দেশ ও সমাজের অনৈতিকতা – দায়ী কে

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১৪:৪৯ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ০৪:০১

আজ আমাদের সমাজ নৈতিকতা এবং অনৈতিকতার মধ্যে বিভক্ত। বর্তমানে সমাজ অনৈতিকতায় নিমজ্জিত, যা আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই অনৈতিকতার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী আমরা নিজেরাই। সামাজিক মূল্যবোধ হল একটি নির্দিষ্ট সামাজিক সম্প্রদায়ের রীতিনীতি, বিশ্বাস, রুচি, সামাজিক অনুশীলন, নিয়ম এবং মনোভাব। প্রশ্ন হলো: আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কতটুকু অবশিষ্ট আছে? আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশী মসজিদ রয়েছে, আছে হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ বিহার। আছে ধর্মীয় স্কলার, আলোচক, ব্যক্তিত্ব। আমাদের দেশে সবসময় ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলমান। আমরা রোজা রাখি, উপোস করি, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলি, তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের মাঝে খারাপ কাজ এবং পাপ প্রবণতা বেশী কেন? 

পশুদের মধ্যে নৈতিকতা নেই। মানুষের মধ্যে আছে, কারণ মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ফলে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। নৈতিকতা, মানবতা এবং দয়ার মতো মানবিক গুণাবলী দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষ মানুষের উপর আস্থা হারিয়েছে। এদেশে বিশ্বাস করা অপরাধ, আইন অমান্য করা বাহাদুরি। পরিবার, সমাজ ও সরকারে নীতি, সততা ও আদর্শের অভাবে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। আমরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চরমপন্থা, সহিংসতা এবং অনৈতিকতাকে নৈতিক মনে করছি। একজন ডাক্তার, বিচারক, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং শিক্ষকের সততা ও নৈতিকতার স্তর আজ নিম্নমুখী। আদর্শ থেকে বিচ্যুতি চিন্তা, ধ্যান, ন্যায়বিচার এবং মননশীলতাকে ধ্বংস করেছে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধগুলো এখন আর নেই। এখন অপরাধীরা সমাজের বীর হিসেবে সম্মানিত। মানুষ তাদের খারাপ কাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়। সঠিক বা অন্যায়, ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক কোনো চিন্তা না করে আমাদের দেশের মানুষ এখন টাকা-পয়সা, খ্যাতি ও ভাগ্যের পিছনে ছুটে বেড়ায়। তাই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ খুবই শোচনীয়। মহৎ গুণগুলো এখন নির্বাসিত।  

শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য কাজে নিয়োজিত। দুর্ভাগ্যবশত, শিক্ষকদের অনেকেই নারী হয়রানি সহ দুর্নীতি ও অনৈতিক আচরণের সাথে জড়িত। পদ বা পদোন্নতির জন্য একজন শিক্ষক যে কারো কাছে মাথা নত করে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। সরকার বা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে মহোৎসব হয়ে গেল তা সত্যিই লজ্জাকর। টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষাখাতে দুর্নীতির হার ৪২.৯%। অনেক চিকিত্সক রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা অস্ত্রোপচার করতে বাধ্য করে। ৫০০-১০০০ টাকায় ২ মিনিট কথাও বলা যায় না। অনেক সময় রোগী মানসিক স্বস্তি পান না কারণ তিনি এত অল্প সময়ের মধ্যে যা যা প্রয়োজন তা বলতে পারেন না। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেবা খাতে দুর্নীতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৬৬.৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০.৮ শতাংশ। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা করে। কিছু ব্যবসায়ী ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে এবং ঋণ পরিশোধ করেন না। দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ খাত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বীমা, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪.৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ। জরিপের ফলাফলে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিমা, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয়-সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আটটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে দ্বিতীয়-নিম্ন অবস্থান এবং ৩২টি এশিয়া-প্যাসিফিক দেশের মধ্যে চতুর্থ-নিম্ন। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দুর্নীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে । জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে, বাংলাদেশে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ । বিশ্বব্যাংকের ‘ সাহায্য স্মারক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলোদেশে আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে শতকরা সাত ভাগ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় , স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে তার মাত্র ২৫ ভাগ প্রকৃতপক্ষে সংশ্লিষ্ট খাতে কাজে লাগানো হয়েছে , বাকি ৭৫ ভাগই লুটপাট হয়েছে।  জাতীয় অর্থনীতির ৫০ শতাংশ ব্ল্যাক মানি। দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পরও সার্বিকভাবে বিচার বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যাক্তাদের ৭৭.৯ ভাগকে ব্যবসা পরিচালনা করতে কোথাও না কোথাও ঘুস দিতে হয়। সরকারি দপ্তরের ঘুষ-দুর্নীতি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। কেরানি থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা অনেকেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অবৈধভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের পরও তাঁদের লোভ কমে না। 

আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ যেখানে ধর্মের নামে প্রতিনিয়ত চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নগ্ন খেলা। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান মতে, গত নয় বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ২ জুন প্রকাশিত ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘু সদস্যদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ কিংবা জমি দখল রোধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুফল আসেনি। ২০২২ সালে সংখ্যালঘু হত্যা নির্যাতনসহ প্রায় ৯ হাজার একর ভূমি দখল করেছে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠি। জানিয়েছে হিন্দু মহাজোট। ভূমি মন্ত্রীর সফলতার অনেক গুণকীর্তনের বিপরীতে আছে তারই আশেপাশের মানুষের সংখ্যালঘুদের জমি নামে বেনামে দখল বা জমি ক্রয়ের নামে অর্থ পরিশোধ না করা। জানুয়ারী ২০২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ইং তারিখ পর্যন্ত গত এক বছরে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৫৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার হুমকী ৮৪৯ জন, হত্যা চেষ্টা ৪২৪ জন, জখম ও আহত করা হয়েছে ৩৬০ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ৬২ জন, চাঁদাবাজী হয়েছে ২৭ কোটি ৪৬ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা, মোট ক্ষতি হয়েছে ২২০ কোটি ৮৯ লক্ষ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকা । ভূমি দখল হয়েছে ৮,৯৯০ একর ৬৩ শতাংশ। ঘর বাড়ী দখল হয়েছে ৫৭টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৫০ টি, মন্দিরের ভূমিও দখল হয়েছে। দেশত্যাগের বাধ্যকরণ ৪৪৫টি পরিবার। দেশত্যাগে হুমকীর শিকার ১৫১১৫টি পরিবার, নিরাপত্তাহীনতায় ১,৯৫,৯৯১ টি পরিবার। সংঘবদ্ধ হামলা ৯৫৩টি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা ঘটেছে ১২৭ টি। মিথ্যা মামলায় আসামী, গ্রেফতার, বরখাস্ত, চাকুরীচ্যুত, জেল জরিমানার শিকার ৭৯১ জন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ ১৭৯টি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা ১২৯টি। ২০২২ সালের দুর্গাপুজায় ৩৫টি হামলায় ৯১টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারের রামুতে ১৯ টি বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছিলো।  

যাদের দ্বারা শিশুরা সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকার কথা, তাদের হাতেই বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিনিয়ত সহিংসতা, ভৎসনা এবং শোষণের শিকার। প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয়জন শিশুই তাদের বাবা-মা এবং শিক্ষক সহ সেবাদানকারীদের দ্বারা শারীরিক শাস্তি বা মানসিক আগ্রাসনের শিকার হয়। পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় সাত শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের শিশুশ্রমে জড়িত। শিশু নির্যাতন আরেক দিক হলো গৃহপরিচারিকা নির্যাতন। শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যাওয়া, কালসেটে দাগ, দগদগে ঘা নিয়ে গৃহকর্ত্রীর কবল থেকে কোনমতে উদ্ধার পাওয়া গৃহকর্মী শিশুদের ছবি আমরা বহুবার দেখেছি। অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় এই যে, শিশু নির্যাতনকারী এসব পাষন্ডদের অধিকাংশই শিক্ষিত ও ভদ্র সমাজের বাসিন্দা। সংবাদ মাধ্যমের এক খবরে বলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলায় সাজা হয় মাত্র ১.৩৬ শতাংশ আসামীর এবং বাকি ৯৮.৬৪ শতাংশ বেকসুর খালাস পান। ২০২১ সালে ১ হাজার ২৫৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৭৩৮ জন অর্থাৎ মোট ঘটনার প্রায় ৫৯ শতাংশ। এসব নারী ও শিশুর মধ্যে ৪৬ জনকে হত্যা করা হয়। গত বছর ৬০২টি পারিবারিক সহিংসতায় ২৮৫ জন নারীকে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।  আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।

এতো অনৈতিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক দুর্বিতায়ন, পুলিশের হয়রানি, মাস্তানচক্রের হুমকি, শিক্ষা বিচার বিভাগে দুর্নীতি, ভূমি মন্ত্রীর সফলতার অনেক গুণকীর্তনের বিপরীতে তারই আশেপাশের মানুষের সংখ্যালঘুদের জমি নামে বেনামে দখল বা জমি ক্রয়ের নামে অর্থ পরিশোধ না করা, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ভোটের অধিকার হরণ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ভোটের কারচুপি, গণতন্ত্র ও মানুষের মত প্রকাশের অধিকার হরণ, খাদ্যে ভেজালের মাঝে সাধারণ ও ক্ষমতাহীন মানুষ সার্বক্ষণিক ভয়, নিষ্পেসন শোসনের দাসত্বে এক অনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় বেঁচে আছে। এর দায় কার?

লেখকঃ অভিজিৎ বড়ুয়া অভি (কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত