দুই পদে চাকরি করেও বাতিল হয়নি এমপিও পদ
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১৮:০০ | আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাসানুল সিরাজী [ইনডেক্স নাম্বার ক৮৩১০২৭] একই সাথে দুইটি কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকরি করেও আজ পর্যন্ত বাতিল হয়নি তাঁর এমপিও, আছেন বহাল তবিয়তে।
নিয়ম অনুযায়ী, একটি কলেজে কর্মরত কোন ব্যক্তি অপর একটি কলেজে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তির জন্য নির্বাচিত হলে নতুন কলেজে যোগদানের পূর্বে যে কলেজে তিনিস কর্মরত সেই কলেজ হতে এই মর্মে একটি ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হবে যে তাঁর নিকট সাবেক কলেজের কোন পাওনা নাই এবং তাঁর ঐ কলেজ ত্যাগে তাঁদের কোন আপত্তি নাই। কালকিনি আবুল হোসেন কলেজে অধ্যক্ষ পদে থাকা অবস্থাতেই অন্য একটি কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকরি করেছেন যা চাকরিবিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মো. হাসানুল সিরাজী কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় ২০২০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে। যোগদান করার পর একই বছরের ৯ জুলাই তারিখ পর্যন্ত কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন।
কাজি আজহার আলি কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাসানুল সিরাজী। ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন এবং একই তারিখে কলেজটির গভর্নিং বডি কর্তৃক এবং ৫ মার্চ তারিখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়োগ অনুমোদন হয়। মার্চ মাসের ৯ তারিখে নিয়োগপত্র প্রদান করা হয় এবং ২০২০ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন অধ্যক্ষ মো. হাসানুল সিরাজী। এরপর ২০২০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে যোগদানোত্তর ছুটির আবেদন করেন এবং ২০২০ সালের ৭ জুন ছুটি বর্ধিকরণের আবেদন করেন। এরপর
২০২০ সালের ৯ জুলাই কাজি আজহার আলি কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ পত্র প্রদান করেন তিনি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের [স্কুল ও কলেজ] জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ এর ১১.১৭ ধারা মোতাবেক ‘এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারী একই সাথে একাধিক কোন পদে/চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। এটি তদন্তে প্রমাণিত হলে সরকার তার এমপিও বাতিলসহ দায়ী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
তবে মো. হাসানুল সিরাজী একদিকে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ পদে অন্যদিকে একই সময়ে ফকিরহাটের কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকরি করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ধরণের শাস্তিম‚লক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ এর ১১.১৭ ধারা লঙ্ঘন করেও আজ পর্যন্ত তাঁর এমপিও বাতিল হয়। বছরের পর বছর সরকারের দেওয়া এমপিও’র অংশের টাকা তছরুপ করছেন তিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর শর্তাবলী রেগুলেশন [সংশোধিত] ২০১৯ এর ৮নং বিধি অনুযায়ী, ‘কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ খন্ডকালীন ভিত্তিতে নিযুক্ত হইতে পারিবেন না এবং একজন পূররণকালীন শিক্ষক খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে একাধিক কলেজে শিক্ষকতা করিতে পারিবেন না। তবে আইন কলেজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনবোধে এই বিধি শিথিল করিতে পারিবে।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর শর্তাবলী রেগুলেশন [সংশোধিত] ২০১৯ এর ৩[ঘ] বিধিতে উল্লেখ আছে, “একটি কলেজে কর্মরত কোন ব্যক্তি অপর একটি কলেজে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তির জন্য নির্বাচিত হইলে নতুন কলেজে যোগদানের পূর্বে যে কলেজে তিনি কর্মরত সেই কলেজ হইতে এই মর্মে একটি ছাড়পত্র সংগ্রহ করিতে হইবে যে তাঁর নিকট সাবেক কলেজের কোন পাওনা নাই এবং তাঁহার ঐ কলেজ ত্যাগে তাঁহাদের কোন আপত্তি নাই ।
কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মো. হাসানুল সিরাজী কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ না করে ফকিরহাটের কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। অর্থ্যাৎ তিনি এই সময় একই সাথে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ পদে এবং ফকিরহাটের কাজি আজহার আলি কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকরি করেন। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর শর্তাবলী রেগুলেশন [সংশোধিত] ২০১৯ এর ৮নং বিধি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের [স্কুল ও কলেজ] জনকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ এর ১১.১৭ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
শুধু তাই নয় অধ্যক্ষ হাসানুল সিরাজী কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন সুবিধা অনু্যায়ী যখন ইচ্ছে কলেজে আসেন যখন ইচ্ছে হয় আসেন না। দিনের পর দিন কলেজে অনুপস্থিত থাকলেও এই সময়টা কলেজ গভর্নিং বডির কাছ থেকে কোন ধরণের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না। এমনকি কলেজে অনুপস্থিত থাকার সময় কাউকে দায়িত্ব অর্পণও করেননি তিনি। ফলে তাঁর স্বেচ্ছাচারিতায় কলেজটির শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মান নিন্মমুখী অবস্থানে রয়েছে। দিনের পর দিন বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকায় মোট তিনবার তিনবার কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি কর্তৃক তাকে শোকজ করা হলেও আজ পর্যন্ত তিনি শোকজের কোন জবাব দেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি ও কালকিনি উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা বিনা অনুমতিতে একাধিক দিন কলেজে অনুপস্থিত থাকায় তাকে শোকজ করেন এবং সাত কর্মদিবসের মধ্যে শোকজের জবাব চান। কিন্তু প্রায় তিন বছর পার হলেও সেই শোকজের জবাব আজ পর্যন্ত দেননি অধ্যক্ষক সিরাজী। ডিগ্রি পরীক্ষা চলমান থাকা স্বত্তে¡ও এবং একাধিক দিন কলেজে অনুপস্থিত থাকায় ২০২২ সালের ২৯ জুলাই কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও কালকিনি উপজেলা চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক তাকে শোকজ করেন এবং সাত কার্য দিবসের মধ্যে জবাব চান। সেই শোকজের জবাবও দেননি তিনি। এরপর ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর ‘শেখ রাসেল দিবস’ এ মাউশি কর্তৃক কর্মসূচী পালনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও কোন প্রকার কর্মসূচী আয়োজন না করায় জিবি সভাপতি পুনরায় তাকে শোকজ করেন। তিনি সেই শোকজের জবাবও দেননি।
২০২২ সালে ১৩ নভেম্বর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক শোকজ করে। এই শোকজের জবাব তিনি দিলেও সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি সভাপতি কর্তৃক শোকজ করা হলে তিনি তাঁর জবাবও দেননি। শুধু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাই নয় অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগও রয়েছে এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। আর এই অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী শিক্ষিকাকে হেনস্তা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে কলেজটির ৩৫ জন শিক্ষক স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ পত্র জমা দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে যা তদন্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাসানুল সিরাজী শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি যে সময়ে ফকিরহাটের কাজি আজহার আলি কলেজে যোগদান করি সে সময় ছিল করোনাকালীন। মানুষের চেষ্টা থাকবে অন্য কোন ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার। কিন্তু কালকিনি কলেজ থেকে ছাড়পত্র না পাওয়ায় আমি সেখান থেকে চলে আসি। সরকারের কোন ধরনের আর্থিক সুবিধা আমি গ্রহণ করিনি। ফলে চাকরিবিধি লঙ্ঘন হয়নি। এমপিও নীতিমালা এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বিধিমালার শর্তে অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগদান সময় অবশ্যই পূর্বের প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু আপনি যোগদান করলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেই যোগদান পত্র অনুমোদন করলেন, ছুটি নিলেন, ছুটি বর্ধিত করলেন এরপর দীর্ঘ কয়েকমাস পরে পদত্যাগ পত্র জমা দিলেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করিনি।
একাধিকবার কলেজে বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, কলেজের কাজেই বিভিন্ন সময়ে আমাকে বাহিরে যেতে হয়েছে অনুমতি নেওয়ার সময় হয়নি। এক কিংবা দুইবার নয় টানা চার টি শোকজের নোটিশ দিয়েছেন আপনার অনুপস্থিতি থাকার বিষয়ে কিন্তু আপনি কোন জবাব দেননি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, হ্যা এটা ঠিক কিন্তু আমার শোকজের জবাব দেওয়া উচিত ছিল। তবে ঢাকা বোর্ড কর্তৃক শোকজ নোটিশের যথাযথ জবাব দিয়েছি যোগ করেন তিনি। কলেজের ৩৫ জন শিক্ষক স্বাক্ষরিত অভিযোগ পত্রে আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাৎ, অব্যবস্থাপনা ও নারী শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগ এনে মাউশির ডিজি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন যার তদন্ত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি যদি কলেজের প্রভাবশালী হতাম তাহলে কি এত শিক্ষক একসাথে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারতেন না। এখানে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমি সঠিকভাবে কলেজটি পরিচালনা করছি ফলে এক পক্ষ আমাকে সহ্য করতে পারছে না। বিষয়টি তদন্ত হয়েছে মাউশি যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই সিদ্ধান্ত তিনি মাথা পেতে নেবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও কালকিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, তিনি ইচ্ছেমত কলেজে আসেন যান। একাধিকবার তাকে শোকজ করার পরও কোন ধরণের জবাব তিনি দেননি। এতবার শোকজ করার পরও যখন তিনি জবাব দেননি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাদের জিবিতে অনেক গ্রুপিং রয়েছে না হলে অনেক আগেই এইন সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম।
তবে এই বার আমরা এরকম সিদ্ধান্তই নিতে যাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একা আর কত করবেন এদের মতো [অধ্যক্ষ] লোক যখন দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে দায়িত্বহীন আচরণ করেন যোগ করেন তিনি। একই সাথে অন্য একটি কলেজে চাকরি করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জানি তবে অধ্যক্ষ বলেছেন তিনি কোন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেননি এবং চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিংকি সাহার মুঠোফোনে কল করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত