা বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত ও শক্তিশালী করে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন দিয়ে, সামরিক সহায়তা দিয়ে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দিতে পারি না আমরা।

অবশ্যই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে অবশ্যই বসবাস করার অধিকার আছে ইসরাইলের। একই রকম অধিকার অবশ্যই ফিলিস্তিনিদেরও আছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলিদের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে সহায়কের একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বমঞ্চে নিজেদেরকে মানবাধিকারের পক্ষের বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে

অব্যাহতভাবে তাকে অবশ্যই মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মান সমুন্নত রাখতে হবে, যদি সেটা কোনো রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতিতেও হয়। আমাদেরকে অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে স্বীকার করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের জীবনের দাম দিতে হবে।

(লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট থেকে ডেমোক্রেট দলের সিনেটর। তার এই লেখাটি অনলাইন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে অনুবাদ)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত