নির্বাচনের আগে নিজেদের দাবি আদায় করতে চায় হেফাজত
প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৯ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৮
কমিটি পুনর্গঠনের পর সংগঠনের কিছু দাবি নিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরির পরিকল্পনা করছে হেফাজতে ইসলাম। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে মামলা এবং কারাবন্দী নেতাদের মুক্তির বিষয়ে একটা সুরাহা চাইছেন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁরা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে চাপ তৈরি করা না গেলে সরকার বিষয়টি আমলে নেবে না।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সারা দেশের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা এবং বন্দীদের মুক্তি নিয়ে হেফাজতের নেতারা চাপে আছেন। এখনো সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা মামুনুল হক, মুনির হোসেন কাসেমী, নূর হোসাইন নূরানী, রফিকুল ইসলাম মাদানী কারাবন্দী। এর মধ্যে মামুনুল হকসহ কয়েকজন নেতার একাধিক মামলায় বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এসব মামলায় আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে গিয়ে নেতা-কর্মীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তাঁরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে মামলা এবং বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে দ্রুত সুরাহায় পৌঁছাতে চাইছেন। এ অংশ হেফাজতকে নতুন করে সংগঠিত করে মাঠের কর্মসূচিতে নামতে শীর্ষ নেতৃত্বকে তাগিদ দিচ্ছেন।
২০২০ সালের বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে গত ৩১ আগস্ট হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। সংগঠনের আমির আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ৫৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ এবং ২০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন। বিলুপ্ত কমিটির বেশির ভাগকেই নতুন কমিটিতে আগের পদে বা পদোন্নতি দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চাপের মধ্যেও হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব আজিজুল হককে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অন্তর্ভুক্ত করেই কমিটি চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এ জায়গায় স্থির থাকতে পারেনি হেফাজতের নেতৃত্ব।
যদিও পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কমিটিতে পুরোনোদের ফেরানো হলেও বিগত সময়ে কারাবন্দী ও নির্যাতিত অনেককে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীকে নায়েবে আমির ও সাখাওয়াত হোসাইন রাজিকে যুগ্ম মহাসচিব করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আফেন্দীকে যুগ্ম মহাসচিব ও সাখাওয়াত হোসাইনকে সহকারী মহাসচিব করা হয়।
আবার মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ, সালাহউদ্দিন নানুপুরী, খোবাইবসহ সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাউকে কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিতে হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে রাখা হয়নি। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানি ও তাঁর অনুসারী বলে পরিচিত মাঈনুদ্দীন রুহী, মুফতি ফয়জুল্লাহসহ অনেকে কমিটিতে জায়গা পাননি।
হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমিটি পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া শুরুর পর অনেকের দৃষ্টি ছিল সাংগঠনিক সম্পাদক পদটির দিকে। ২০২০ সালের বিলুপ্ত কমিটিতে এই পদে ছিলেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তার পরে এই পদে আসেন মাওলানা মীর ইদ্রিস। হেফাজতের নেতৃত্বের ওপর সংগঠনের ভেতর ও বাইরের চাপ ছিল সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক, বিলুপ্ত কমিটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী, সহকারী মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জীকে না ফেরানোর। যদিও আজিজুল হকসহ চারজনকেই কমিটিতে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চাপের মধ্যেও হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব আজিজুল হককে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অন্তর্ভুক্ত করেই কমিটি চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এ জায়গায় স্থির থাকতে পারেনি হেফাজতের নেতৃত্ব। পরে সাবেক দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মীর ইদ্রিসকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়। হেফাজতের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২১ মাস জেল খেটে সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান আজিজুল হক। নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস বশির উল্লাহকে।
মূলত তৃণমূলের চাপেই বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে হেফাজতে ইসলাম। কার্যত এই চাপেই কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের অনেকে মনে করেন, কারাবন্দীদের মুক্তি এবং নেতা-কর্মীদের মামলার খড়্গ থেকে মুক্ত করতে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্ব কার্যকরব্যবস্থা নিতে পারছেন না। উপরন্তু সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে সরকার এবং সরকারি মহলের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেছেন। এর বাইরে গিয়ে সংগঠন নিয়ে তাঁদের কোনো দৃশ্যমান ভাবনা বা পরিকল্পনা নেই। এমন প্রেক্ষাপটে হেফাজতের নেতৃত্বের ওপর সরকারবিরোধী অংশটি রুষ্ট হয়ে ওঠে। এই অংশের সঙ্গে হেফাজতের ভেতর থেকেও চাপ তৈরি হয় পুরোনোদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পুনর্গঠনের।
অবশ্য হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকার এবং সংগঠনের ভেতরের কোনো চাপে নয়, তাঁরা নিজে থেকেই কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
হেফাজতের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে সংগঠনের দাবিদাওয়া নিয়ে তাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে, তা না হলে হেফাজতকে কেউ গুরুত্ব দেবে না। বিশেষ করে, হেফাজতের মামলা এবং কারাবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে একটা ঘোষণা আশা করছে হেফাজত।
আবার ১৩ দফা, সক্রিয় হতে চায় হেফাজত
২০১০ সালে সরকার প্রণীত নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের জন্ম হয়। শুরুতে নেতৃত্বে ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার তৎকালীন মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী। তাঁর নেতৃত্বে হেফাজতের উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে। আমৃত্যু তিনি হেফাজতের আমির ছিলেন। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর সংগঠনটির একাংশের সঙ্গে বিরোধের মধ্যে সে বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ-সহিংসতার জেরে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ২৫ এপ্রিল রাতে এক ভিডিও বার্তায় সংগঠনের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। তখন বিক্ষোভ-সহিংসতার ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৯টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৬৯ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। মামলাগুলো বহাল রয়েছে। কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার দিন পর্যন্ত সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই পরিস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠনটির কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
প্রায় আড়াই বছর পর বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে এখন হেফাজত নিজেদের মামলা ও কারাবন্দীদের মুক্তির দাবি নিয়ে মাঠে সক্রিয় হতে চাইছে। পাশাপাশি ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান এবং নারীদের হিজাব বাধ্যতামূলক করাসহ সংগঠনের ১৩ দফা নিয়ে আবার কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করছে। হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মীর ইদ্রিস প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই পুনর্গঠিত কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি পরিচিতি সভা করা হবে। সেখানে সংগঠনের কর্মপন্থা এ কর্মসূচি ঠিক করা হবে।
হেফাজতের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে সংগঠনের দাবিদাওয়া নিয়ে তাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে, তা না হলে হেফাজতকে কেউ গুরুত্ব দেবে না। বিশেষ করে, হেফাজতের মামলা এবং কারাবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে একটা ঘোষণা আশা করছে হেফাজত। এ ঘোষণা না এলে কেউই নির্বাচনে তাদের সমর্থন পাবে না।
তবে এসব বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কোনো পর্যায়ে নেতারা উদ্ধৃত হতে রাজি হননি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত