জনবান্ধব দীনেশ বাবুর আর বাড়ী যাওয়া হলো না

  চিররঞ্জন সরকার

প্রকাশ: ৪ জুলাই ২০২১, ২১:৪৭ |  আপডেট  : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২৮

‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে’ গোটা এলাকাতেই তিনি পরিচিত ছিলেন ‘জামাইবাবু’ হিসেবে। 

মুক্তিযুদ্ধে শহিদ যতীন্দ্রনাথ সাহার মেয়েকে বিয়ে করে বোদার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় ‘এলাকার জামাই’ হিসেবে খ্যাতি পান।

 আমরাও ছোটবেলায় তাঁকে জামাইবাবুই বলতাম। আশির দশকে বিভুদা ওই পরিবারে বিয়ে করলে সম্পর্কটা বদলে যায়। তিনি আমাদের পরিবারের অভিভাবক বনে যান। তাঁর নাম দীনেশ চন্দ্র সাহা। 

সবাই তাঁকে দীনেশবাবু বলেই চিনতেন। যৌবনে আমাদের এলাকায় তিনি ছিলেন রাজার মতো। অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে চলতেন। চায়ের হোটেলে চা খেতে গেলে সবার বিল দিয়ে দিতেন। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা তাঁর বাসায় যেত। সবচেয়ে ভালো সবজিও থাকত তাঁর জন্য বরাদ্দ। 

তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁর বাসাও ছিল সবার জন্য অবারিত। তিনি নিজে যেমন খেতে পছন্দ করতেন, খাওয়াতেও পছন্দ করতেন। বিভিন্ন পার্বণে তাঁর বাসায় বাহারি ভোজে আপ্যায়িত হন নি-এমন মানুষ এলাকায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এলাকার মানুষের কল্যাণ আর উন্নতির জন্য তিনি সব সময় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তিনি ছিলেন এলাকার সবার অভিভাবকও। সব বয়সী মানুষজনের সঙ্গে গভীর আন্তরিকতা নিয়ে মিশতে পারতেন। তাঁর সেন্স অফ হিউমার ছিল অসাধারণ। সবার হাঁড়ির খবর রাখতেন। কাকে কখন শাসন করতে হবে, কখন আদর বা প্রশ্রয় দিতে হবে, সেটা তাঁর মতো ভালো কেউ জানতেন বলে মনে হয় না। 

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তিনি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরতেন। অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন তিনি। সব সময় পরিপাটি হয়ে চলতেন, মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে হাঁটতেন। উচিত কথা বলতেন। কাউকে পরোয়া করতেন না। 

এলাকার যে কোনো বিচার-সালিশ, আড্ডা, খেলা, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ-জন্মদিন, বিয়ে, পারিবারিক ঝগড়া মেটানোয় তিনি ছিলেন অনিবার্য ব্যক্তিত্ব। ছিলেন আওয়ামী লীগের থানা কমিটির নেতা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই নিষ্ক্রীয় হয়ে যান। 

কিন্তু তিনি ছিলেন সেই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। তাঁর নিরলস ভূমিকার কারণেই পরবর্তীসময়ে আওয়ামী লীগ আবারও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 

আওয়ামী লীগের সুদিনে তিনি অবশ্য নতুন প্রজন্মের নেতা ও তাদের ‘নীতি’-র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে ক্রমেই নিজেকে সক্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে গুটিয়ে নেন। কিন্তু তাঁর অন্তকরণ জুড়ে ছিল আওয়ামী লীগ। এবং অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক, মানুষের পক্ষের আওয়ামী লীগ। আমৃত্যু তিনি সেই নীতির পক্ষে ছিলেন। 

গত প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। ঢাকায় চিকিৎসা নিয়ে বোদায় যেতেন। সেখানে একটু খারাপ বোধ করলেই আবার ঢাকা চলে আসতেন। 

চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি ঢাকায় আসতেন ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকত বোদায়। সেখানে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। 
এই মানুষটি আজ সকালে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন।  ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে জামাই-মেয়ের বাসায় তিনি স্ট্রোক করে মারা যান।  সিনিয়র সাংবাদিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিভু রন্জন সরকার তার মেয়ে জামাই।   

মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন  দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। ঢাকার বরদেশ্বরী শ্মশানঘাটে গতকাল শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। তিনি স্ত্রীসহ অনেক আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বোদা উপজেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

করোনার কারণে তাঁকে বাড়ি নেওয়া হলো না। যেখানকার মানুষদের সঙ্গে যিনি সারাজীবন কাটিয়েছেন, তাঁদের ছাড়াই আজ দুপুরে ঢাকার সবুজবাগ বরদেশ্বরী শ্মশানে আমরা অল্প কয়েকজন শেষকৃত্যে অংশ নিলাম! কী নিষ্ঠুর বাস্তবতা! অত্যন্ত সংবেদনশীল, উদার, মহৎ, পরোপকারী, নির্লোভ-নিরহঙ্কার, উচিত-কথা বলা এই মানুষটিকে হারিয়ে আজ সত্যিই ভীষণ কান্না পাচ্ছে ! এমন মানুষ যে আমাদের সমাজে বড় বেশি জন্মায় না!

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত