গুলশান টু দীপনপুর
প্রকাশ: ৯ জুলাই ২০২১, ১০:০৭ | আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:২৪
গুলশান,ঢাকা
৩১.১০.২০১৭খ্রি.
মিলি,
আমার শুভকামনা রইলো। নেটে তোমার আইডির পাশে সবুজ বাতি জ¦লছে। মানে তুমি এখনও ঘুমাওনি। আমিও ঘুমাইনি। ২এমজি রিভোট্রিল খেয়েছি প্রায় এক ঘন্টা আগে, কিন্তু ঘুমের দেখা পাচ্ছি না। এপাশ ওপাশ করছি, বালিশের কাছেই বইয়ের স্তুপ। কিন্তু তাতে হাত দিতেও ইচ্ছে করছে না। কেন বলতে পারো? না,পারবে না। আমি ঘুমাইনি শুনে তুমি অবাক হওয়ার কথা। কারণ স্বামী, সন্তান নিয়ে উপচে পড়া জীবন আমার! নেই কোন জ্বালাযন্ত্রণা, নেই কোন দুঃখ। আমার আবার রাত দু’টোই ঘুম হবে না কেন? তোমার সাথে ফেসবুকে আমার অনেকদিনের পরিচয়। সুতরাং আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো বলে তুমি বিশ্বাস করে বসে আছো। আমিতো তোমাকে বরাবর সান্ত¡না দিয়েই চলেছি, আমি আমার সম্পর্কে তোমার কাছে এমন কিছু বলিনি যে, আমাকে তোমার সান্ত¡না দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তাই না?
আজ তোমাকে আমার কিছু না বলা কথা জানাবো বলে স্থির করেছি। কি, পড়বে? তুমি পড়ো আর না’ই পড়ো, আমি কিন্তু লিখতে শুরু করে দিয়েছি।
আজ দীপন সাহেবের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বারটা বাজার পরপরই তুমি ফেসবুকে ”দীপন স্মরণে” নামে একটি স্বরচিত কবিতা পোস্ট করেছো। নিচে তোমাদের হারানো সেই সোনালী দিনে ধারণ করা একটি ছবি। অনেকেই লাইক, কমেন্ট দিতে শুরু করেছে দেখছি। আমি লাইক বা কমেন্ট কিছুই দিইনি। তোমার কবিতা আমার মনোজগৎকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে যে!
আধেক জীবন গ্রাস হয়ে গেছে ভুল ও ভালবাসা নিয়ে,
আধেক জীবনে তুমি রয়ে গেলে দূরাকাশে তারা হয়ে---
একটা জীবনে আর হবে নাকো নিজের কাছে ফেরা,
একটা জীবন ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখি আমিই সর্বহারা।
না মিলি, তুমি সর্বহারা নও। প্রেমের রসায়ন মথিত করে তুমি হয়ে ওঠছো এক মহীয়সী নারী। দীপন সাহেবকে তুমি কালোক্তীর্ণ করে রাখতে যা যা করছো, তা কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে অনেকদিন। তুমি দীপনের জন্য কী না করেছো মিলি? আশা-আকাংক্ষা, চাওয়া পাওয়ার হিসাব চিরতরে চুকে যে মানুষটি হারিয়ে গেলেন, তাঁর স্মৃতিতাড়িত হয়ে তুমি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার যে প্রয়াসকে বাস্তবায়ন করে চলেছো, তার তুলনা হয় না। আজ দীপন সাহেব থাকলে কি তোমার ভাবনাচিন্তার ধরণ এমনটি হতো? তাঁর কাজে সাফল্যের স্বীকৃতি পেতে কয় বছর লাগতো? অথচ তিনি চলে গিয়ে হলেন এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক। তুমি জাগৃতিকে ধারণ করেছো, দীপনপুর,দীপনতলা,দীপান্তর ইত্যাদি প্রতিষ্টা করে তোমার শাণিত উদ্ভাবনী শক্তির স্বাক্ষর রেখেছো। দীপন স্মৃতি পরিষদ গঠন করে চালিয়ে যাচ্ছো নিত্যনতুন সব কার্যক্রম। সর্বগ্রাসী কালকে জয় করে তুমি হয়ে ওঠছো ক্রমেই বাংলার নারীশক্তির এক মূর্ত প্রতীক। তোমার তুলনা শুধু তুমিই মিলি।
শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন কি মমতাজের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে? হতেও পারে, তবে তাঁর মধ্যে নিজেকে মহান করে তোলারও অভিপ্রায় ছিলো না, এমনটা কি খুব জোর দিয়ে বলা যায় ? প্রজাদের অর্থে এবং মজুরদের ঘামে নির্মিত দর্শনীয় এ প্রাসাদ ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কের ছাপও যে রেখে দিয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। তবে হ্যাঁ, তাজমহল অমর। পৃথিবীর বুকে তা অমলিন হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। কিন্তু কামলোলুপ সম্রাট সম্রাজ্ঞীর জন্য কতটুকু অশ্রু ঝরিয়েছেন, তার খবর কেউ বলতে না পারলেও এটা ইতিহাস বলে যে, তিনি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই পাণিগ্রহণ করেছিলেন মমতাজেরই ছোটবোনকে।
তুমি মিলি, তুমি শাহজাহান নও। তুমি কারও আনুকুল্যে নয়, নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গত দু’বছর ধরে যেভাবে ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছো, মানুষের সহানুভুতি এবং সমর্থন আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠছো, তা সত্যি অভাবনীয় মিলি। তৃতীয় বিশে^র ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকা লোকজনের বক্রদৃষ্টি এবং অনেকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিঘœসৃষ্টিকে পরাভূত করে অসীম ধৈর্য্য এবং সাহস নিয়ে তোমার এগিয়ে যাওয়া একটা অনন্য নজীর বটে। প্রথমদিকে তোমার হাতে নিতে থাকা কার্যক্রমগুলো দেখলে তোমার প্রতি করুণা হতো। মনে করতাম, স্বামী হারিয়ে মহিলা যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছে। জাগৃতির হালতো ধরেছো, সেটা নিয়ে যখন হিমসিম খাচ্ছো, তখনই তুমি শুরু করে দিলে দীপনপুর নামের কি একটা প্রজেক্ট। তোমার সেই স্বপ্নিল দিনগুলোর স্মৃতির অসহনীয় বেদনাকে ঢেকে দিয়েছো দীপনমহলের জৌলুসের অন্তরালে। যে দীপন চলে গিয়েছে, সে আর ফিরে আসবে না জেনেও তুমি নিজেকে যেভাবে নিঃশেষ করে দিয়ে অন্যরকম আলোয় ধাঁধিয়ে দিচ্ছো, তা বিস্ময়কর বটে। মিলি, দু’বছর আগের তোমার সেই তরতাজা গোলাপের মত কমনীয়, স্নিগ্ধ. মায়াবি হরিণীর মত চাহনী আজ রূপান্তরিত হয়েছে এক ব্যক্তিত্বময়ী নারীর অবয়বে। তুমি কি আয়নায় নিজেকে দেখো? দেখোতো অবশ্যই। ক্ষণিকের জন্য মন খারাপ হওয়া অতি স্বাভাবিক, সান্ত¡নার ভাষা আমার জানা নেই। তবুও বলি, মহাকালের প্রেক্ষিতে আমরা এ নশ^র দুনিয়াতে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র। বিষফোঁড়ার বেদনায় আমরা কাতরাই বটে, কিন্তু সময়ে একদিন বিষফোঁড়া শুকিয়ে যায়। বেদনাও প্রশমিত হতে হতে মিলিয়ে যায়। সময়ই তোমাকে একদিন যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি দেবে। এর বেশি আর বলার নেই মিলি।
হাজার ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটছে তোমার। দু’টি নিষ্পাপ সন্তানের দেখভালের পাশাপাশি তোমার কর্মতৎপরতা অবশ্য তোমাকে দুঃখের গহীন অন্ধকারে দ্যোতি ছড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাষন্ডরা কী পাওয়ার আশায় এক একটি পরিবারের স্বাভাবিক জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে, রক্তের হোলি খেলায় মাতোয়ারা হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছে, তা সত্যি এক ঘৃণ্য ব্যাপার বটে। সভ্যতার যে পর্যায়ে এসে মানুষ এ মর্ত্যলোকে সেই কল্পিত অমরাবতীর স্বাদ পাচ্ছে, সে সময়টাতে নারকীয় তান্ডবে ভীতিকর করে তুলছে কিছু মানুষরূপী হায়েনা। না না, হায়েনা বলাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। হায়েনারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে হিংস্র হয়, কিন্তু এসব জানোয়ার জেনেশুনেই অনাবাসযোগ্য করে তুলছে সুন্দর এ পৃথিবীকে। সুতরাং এদেরকে হায়েনার সাথে তুলনা করলে হায়েনাদেরকে অপমান করা হয়।
মিলি, আমার না বলা কথা বলতে গিয়ে তোমার কথায় বলে চলেছি। বিরক্ত হচ্ছো না তো? আসলে আমি এরকমই। আমার আবেগের মাত্রাধিক্য অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবার আসি আমার কথায়।
আমিতো এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার গৃহিনী। সুখে উপচে পড়া আমার জীবন। তোমার সাথে ফেসবুকে যতবারই চ্যাট হয়েছে, প্রতিবারই তুমি আমার রূপযৌবনের প্রশংসা করেছো, আমার সুদর্শন স্বামীর প্রশংসা করেছো। পুত্রকন্যা নিয়ে আমার সুখি জীবনের কথা বারবার বলেছো। তোমার এসব কথার মধ্যে বেরিয়ে আসতো তোমার দিশেহারা জীবনের করুণ সুর। তাতে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠতো, কিন্তু তোমাকে সান্ত¡না দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছি, আমার কান্না গোপন করে।
তুমি অবাক হচ্ছো? ভাবছো, এ মহিলার আবার কিসের কান্না? আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে, আমার ভালবাসা আমাকে জেলখানায় ঢুকিয়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে, আমি রিক্ত, আমি দু’টি সন্তানের কথা ভেবেই মরতে পারছি না, তা না হলে আমার আত্মহনন করা একটা তুচ্ছ ব্যাপার। অথচ সুখ সাগরে ভেসে চলা এক প্রানবন্ত মহিলা নাকি শুনাতে চায় তার হৃদয়ের কান্নার কথা। কি সেই কান্না?
শোন তাহলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তখন পলিটিক্যাল সায়েন্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখায় মজে আছি। তারুণ্যের উচ্ছ¡াস রক্তের কণায় কণায়। একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন লালন করে চলেছি। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে একটি ভালো চাকরি জুটিয়ে নেওয়া তেমন কঠিন কাজ হবে না, কারণ ছাত্রী হিসাবে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি মানের ছিলাম। তাছাড়া মা-বাবার উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতজগতের সাথে যুক্ত। তখন এখনকার মত এত এত চ্যানেল ছিলো না। বিটিভিই ছিলো একমাত্র টেলিভিশন মাধ্যম। অডিশনে পাস করে বিটিভিতে গানও গেয়েছি বেশ কয়েকবার। এটা আমার চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোন কাজ দিতো কিনা জানি না, তবে অনেকে আমাকে নিয়ে সেরকমটি ভাবতো।
আমি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে আসার কৃতিত্ব আমার মা-বাবার। তারা খেয়ে না খেয়ে আমার পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে চলছিলেন। আশা, আমি সমাজে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। আমার বাবা উচ্চশিক্ষিত না হলেও নারীস্বাধীনতা যে এখনও নারীদের ভাগ্যে জুটেনি, তা ভালো করে জানতেন। তাই আমাকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার ব্যাপারে তাঁর সচেতনতা ছিলো ব্যতিক্রমী।
সবকিছু ঠিকঠাকমতই চলছিলো, আমি বিশ^বিদ্যালয়ের রঙিন জীবনকে উপেক্ষা করে পড়ালেখাতেই ডুবে থাকতাম। ভাগ্যিস আমার রুমমেটরা উদার মনের ছিলো। তারা নিজেরা পড়ালেখায় উদাসীন থাকলেও আমাকে কখনও তাদের সাথে জড়ায়নি বা আমাকে বিরক্ত করে নি। বরং আমার প্রতি সবার সহানুভূতি প্রকাশ পেতো।
হঠাৎ বাড়ি থেকে এলো এক অপ্রত্যাশিত খবর। তখন এখনকার মত হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিলো না। প্রতি মিনিটে দশ টাকা করে গ্রামের এক দোকান থেকে ফোন করা যেতো। এদিকে আমার পাশের রুমে এক বান্ধবীর ছিলো একটা মোবাইল ফোন। আমি ছাড়াও অনেকেই এই বান্ধবীর ওপর নির্ভরশীল ছিলো। সে খুশিমনে এ সার্ভিসটা দিতো। বাড়ির সাথে এভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে পারাটাই ছিলো তখন আমাদের পরম প্রাপ্তি।
সেদিন সকালে সবাই বেরিয়ে পড়েছিলো। আমি একা রুমে। হঠাৎ রেবা, রেবা বলে আমাকে ডাকতে ডাকতে সাদেকা ফোন হাতে আমার রুমে এলো। আমি বুঝতে পারলাম, বাড়ি থেকে আমার ফোন এসেছে। সে ফোনসেট আমার হাতে দিয়ে বাইরে চলে গেলো।
হ্যালো?
মাগো কেমন আছস?
বাবার গলা শুনেই মনটা কেমন যেন আকুল হয়ে ওঠলো। সোজা কথায় কান্না পেলো। আমার এরকমই হয়। বললাম, ভালা আছি বাবা, তোমরা ভালানি?
ভালা, ভালা। তোর পড়ালেখা কেমন চলতাছে?
চলের বাবা, কোন সমস্যা নাই।
সামনে কোন পরীক্ষাতরীক্ষা আছেনি?
না বাবা, সামনের দুই মাসে কোন পরীক্ষা নাই।
নে তোর মার লগে কথা বল।
মা’র সাথে কথা হলো। ভালমন্দ খবরাখবর নেওয়ার পর মা আমাকে যে কথাটি বললেন, তাতেতো আমার মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা। আমাকে দেখার জন্য নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, আমি যেন সেদিনই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই।
সাথে সাথে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না। তা বুঝতে পেরে মা আমাকে জানালেন, বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তাঁদেরও ছিলো না, কিন্তু এমন পাত্র পাওয়া গেছে, যাকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
পাত্রতো তুমি চেনো। এমন পাত্র পেলে কোন মা-বাবা, বিশেষ করে আমাদের মত নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া না? তবুও মা’র সাথে আমার অনেক বাকবিতন্ড হলো। আমার সাথে তর্কে না পেরে মা একসময় বলে ওঠলেন, ঠিক আছে মা, তুই যা ভালো বোঝস তাই কর, আমরা পাত্রপক্ষকে যেমনে পারি বোঝাইমু। তুই পড়ালেখা ঠিকমত চালিয়ে যা।
ফোনালাপ শেষ। আমার মাথাতো এলোমেলো, যে মেয়ে কোনদিন মা-বাবার অবাধ্য হয়নি, সে আজ মাকে এত কড়া কড়া কথা শুনিয়ে শান্তিতে থাকবে কী করে? অনেক সময় একা একা এটা নিয়ে ভাবলাম। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, না পরে যা হবার হবে, আপাতত মা-বাবার কথামত বাড়িতে যাবো। এর মধ্যেই কিছু হয়ে গেলো কিনা কে জানে? তাড়াতাড়ি করে সাদেকার সেট থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলাম, আমি যাচ্ছি।
গেলাম বাড়িতে। মা-বাবার সাথে আর কথা কাটি করতে গেলাম না। পাত্র যে আসলেই ভালো তা বুঝতে পেরে মনটাও কেমন যেন উতলা হয়ে ওঠলো। বয়সের দাবি বলে কথা। তাই শেষপর্যন্ত মা-বাবার সাথে একমত পোষণ করে এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হলে কী হবে, পাত্রপক্ষের অঢেল টাকায় রাজকীয় স্টাইলে বিয়ের সবকিছু সম্পন্ন হলো।
তারপর? তারপরতো রাজরাণী, তাই না? হ্যাঁ, রাজরাণী হয়েই পদস্থ কর্মকর্তা স্বামীর সাথে ঘর করতে এলাম ঢাকা। গুলশানে যে বাসায় এসে ঢুকলাম, সে রকম বাসায় থাকার চিন্তা আমার কল্পনাতে কোনদিন ছিলো না। পড়ালেখার চিন্তা মন থেকে উবে গেলো। রাজপুত্রের মত দেখতে আমার বর আমাকে এমন এক স্বপ্নিল জগতে নিয়ে এলো, যে জগতে থেকে অন্যকিছু প্রত্যাশা করার প্রশ্নই ওঠে না। ঘরভর্তি আসবাবপত্র, চিত্তাকর্ষক সব জিনিসপত্রে সাজানো বিশাল ফ্লাটটি দেখে মনে হলো যেন স্বপ্নপুরী। এর ওপর স্বামীর সোহাগ, ভালবাসা। আহা! কি রঙিন জীবন আমার! রবিঠাকুরের ভাষায়,
হে কবিন্দ্র কালিদাস, কল্পকুঞ্জবনে
নিভৃতে বসিয়া আছ, প্রেয়সীর সনে
নাই দুঃখ, নাই দৈন্য, নাই জনপ্রাণী,
তুমি শুধু আছ রাজা, আছে তব রাণী।
দু’তিন বছর এভাবে স্বপ্নময় সময় পার করলাম। এরই মধ্যে ঘর আলো করে এলো দু’সন্তান। মধ্যে একবার পড়ালেখাটা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রেখেছিলাম স্বামীর কাছে। কিন্তু সে ফুৎকারে তা উড়িয়ে দিলো। বললো, তুমি পড়ালেখা, চাকরিবাকরি করলে বাচ্চা দু’টিকে মানুষ করবে কে? টাকাপয়সার কি অভাব আছে যে তোমাকে চাকরি করতে হবে?
সুতরাং কর্তার ইচ্ছায় কর্ম জ্ঞান করে ওইদিকের চিন্তা বাদ দিলাম। সে কত টাকা বেতন পায়, তা কোনদিনই জিজ্ঞেস করা হয়নি, তবে প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরলে দেখতাম ব্রিফকেসভর্তি টাকার বান্ডিল। ইচ্ছামত খরচ করো, খাওদাও ফুর্তি করো, মা-বাবাকেও মাঝে মাঝে সাহায্যসহযোগিতা করা কোন ব্যাপারই না। কারণ এসব ব্যাপারে স্বামী ভদ্রলোকের কোন ওজরআপত্তি কোন সময়ই ছিলো না, এখনও নেই।
তাহলে? তাহলে তুমি দুঃখী হলে কীভাবে? এইতো তোমার প্রশ্ন। বলছি, শোন।
বাচ্চা দু’টি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, তাদের দেখভাল, পড়ালেখার দায়িত্ব, স্কুলে তাদের নিয়ে যাওয়াআসা ইত্যাদির মধ্যে বয়সতো থেমে থাকে না। সাথে সাথে চেহারার মধ্যেও বয়সের ছাপ কিছুটাতো পড়বেই, কি বলো? কিন্তু আমার স্বামীর চায় টসটসে যৌবনবতী মেয়ে। বিয়ের কয়েকদিন পর তার মুখে একদিন তার অতীত কীর্তিকলাপের কিছু শুনেছিলাম। তাতে আমি জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে সে এমন নিঁখুত অভিনয় করেছিলো যে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম, সে ওই প্রকৃতির নয়। পুরুষরা নাকি ওইসব বীরত্ব স্ত্রীদের কাছে বলে মজা পায়। তবে গল্পগুলো নিছক বানানো নয়। তার বন্ধুদের অনেকে নাকি সে রকমটি করে থাকে। সে নিজে ওইসব করার চিন্তাই করতে পারে না।
তার বলার ধরণটি এমনই ছিলো যে তার প্রতি আমার ভালবাসা বরং যেন একটু বেড়ে গেলো। বিয়ের পর থেকেই যাকে শুধু আমার পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখেছি, সে অন্য মেয়েতে আসক্ত হবে কেন? একজন পদস্থ কর্মকর্তা হয়ে আমার মত নি¤œবিত্ত পরিবারের এক সাধারণ মেয়েকে সে কেন বিয়ে করলো, এ কথা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিলো, আমাকে নাকি সে বিটিভিতে গান গাইতে দেখেছিলো, তারপর থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে ছাড়া সে আর কাউকে বিয়ে করবেই না। এরপর বিটিভিতে গিয়ে আমার অবস্থান, ঠিকানা ইত্যাদি জেনে নিয়ে তার বাড়ি থেকে আমার মা-বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠায় এবং শেষপর্যন্ত তা বিয়েতে গড়ায়। আমি ঢাকা থাকি, আমার সাথে কেন সে এখানে দেখা করলো না, এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিলো, সে রকম পাতলা ছেলে সে না।
আসলে মিলি, আমরা বুদ্ধিমতি বুদ্ধিমতি বলে যতই দাবি করি না কেন, এখনও আমরা পুরুষদের সমকক্ষ হতে পারিনি। বিভিন্নভাবে তাদের কাছে আমরা প্রতারিত হচ্ছি তো হচ্ছিই, করার কিছু নেই। তবে সবার ভাগ্যে যে তেমনটি প্রতারিত হতে হয় তা না। পুরুষমাত্রই খারাপ, এমনটি মনে করারও কোন কারণ নেই। দীপনসাহেবের অকৃত্রিম ভালবাসা না পেলে আজ কি তাঁর স্মৃতিতাড়িত হয়ে তুমি এত এত কর্মযজ্ঞ করে বেড়াতে?
আঃ আবার চলে যাচ্ছি তোমার কথায়। এরকম হওয়ার অবশ্য কারণও আছে। অব্যক্ত যন্ত্রণা কিছু কিছু মানুষের মনকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলে, তাতে তারা সবসময় একধরণের ঘৃণাতাড়িত হয়ে অন্যকে উপদেশপরামর্শ দিতে শুরু করে। আমি সে ধরণেরই একজন। তাইতো মাঝে মাঝে চ্যাট করতে গিয়ে আমি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে আবার ক্ষমাপ্রার্থী হই।
এবার আসি সরাসরি মূল প্রসঙ্গে। মিলি, এই যে এখন আমি জেগে আছি, কার সাথে জানো? না জানবে না, জানার কথা না। আমি শোয়ে আছি একা। আমার বাচ্চা দু’টোর সাথে শোতে পারতাম, কিন্তু তাদেরকে বুঝতে দিতে চাই না যে, তাদের মা-বাবা আলাদা ঘরে ঘুমায়। কেন? এবার তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে নিশ্চয়? হ্যাঁ, উত্তর দিচ্ছি। এবার আশা করি, তোমার কৌতূহল একটু মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে।
মিলি, আমার স্বামী ঘুমাচ্ছে তার রাজশয্যায়। একা? না একা না। তাহলে কে? এইতো তোমার প্রশ্ন? এ প্রশ্নের উত্তর নিজ থেকে দেবো বলেই আজ এত কথার অবতারণা করেছি। তুমি শোনে আশা করি কিছুটা নিজেকে সামলে দিতে পারবে।
আঃ! হৃদয়ের কোথাও প্রচন্ড মোচড় খেলো মনে হচ্ছে মিলি । ওয়েট, এক মিনিট। একটু পানি খেয়ে নিই। বড় কষ্ট মিলি, কথাটি বলতে বড় কষ্ট।
হ্যাঁ, একটু পানি খেয়ে নিলাম। এবার বলি। আমার হাজবেন্ডের সাথে যে ঘুমাচ্ছে, সে আমাদের বাসার কাজের মেয়ে। দশ এগারো বছরের কাজের মেয়েটিকে সে যোগাঢ় করে এনেছিলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। দানাপানি ঠিকমত পেটে না পড়ায় বস্তির রোগা পাতলা মেয়েটি যখন প্রথম আসে, তার হাতে কিছু একটা খেতেও ঘৃণা হতো, কিন্তু এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যে তার রূপরসমাধুর্য্য প্রকট হতে থাকে, আর আমার স্বামী সেই রূপরসের মধ্যে ক্রমেই হাবুডুবু খেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটি ছিলো গোপন, আমি বাসার বাইরে কোথাও গেলেই তবে মেয়েটির সাথে অপকর্মে লিপ্ত হতো। এক সময় আমি আভাষ পেয়ে এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি করলেও সে অপরাধীর মত মুখ বুজে থাকতো। কিন্তু ক্রমে আমার স্বামীটি অমানুষ হতে থাকে, আমার কথাবার্তা, বকাঝকা আমলে না নিয়ে উল্টা আমাকে হুমকি দিতে থাকে। বলে, খাওয়াদাওয়া করছো, থাকছো, বাচ্চা দু’টোকে দেখছো, তা নিয়ে সন্তোষ্ট থাকো। এর বেশি কিছু আশা করিও না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সোজা ডিভোর্স।
কী বুঝলে মিলি? উপচে পড়া সুখ না আমার? এই যে আমি একটি অর্ডিনারি বিছানায় শোয়ে শোয়ে কাতরাচ্ছি, পাশের রুমে আমার স্বামী কাজের মেয়েকে নিয়ে ফুর্তি করছে, এতে বেশি কষ্ট না তোমার দীপনসাহেবের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়াতে কষ্ট, আমি ঠিক বোঝে ওঠতে পারছি না।
ও মা! চারটা বেজে গেছে? আর না। এবার দেখি একটু ঘুমাতে পারি কিনা। গুডনাইট মিলি।
শুভেচ্ছান্তে
রেবেকা
পূনশ্চঃ যুগে যুগে দীপনরা যেন আলোকবর্তিকা হয়ে এ গ্রহকে মহিমান্বিত করে রাখে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত