পর্ব: ৫    পরান-সখী বান্ধবী আমার

তিতুমীর কলেজ: আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৩৫ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫০

ঝর্না রহমান
----------------

পারভীন ছিলো আমার স্কুলের সহপাঠী, আমার প্রাণের বন্ধু, প্রাণসজনী পরান-সখী। চতুর্থ পর্বে পারভীনের কথা কিছুটা বলেছি। কত যে গুণ ছিলো ওর! অসাধারণ নাচতো, চমৎকার গাইতো, সুন্দর ছবি আঁকতো। তিতুমীর কলেজেও পারভীন আমার সহপাঠী হলো। কলেজে ক্লাসের ফাঁকে পারভীন টানা আমার গান শুনতো। আর মুগ্ধ হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। মূলত আমরা ‘দুজনেই দুজনাতে মুগ্ধ’ ছিলাম। সে সময়ে একটা গান খুব জনপ্রিয় ছিলো। সেটি হলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো’। এ গানটি আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিলো। পারভীনকে আমি এ গান শতেকবার গেয়ে শুনিয়েছি। তাতেও মন ভরতো না ওর। এই গানের সুর, কথা, বিশেষ করে সঞ্চারির কথাগুলো আমাদের দুজনকেই মগ্ন করে রাখতো। ও বলতো, তোর গলায় এই সঞ্চারিটা শুনতে কী যে ভালো লাগে, বোঝাতে পারবো না। যতই শুনি মন ভরে না! এ জায়গাটা তুই সন্ধ্যার চেয়েও ভালো গাস। বান্ধবীর প্রশংসা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও খুশিতে বাকবাকুম হয়ে যাই। বলি, তোকে আমি সারাক্ষণ গান শোনাতে পারি। সে সময়টা মাত্রা ছাড়ানো আবেগেরই বয়স। তা ছাড়া আমরা দুজনেই ছিলাম ভাবুক, স্বপ্নপ্রবণ, চরম রোমান্টিক দুই তরুণী। পারভীন বললো, সত্যি? তাহলে তুই আমাকে একদিন সারাদিন এ গানের সঞ্চারিটা গেয়ে শোনাবি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কলেজে একদিন তেমনি সুযোগ পেয়ে গেলাম। শেষ ক্লাসটা হল না। কোনো কারণে স্যার আসেননি। ছেলেপুলেরা হৈ চৈ করে বেরিয়ে গেল। আমি পারভীনকে বললাম চল, আজ তোকে বাকি দিন ‘ধূপ চিরদিন’ শোনাবো।
সত্যি? পারভীনের চোখে কৌতুক। বাসায় যাবি না?
আমিও কৌতুকভরা চোখে বলি, না, যাবো না। আজ ধূপ জ্বালাবো!
আমরা দুজন বসলাম ক্লাসের পেছন দিকটাতে জানালা ঘেঁসে। জানালা দিয়ে নিচে দেখা যায় ছড়ানো মাঠ। বড় ঝাঁকড়া কড়ই গাছ। পড়ন্ত বেলায় গাছের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে সবুজ রোদ, মাটিতে বিছিয়ে আছে ঘন ছায়া আর ঝরা পাতার কারচুপি। আমি গাইতে থাকি ‘ধূপ চিরদিন নীরবে জ্বলে যায়, প্রতিদান সে কি পায়... পারভীন ওর হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে আমার হাতের পাতা। এক সময় পারভীনের চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা পানি পড়লো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গান থামিয়ে দিলাম। কী হলো!
পারভীন চোখভরা পানি নিয়ে হাসতে হাসতে বললো, তুই এত ভালো ক্যান বলতো? গাইতে বলেছি বলে সত্যিই সঞ্চারিটা একটানা গেয়ে যাচ্ছিস? তুই কি মেশিন!
আমিও হাসতে হাসতে বলি, না আমি ধূপ!
প্রতিদান তো পাবি না!
পেয়েছি তো! চোখের পানি! আর তাতে ধূপ নিভে গেছে!
আমাদের আবেগ হাস্য পরিহাসে গড়ায়।

পারভীন ছিলো আমার প্রেরণা। আমার সাংস্কৃতিক চেতনার সলতেতে ও ছিল ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’। আদর্শ স্কুলে যখন আমরা নাইনের ছাত্রী, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব পড়লো আমার আর পারভীনের ওপর। অনুষ্ঠানের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের গান ‘বাদলধারা হল সারা বাজে বিদায় সুর’ কোরাস, আরও দুজন মেয়ে দুটি রবীন্দ্র সংগীত গাইবে। পারভীন নাচবেও ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানের সাথে। স্যার ম্যাডামরা বললেন সব রবীন্দ্রনাথ? অন্য কোনো গান নেই? তাইতো, মাথা চুলকাই আমরা! রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কিছু তো কেউ পারে না! পারভীন আমাকে বললো তুই একটা বিদায়ের গান লিখ দে! তারপরে? তারপরে সে গানে আমি সুর করবো আর আমরা দুজনে গাইবো! গান লিখতে হাত মকশো করেছি আমি কিশোরী বেলাতেই। কিন্তু আমার বয়সী আমারই সহপাঠী গানে সুরও করবে, পারভীনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাই। ও হাসে। কখন কোন গানে সুর করেছে তার তালিকা শোনায়! পরের দিনই গান লিখে নিয়ে এলাম। বিদায়বেলার সন্ধিক্ষণে ব্যথায় ভরেছে মন/ হারিয়েছি ভাষা কী দিয়ে জানাবো বিদায় সম্ভাষণ। পারভীন এ গানে এমন মর্মস্পর্শী সুর আরোপ করলো, যে, গান শুনলেই চোখে পানি চলে আসে। এটিই ছিলো আমার লেখা গানের প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিবেশন। আমার গানপাগল বোনেরা আমার কাছে শুনে শুনে সেই গান কণ্ঠস্থ করে ফেললো। পারভীনের এই ক্ষমতা আমাকে সুরের ভুবনে পথচলায় নানাভাবে প্রাণিত করেছে। তিতুমীরে টেস্ট পরীক্ষার পরেই আমি ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে স্থায়ী হলাম। মানিকগঞ্জে বসে আমিও একদিন নিজের লেখা গানে সুর করি। গেয়ে দেখি, হ্যাঁ এও তো গান! সেখানেও পারভীনের প্রেরণা!

তিতুমীর কলেজে ১৯৭৬-এর একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও আমি গান গাইলাম পারভীনেরই অনুপ্রেরণায়। পারভীন আমাকে শিখিয়ে দিলো আব্দুল জব্বারের গাওয়া গান ‘শত শহীদের রক্তে রাঙানো আমার জন্মভূমি।’ কলেজে প্রাঙ্গণে স্থাপিত শহীদ মিনারের বেদিতে দাঁড়িয়ে আমরা দুজনে গাইলাম সেই গান। (আজও এ গান শুনলে শিল্পীর কণ্ঠ ছাপিয়ে কানে আসে পারভীনের কণ্ঠ।) গাইলাম অমর একুশের গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ সবই রিহার্সাল করালো পারভীন। এ গানটির শুরুতে যে আলাপটি আছে সেটি কালক্রমে নানারকম সুরে ও বিস্তারে শিল্পীদেরকে গাইতে শুনেছি। কিন্তু পারভীন যেভাবে আলাপটি শিখিয়েছিল সেটি যেন ছিল অনন্য। মূল সুর অক্ষুণ্ণ রেখে এক অসামান্য গমক আর মীড়ছোঁয়া গায়কী ছিল সেই আলাপে! আমি আজও এ গান গাইতে গেলে পারভীনের কণ্ঠের সেই আলাপটিই স্মরণ ও অনুসরণ করি। কী যে দরদ ছিলো ওর কণ্ঠে! বেশি খোলা গলায় গান করতো না পারভীন। কণ্ঠকে মেজে মেজে আবেগে আবেশে জড়িয়ে, অনেকটা নিলুফার ইয়াসমিনের মতো মেজাজী ঢঙে, অপূর্ব গায়কীতে গান করতো পারভীন। আমি মগ্ন হয়ে ওর কণ্ঠে সুরের খেলা দেখতাম। তিতুমীর কলেজের সেই একুশের অনুষ্ঠানে আমরা লালপাড় ঘিয়েরঙ গরদ শাড়ি পরে সেজেছিলাম। আমাদেরকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দুজন ডানাকাটা পরী! সে বয়সটা নিজের রূপে মুগ্ধ হওয়ার বয়স। অনুষ্ঠান-শেষে আত্মমুগ্ধ দুই বান্ধবী চললাম স্টুডিওতে ছবি তুলতে। এই ছবিটি হলো আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় এক ছবি। 


তিতুমীর কলেজে থাকতে একবার পিকনিকে গেলাম। সেটার জন্যও আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো পারভীন। আমি কলেজের ক্লাস শেষ করে আর কোথাও যেতে চাই না। আম্মার কাছে দিনমানের জন্য বাচ্চাকে রেখে আসি। ছোট্ট শিশুটির জন্য আমার থাকে যত তাড়তাড়ি সম্ভব বাসায় ফেরার তাগিদ। সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠায় আমি অন্য কোনো আনন্দ বিনোদনের কথা ভাবতে পারি না। কলেজের পিকনিকে যাওয়াটা তাই আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হলো। পারভীন কয়েকদিন নানাভাবে মোটিভেট করে আমাকে রাজি করিয়ে ফেললো। ছুটির দিনে পিকনিক। দূরে কোথাও না। বেলাবেলি বাসায় ফিরে যাওয়া যাবে ইত্যাদি। সে সময় মহাখালি গুলশানের আশেপাশে বিস্তর খালি জায়গা। বিস্তৃত ফাঁকা প্লটে বড় বড় গাছপালা জলাজঙ্গলে ছাওয়া নৈসর্গিক পরিবেশ। এই সব বনে গিয়েই তখন পিকনিক হতো। পারভীনসহ আমার বান্ধবীদের বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণ করেছিলো সে পিকনিকে। সেটা ছিলো সত্যিকারের বনেভোজন। চালডাল নুনতেল লাকড়িখড়ি নিয়ে বনের মধ্যে একটু খোলা জায়গা দেখে বসে পড়া। দল বেঁধে পেঁয়াজ ছেলা, আলু কোটা, মুরগি বানানো, ধোঁয়ায় চোখমুখ ফুলিয়ে ইটের চুলো জ্বালানো, হাত পুড়িয়ে নুন বাড়িয়ে রান্নাবাড়া। সেরকম পিকনিকই হলো আমাদের। দলের নেতৃত্বে থাকলেন কামাল আতাউর রহমান স্যার, সাংস্কৃতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ম্যাডাম। সঙ্গে বোধ হয় স্যারের স্ত্রী মৌসুমীও ছিলেন। আমার এখন ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু মনের পাতে খোদিত রয়ে গেছে সেই অপূর্ব বনভোজন। সেই বনেভোজনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, পারভীন শুধু ছাত্র ছাত্রী সবার সাথেই নয়, সব স্যার ম্যাডামের সাথেও অত্যন্ত সহজ। স্যারদের সঙ্গে পারভীন কথায় কথায় হাসছে, মজাও করছে। কোনো ভয় নেই, দ্বিধা নেই, সংকোচ বা কুণ্ঠা নেই। আত্মপ্রত্যয়ী সহজ সুন্দর এক মানুষ। আমি ছিলাম মুখচোরা, লাজুক, নিভৃতচারী স্বভাবের। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কারো সাথে আলাপ করায় যত কুণ্ঠা। সেদিন পারভীনকে দেখে আমার যেন অনেকখানি আত্ম উদ্বোধন ঘটেছিলো। সেই পিকনিকের একটা ছবি কিভাবে যেন আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল। যে ছবিতে আমি আর পারভীন পাশাপাশি বসে পিকনিকের রান্নার জন্য পেঁয়াজ ছিলছি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠান শেষে স্টুডিওতে গিয়ে তোলা ছবি আর পিকনিকের ছবি এই দুটি ছবিই ছিল পারভীন আর আমার সহপাঠী জীবনের শেষ ছবি এবং ওর সঙ্গে জীবনেরও শেষ ছবি। ১৯৮১ সনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হওয়ার আগেই, ডান হাতের আঙুলে ছোট্ট একটি অপারেশন থেকে ধনুষ্টংকার হয়ে পারভীন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। অকল্পনীয় আকস্মিকতায় থেমে গিয়েছিল একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জীবন। অকালপ্রয়াত আমার এই বিদ্যালয়-সখীকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। অনন্ত আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে থাকিস বন্ধু আমার।                                                                                                        

 (চলবে)

ঝর্না রহমান 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ছবি: ১. ১৯৭৬-এ একুশে ফেব্রুয়ারিতে পারভীন আমি, 

২. তিতুমীর কলেজের পিকনিক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত