পর্ব: ৩  শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে

তিতুমীর কলেজঃ আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১৯ |  আপডেট  : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০

ঝর্না রহমান
--------------

তিতুমীর কলেজে প্রথম বর্ষটা (১৯৭৫) আমার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সংকোচে-শংকায় কেটে গেল। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আমি মোটামুটি ফ্রি হয়ে গেলাম! কারণ ততদিনে আমার পেটের ছানাটা বের হয়ে এসেছে। উঁচু পেট দেখে লোকে কী বলবে, কিশোরীসুলভ এই লজ্জা তখন আর নেই। ছিপছিপে তন্বী-তনুলতা নিয়ে দিব্যি কলেজে আসি যাই। তবে মন পড়ে থাকে বাসাবোতে। বাসাবোতে আব্বার বাসায় আমার মায়ের কাছে রেখে আসি সদ্যোজাত দুগ্ধপোষ্য ছেলেটিকে। সকালে বেরিয়ে আসি। কলেজে সময় পার হতে থাকে। আমার শরীর থেকে-থেকে আমাকে বাচ্চার ক্ষুধা-তৃষ্ণার সংকেত দিতে থাকে। কিন্তু ক্লাসে বসে ছোট্ট শিশুটির খাওয়ার কথা ভেবে আমার চোখ ছলছল করে ওঠা ছাড়া কিছু করার থাকে না। শিশুটির তৃষ্ণার্ত ঠোঁট আর ক্রন্দনরত মুখের কথা মনে করে অস্থির হয়ে উঠি। মনে মনে ঠিক করি, কোনোমতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটা দিতে পারলেই হয়, এর পরে আমি এই নচ্ছার লেখাপড়াকে হাঁড়িতে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে শিকেয় তুলে ফেলবো। আমার সোনাজাদুটাকে আর কষ্ট দিতে পারবো না।

বাসায় ফিরে আসতে প্রায়-দিনই বিকেল পেরিয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার পর আমি আর ছাত্রী থাকি না, বইপত্তর ছুঁড়ে ফেলে পুরোদস্তুর মা হয়ে যাই। বাচ্চার যত্ন, লালনপালন, নতুন জামায় রঙিন সুতোর নকশা বোনা, উল বোনা, কাঁথা বোনা থেকে শুরু করে বাচ্চাকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা ~ কত কী চলতে থাকে! এসবের মধ্যে আর লেখাপড়া করার মত সময় হয়ে ওঠে না। তাই মাঝে-মাঝেই কলেজে যাওয়া বাদ দিই। এর মধ্যে আগস্টে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘনিয়ে এলো কেয়ামতের অন্ধকার। ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হল। ইতিহাসের নৃশংসতম এ ঘটনা সাধারণ মানুষকে যেন বজ্রাহত করে তুললো। জনজীবনে হঠাৎ করে নেমে এলো স্তব্ধতা। কোথায় কখন কী ঘটে সারাক্ষণ এ ধরনের আতঙ্ক মানুষকে স্থবির করে রাখলো। ভয়ে ভয়ে বেশ কিছুদিন বাসায়ই থাকলাম। কলেজে গেলাম না। এসবের মধ্যেই ঢুকুশ ঢুকুশ করে চলে আমার ক্লাসের লেখাপড়া।

তাই তিতুমীর কলেজে যাঁদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম, সবার কথা আমার মনে নেই। এই ছেচল্লিশ বছর পেরিয়ে এসে কারো কারো স্মৃতি মনে থাকলেও নাম মনে নেই। তবে কয়েকজনের কথা তো মনে আছেই! এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলার অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান স্যার। পরে তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন। কামাল আতাউর স্যার আমাদের পড়াতেন মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর। স্যার দেখতে ছিলেন রাজপুত্রের মত অপরূপ সুন্দর। ক্লাসের সময় মেয়েরা স্যারের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। পড়া শুনতে ভুলে যেতো। আমি স্কুল-জীবন থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম। স্যারের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হতো তাঁর চেহারাটা একেবারে পেনসিলে আঁকা পুরুষ-পরী! কেমন টানা টানা চোখ, নিপুণ ভ্রু, টিকলো নাক, কুচকুচে কালো ভ্রমরের মত চুল আর স্বর্ণাভ গায়ের রঙ! মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতাম স্যারের মুখের দিকে। স্যার বুঝতেন, শুধু ছাত্রীরা নয়, ছাত্ররাও তাঁর রূপে মুগ্ধ। তাঁর ক্লাসে অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও চলে আসতো। সেটা বুঝে স্যার নিজেকে আরও আকর্ষণীয় আর মোহময় করে তুলতেন। এমন নাটকীয় দেহভঙ্গি আর বাচনভঙ্গিতে স্যার নাটক পড়াতেন, ইব্রাহিম কার্দির ডায়লগ যখন বলতেন, মনে হতো স্যার বুঝি ইব্রাহিম কার্দির ভূমিকায় নাটক করছেন। আবার জোহরার সংলাপের সময় স্যারকে মনে হতো বীরাঙ্গনা প্রেম-প্রণয়িণী এক দুঃখবিধুর রমণী! মুগ্ধ বিস্ময়ে পিনপতন নীরবতায় ক্লাসের সবাই শুনতো তাঁর কথা। কলেজের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও দেখতেন কামাল আতাউর স্যার। স্যারের সাথে মাঝেমধ্যে থাকতেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীর নাম মৌসুমী। স্যারের স্ত্রীও তিতুমীর কলেজের শিক্ষক ছিলেন কি না তা ঠিক মনে নেই। তবে তাঁকে কয়েকবার কলেজে দেখেছি। শুনলাম স্যারের একটি শিশুকন্যাও আছে। সে মেয়ের নাম কৌসুমী। কৌসুমী শব্দটি প্রথমবারের মত শুনলাম। স্যার বললেন মৌসুমীর মেয়ে কৌসুমী। কৌসুমী মানে কুসুমময়। সুন্দর কাব্যিক শব্দের প্রতি আমার আকর্ষণ অনেক ছোটবেলা থেকেই। কাজেই কামাল আতাউর রহমান স্যারের মেয়ের ‘কৌসুমি’ নাম আর ইহজীবনে ভোলা হল না।

আরও দুজন স্যারের কথা মনে আছে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমাদের বাংলা স্যার। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তা স্যার অধ্যাপক মাহবুবুল আলম। তখন অবশ্য তাঁর এই পরিচয় জানতাম না। মাহবুবুল আলম স্যার রাশভারি মানুষ ছিলেন। বাড়তি কথা বলতেন না। একদিন ক্লাসে স্যার সেদিনের আলোচ্য বিষয়ের কিছু পয়েন্টস বোর্ডে লিখেছিলেন। আমি পেছন দিকের বেঞ্চে বসা ছিলাম। কিন্তু স্যারের লেখা ভালো বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ব্ল্যাকবোর্ডটা পুরোনো হয়ে ওপরের পলিশ উঠে গেছে তাই হয়তো আবছা দেখাচ্ছে। আমি পেছন থেকে বললাম, স্যার নিচের লেখাটা অস্পষ্ট, বুঝতে পারছি না। ওটা কী লিখেছেন! স্যার এক পলক আামকে দেখে বললেন, বুঝতে পারছো না? কেন, স্পষ্টই তো আছে! এর মধ্যে আমার আশেপাশের কেউ একজন বলে উঠলো, স্যার বোঝা যাচ্ছে। আপনি লিখেছেন.... পাঠ করে শুনিয়ে দেয় শব্দগুলো। স্যার আমাকে বলেন, তোমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। চোখের চিকিৎসা করাও! আমার মনে হল স্যার রেগে গিয়ে আমাকে তিরস্কার করে ঐ কথা বললেন। আমি বিব্রত হয়ে মিইয়ে গেলাম। চোখ ছলছল করে উঠলো। কিন্তু পরে খেয়াল করে দেখলাম, আমি দূর থেকে সত্যিই ব্ল্যাকবোর্ড ঝাপসা দেখি। কাছে থেকে ঠিক দেখি। ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর একদিন চোখের ডাক্তারের কাছে গেলাম। বর্ষীয়ান ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে বললেন, তুমি তো চোখের মাথা খেয়ে বসে আছো! তোমার লং সাইট একেবারেই খারাপ। দু চোখেই মাইনাস পাওয়ার লাগবে! মানে আমার ‘দূরদৃষ্টি’ নেই! তাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্যার ঠিক ধরতে পেরেছিলেন আমার সমস্যা! যা-ই হোক, হাই পাওয়ারের চশমা নিলাম। মনে আছে, প্রথম যেদিন চশমা পরে বাইরে তাকালাম তখন আচমকা যেন পানিতে ভেজা টলমলে স্বচ্ছ এক পৃথিবী আমার চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লো! আমি বিস্মিত। এত স্পষ্ট ‘বাহির’! আমি যে কতদিন ধরে স্পষ্ট দৃশ্য দেখি না, ঝাপসা দেখতে দেখতে ওতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, সেটা টের পেলাম চশমা পরার পর। তো ‘চোখের মাথা’ ফিরে পাওয়ার সাথে মাহবুবুল আলম স্যারের স্মৃতিটুকু ওভাবে জমা রয়ে গিয়েছিল! চশমা পরে ক্লাসে যাওয়ার পর স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখন ভালো দেখতে পাও? তখন আবার আর এক ধরনের লজ্জা এসে আমাকে মূক করেছিল। তবে আমার জীবনের সেই প্রথম-চশমা দেখে আমার বান্ধবীরা বলেছিলো, তোকে ছেলে ছেলে লাগছে! তুই ছেলেদের ফ্রেম কিনেছিস কেন? একটা ফ্যাশনেবল ফ্রেম নিতে পারলি না? কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ছিল আমার। দোকানের সেলসম্যান যেটা আমার চোখে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, এটা ভালো, আমি নব্বই ডিগ্রি ঘাড় কাত করে বলেছি তাহলে এটাই দিন। ফ্রেমের জেন্ডার-টেন্ডার তখন কিছুই বুঝিনি। ফ্যাশন-ট্যাশন তো দূর অস্ত!

আর একজন স্যারের কথা মনে পড়ে। তিনি আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন। স্যারের নামটা ঠিক মনে নেই। সম্ভবত তাঁরও নাম ছিল মাহবুব! মাহবুবুর রহমান। স্যারের নাম মনে না থাকলেও তাঁর একটা বাণী মনে আছে, যেটা আমার শিক্ষক-জীবনে মাঝে মাঝে মনে পড়তো। অর্থনীতি স্যার ক্লাসে ঢুকেই কোনোদিকে না তাকিয়ে, কিচ্ছুটি না বলে বোর্ডে অর্থনীতির নানা সূত্র তত্ত্ব লিখতে থাকতেন। চাহিদা যোগান কাম্যতা মূল্যের স্থিতিস্থাপকতা বিষয়ে নানা ডায়াগ্রাম আঁকতেন। লেখা আঁকা শেষ হলে তিনি গড়গড় করে পড়াতে শুরু করতেন। ছাত্ররা ততক্ষণে যার-যার মতো কথা বলতে শুরু করতো। হৈ-চৈ বেড়ে যাওয়ার পর স্যার হঠাৎ কথা থামাতেন। ক্লাসও চুপ হতো। তারপর গম্ভীর স্বরে বলতেন, কারো ক্লাস করতে না ইচ্ছে হলে বেরিয়ে যাও। আমার ক্লাসে বেঞ্চ ডেস্ক থাকলেই চলবে। আমি ওদের পড়িয়ে চলে যাবো। মাস শেষে ঠিক বেতন পাবো। এটা সরকারী কলেজ!
সরকারী কলেজের শিক্ষকদের চাকরির গোড়া যে অনেক শক্ত সে কথার তাৎপর্য তখনই বুঝতে শিখেছিলাম। 
(চলবে)

ঝর্না রহমান


ছবি: ১. আমাদের সময়ে তিতুমীর কলেজ (ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া) 
      ২. তিতুমীর কলেজে পড়াকালীন আমি (তখনও ছেলেদের ফ্রেমের চশমাটা নিইনি!)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত