পর্ব: ৪ হারমোনিয়াম-বাজানো নাম-না-জানা সহপাঠী
তিতুমীর কলেজঃ আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:২২ | আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৪২
ঝর্না রহমান
----------------
তিতুমীর কলেজের সময়টা ছিলো আমার শিক্ষাজীবনের ম্রিয়মাণ কাল। প্রথম বর্ষ (১৯৭৫) কেটে গেল নানা সংকটে-সংঘাতে। দ্বিতীয় বর্ষ যদিও কলেজ সিলেবাসের জন্য একেবারেই সংক্ষিপ্ত, কলেেেজর ক্লাস শুরু হতে না হতেই প্রি টেস্ট, টেস্ট পরীক্ষাগুলো চলে আসে, আর ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের চেয়ে বেশি দৌড়ুতে হয়ে কলেজ-অফিসে, বেতন রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষার ফিস ইত্যাদি পরিশোধের জন্য, তার পরেও তিতুমীর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষটা আমার জন্য কয়েকটা কারণে উজ্জ্বল আর রমণীয় হয়ে উঠলো। আগের পর্বে বলেছি, এ কলেজে আমার সাথে কয়েকজন স্কুল-সহপাঠিও ভর্তি হয়েছিল। আমার স্কুল ‘আদর্শ গার্লস হাইস্কুল’ সেটি ছিলো তিতুমীর কলেজ-লাগোয়া টিএনটি কলোনির কাছাকাছি। কাজেই যাদের বাসা ঐ এলাকায় বা ওয়ারলেস গেইটে, ওরা কাছকাছি হওয়াতে তিতুমীরেই ভর্তি হলো। ‘আদর্শ স্কুল’ ছিল আমার ‘গানের ঝরনাতলা’। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলতো আমার লাগাতার গান গাওয়া। বান্ধবীদের অনুরোধে অজস্র গান গাইতাম। ভারতীয় বাংলা গানের বিরাট ভাণ্ডার আমার মুখস্থ ছিলো। গাইতে গাইতে লিখতাম কারো বান্ধবীদের এক-একজনের পছন্দের কোনো গান। গাওয়ার গতি আর লেখার গতি ভিন্ন হলেও দু দিকেই আমি মন প্রবাহিত করতে পারতাম। এ বিষয়টি আমার বান্ধবীদের বিস্মিত করে তুলতো। মনে মনে নিজেকেও বাহবা দিতাম।
স্কুলে আমার বান্ধবীদের মধ্যে গানে-নাচে-ছবি আঁকায় অনন্য প্রতিভাধর এক বান্ধবী ছিলো, ওর নাম পারভীন, পারভীন আকন্দ। ডাক নাম রুপু। পারভীনের বাবা মহাখালি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবার সংগীতজ্ঞও ছিলেন। বাবার কাছে পারভীন গান শিখেতো, নাচের স্কুলে নাচ শিখতো। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারতো পারভীন। যে কোনো গানের সুর শুনে সাথে সাথে হারমোনিয়ামে তুলতে পারতো। সেটা ছিলো আমার কাছে এক মহা বিস্ময়! সুন্দর ছবিও আঁকতো পারভীন। ওর আঁকার বিষয় ছিল মূলত দুটি। চিত্রনায়িকা ববিতা আর বিড়াল। ববিতা ওর এত প্রিয় ছিল, কোনো ছবি না দেখেই ও ববিতার ছবি এঁকে ফেলতে পারতো। ববিতার চুল ভ্রু ঠোঁটের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য আছে সব পারভীনের মুখস্থ! শুধু পারভীনেরই নয়, নায়িকা ববিতা ছিলো আমাদের সবারই তারুণ্যের ক্রেজ। ববিতার মতো করে চুল আঁচড়ানো, কানের দুপাশ থেকে দু গোছা চুল কেটে ফেলে বিশেষ স্টাইল তখন আমাদের বান্ধবীরা অনেকেই করতো। ববিতার মতো ভ্রু প্লাক করতো পারভীন। বিড়ালও ভালোবাসতো খুব। ওর ঘর ভরতি ছিল নানা আকারের বিড়াল আর দেয়াল ভরতি ছিল ওর আঁকা নানা রঙের বিড়ালের ছবি। পারভীনের এ-সব বিদ্যা আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে তুলতো। স্কুলে থাকতেই গুণবতী পারভীন আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠেছিলো। আমি তো হারমোনিয়াম বাজানো দূরে থাক, রিডে কীভাবে আঙুল রাখতে হয় কীভাবে বেলো করতে হয় কিছুই জানতাম না! পারভীনই আমাকে হারমোনিয়ামের হাতে খড়ি দিয়েছিলো। কেমন করে স্টপার খুলতে হয়, কেমন করে আস্তে বেলো করে সুরের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় পারভীনের কাছেই প্রথম শিখি।
যা-ই হোক, পারভীন ও অন্যান্য স্কুল-বান্ধবীর বদৌলতে তিতুমীর কলেজেও আমার গান গাওয়ার বিদ্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। ছেলে হয়ে যাওয়ার পরে নিজেকে নিয়ে কোনো সংকোচও আমার ছিল না। আমি আবার সেই ফড়িং মার্কা ফুরফুরে দেহটি ফিরে পেয়েছি। অফ পিরিয়ডে ক্লাসের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে কোনো কুণ্ঠা নেই! বান্ধবীদের সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কমনরুমে বসে, কখনও ফাঁকা ক্লাসে বসেও গান করতে লাগলাম। একদিন পারভীন বললো টেলিভিশনে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের কলেজে অফার এসেছে। অংশগ্রহণের জন্য ছাত্র ছাত্রীদের অডিশন হবে। পারভীন অডিশনের জন্য আমার নাম দিয়ে দিয়েছে। আমি বলি, অডিশন কী জিনিস!
পারভীন বলে, অডিশন হলো পরীক্ষা!
পরীক্ষা দেবো? কীসের পরীক্ষা?
আরে বুদ্ধু, কণ্ঠস্বর পরীক্ষা। মানে তুই গান করবি স্যার ম্যাডামরা বাছাই করবেন। চল!
তো চললাম! একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে অডিশন। বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর ভিড়। অডিশন নেবেন কামাল আতাউর রহমান স্যার ও আর একজন ম্যাডাম। ম্যাডামের নাম মনে পড়ছে না। ম্যাডামও কলেজের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো দেখতেন। দুরু দুরু বুকে স্যারের সামনে একটা গান গাইলাম। গান গাইতে গিয়ে দেখি ধীরে ধীরে কোলাহলমুখর ক্লাসরুম চুপ হয়ে গেছে। গান শেষে স্যার ম্যাডাম দুজনই আমাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকটা গান শুনলেন।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন করলেন, শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ এ গানটি। সমবেত কণ্ঠে গান, পারভীনের নাচ, আবৃত্তি, ইত্যাদি মিলিয়ে একটা কমপ্যাক্ট প্রোগ্রামের প্ল্যান করা হলো। কামাল আতউর রহমান স্যারের নেতৃত্বে কয়েকদিন রিহার্সাল করে সবাইকে তৈরী করা হলো। আমার তখন সে কি উত্তেজনা! টেলিভিশন তখন আমাদের কাছে স্বপ্নের ভুবন। আমাদের বাসায় টেলিভিশন নেই। স্কুলে থাকতে আমার বান্ধবী নাসরীনদের বাসায় গিয়ে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখতাম। সেই টেলিভিশন! কাচের পর্দার ভেতর থেকে বেরিয়ে-আসা ছবি আর শব্দ আমাকে বিস্ময়ে আবিষ্ট করে রাখতো! সেখানে গাইবো! অনুষ্ঠান ধারণের ডেট পাওয়ার পরে উত্তেজনায় ঘুম হারাম হয়ে গেল। কলেজে শুরু হলো কে কীভাবে সাজবে এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। নির্দিষ্ট দিনে আমরা সাজগোজ করে পূর্বনির্ধারিত একটা জায়গায় সবাই সমবেত হলাম। আমি আমার এক ননদের কাছ থেকে ধার নিয়ে এলাম একটা নীল রঙের গরদের শাড়ি। সেটা পরে কল্পনায় নিজেকে আমি একবার যেতে দে না গান পরিবেশনরত অবস্থায় দেখতে গিয়ে নিজেই অভিভূত হচ্ছিলাম। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেই রেকর্ডিংটি সেদিন স্থগিত হয়ে যায়। বলা হলো পরে আবার ডেট দেবে। বিফল মনোরথ হয়ে আমরা ফিরে আসি। কলেজ জীবনে সেই সোনার হরিণ ‘রেকর্ডিং ডেট’ আর মেলেনি।
তবে টেলিভিশন অনুষ্ঠান বাতিল হলেও সেটাকে কন্দ্রে করে কয়েকদিনের রিহার্সাল প্রস্তুতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তিতুমীর কলেজে আমার গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। একদিন ক্লাসের ফাঁকে কয়েকজন ছাত্র এসে আমাকে একটা অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কলেজেই কী উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান। খুব সম্ভবত কোনো গ্রুপের বিদায় অনুষ্ঠান। আমি তখনও কলেজের কোনো অনুষ্ঠানে গাইনি। তাই রাজি হয়ে গেলাম। সেদিনই অনুষ্ঠান। একটা বড় ক্লাসরুমে আয়োজন। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। কোনো সাজসজ্জা নেই। খালি টেবিলের ওপরে রাখা হারমোনিয়ম। পেছনে ব্ল্যাকবোর্ডে তখনও স্যারদের চকের লেখা। সামনে মাইক্রোফোন। আর রুম ভরতি গিজগিজ করছে ছাত্র। ছাত্রীও আছে কয়েকজন। ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, আমি তো হারমোনিয়াম বাজাতে জানি না। সেদিন আমার সাথে পারভীনও নেই। স্কুলের অনুষ্ঠানে পারভীন বাজাতো আমি গাইতাম। এখন কে বাজাবে হারমোনিয়াম? তাই বললাম, খালি গলায় গাই? তখন আয়োজকদের মধ্য থেকে এক ছেলে এগিয়ে এলো। বললো, আমি বাজিয়ে দেবো। তুমি শুধু বল, কী গান? আমি গাইলাম আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না।’ ছেলেটি বেশ বাজালো। হারমোনিয়ামের সাথে আমার কণ্ঠ মাইক্রোফোনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, শুনে নিজেই শিহরিত হচ্ছিলাম। তারপরে আমাকে আরও দুটো গান গাইতে হলো। সব গানের সাথেই হারমোনিয়াম বাজালো সেই ছেলে। আমি অপাঙ্গে তাকিয়ে সেই ছেলের বাজানো দেখি। রিডের ওপর ওর আঙুল কেমন অনায়াসে ঢেউ তুলে তুলে এদিক থেকে ওদিকে যায়! কী আশ্চর্য, কেমন করে একবারও না শুনে গানের সঙ্গে বাজায়? গান শেষে মুগ্ধ বিস্ময়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই। ও বলে, এটা এমন কিছু না। বাজাতে শিখলে তুমিও যে কোনো গান তাৎক্ষণিকভাবে বাজাতে পারবে। পরবর্তী জীবনে আমি যখন নিজের চেষ্টায় হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছি এবং যে কোনো সুর তাৎক্ষণিকভাবে বাজাই তখন কখনো কখনো আমার সেই একটি-দিনের মুগ্ধময় সহপাঠীর কথা মনে পড়ে।
তিতুমীর কলেজে এই গানের অনুষ্ঠানটি ছিলো আমার জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট। এর দুতিন দিন পরেই কজন ছেলে এলো আমার কাছে। এদের একজন হিরু। হিরুদা। আর একজন মাসুদ। বাকিদের নাম এখন মনে নেই। ওরা সবাই গান ভালোবাসে। বিভিন্ন সময়ে গানের আসর করে। আমাকে রাখতে চায় সঙ্গে। এই হিরুদার কল্যাণে অল্পদিনের মধ্যেই পরিচয় হলো অঞ্জনদার সঙ্গে। আর অঞ্জনদা ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ানিস্ট, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক প্রণব দাসের ছোট ভাই। তাঁরা ছিলেন সিলেটের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুরসাগর প্রাণেশ দাসের পুত্র। অঞ্জনদা একদিন কলেজে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এলেন। বললেন, আমার গান রেকর্ড করে তিনি শোনাবেন তাঁর দাদা প্রণব দাসকে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তখন আমার সংগীতের আরাধ্য দেবী। সন্ধ্যার দুটি বিখ্যাত গান গেয়ে দিলাম। অঞ্জন দা সে গান ক্যাসেটবন্দী করে নিয়ে গেলেন। তার কয়েকদিন পরেই তিনি বললেন, প্রণবদা আমার গান শুনে আমার প্রতি আগ্রহী হয়েছেন। এটি ছিলো বেতারে প্রবেশের পূর্বে প্রণবদার কাছে আমার অনানুষ্ঠানিক ‘অডিশন’! এর পরে একদিন অঞ্জনদা আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর প্রণবদা’র কাছে। আর প্রণবদা’র চেষ্টায় আমি বাংলাদেশ বেতারে অডিশন দিয়ে ১৯৭৮ সন থেকে আধুনিক গান ও ১৯৮০ সন থেকে নজরুল সংগীত, দুটোই গাওয়া শুরু করলাম। প্রণবদা অঞ্জনদা প্রয়াত হয়েছেন বহু আগেই। তাঁদের কথা বলবো কোনো এক সময়। জীবনের ঘূর্ণিপাকে হিরুদা’ কোথায় হারিয়ে গেছেন, এখনও বেঁচে আছেন কি না জানি না। যেখানেই থাকুন তাঁদের জন্য রইলো অতল শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা জানাই আমার গানের সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দেওয়া তিতুমীর কলেজের সেই নাম-না-জানা সহপাঠীর প্রতিও।
(চলবে)
(ছবিঃ তিতুমীর কলেজে আমার প্রথম গানের অনুষ্ঠানের ছবি। ছেলেদের ফ্রেমের চশমা পরা এই একটি ছবিই আছে আমার।)
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত