খায়রুজ্জামানকে সহসা দেশে ফেরানোয় বাধা জাতিসংঘের শরণার্থী কার্ড
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:১২ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭
তিনি মালয়েশিয়ায় পালিয়ে থাকার তথ্যটি জানতেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তার স্ত্রী দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেত্রী।
জেলহত্যা মামলায় অভিযুক্ত (পরে বিএনপির আমলে খালাস) ও মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার মেজর (অব.) মোহাম্মদ খায়রুজ্জামানকে দেশে সহসাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব না-ও হতে পারে। পলাতক ও বিতর্কিত সাবেক এ কূটনীতিক জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত শরণার্থী হওয়ায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ধাপ পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। জাতিসংঘের স্বীকৃত শরণার্থীরা যতো বড় অপরাধীই হোক, আশ্রিত দেশের আদালতে তারা সংস্থাটির পক্ষে বেশ কিছু আইনি সহায়তা পেয়ে থাকেন।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরাতে মালয়েশিয়ার আদালত থেকে সিদ্ধান্ত লাগবে৷ তিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার স্বীকৃত শরণার্থী হওয়ায় দেশটির সরকার তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠাতে আদালতের অনুমতি লাগবে। তিনি দেশটির আদালতে বিশেষ আইনি সুবিধা পাবেন৷ তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ইউএনএইচসিআর দাবি জানাতে পারে, শরণার্থীদের মর্যাদা সম্পর্কিত ১৯৫১ সালের কনভেনশন ‘মান্য’ করার। এটাও পলাতক ব্যক্তির জন্য সুবিধা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতক ও জেলহত্যায় মামলায় আদালতে দণ্ডিত কয়েকজন বিদেশে পলাতক থাকলেও তাদেরকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে প্রায় সময় বাধা হয়ে দাড়ায় তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তি, ইউএনএইচসিআরের শরণার্থীর স্বীকৃতি ও দেশগুলোর আইনে মৃত্যুদণ্ড না থাকা। বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর ঘাতক রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে না দেয়ায় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্র আর ন্যায় বিচারের কথা বললেও খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়।’
তবে খায়রুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নানা কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। সেজন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে বন্দিবিনিময় ও দেশটির সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চলছে। আবার, তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর মালয়েশিয়ার সরকারের কেউ কেউ দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, অভিবাসন সংক্রান্ত আইন লংঘনের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বিষয়টির দিকেও খেয়াল রাখছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ, তিনি মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন লঙ্ঘন করে থাকলে সাধারণ প্রবাসীরা অপরাধ করলে যে পদ্ধতিতে তাদেরকে দেশে পাঠানো হয়, তাকেও একই পদ্ধতিতে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিএনপির সরকারের আমলে কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া খায়রুজ্জামানের মালয়েশিয়ায় পালিয়ে থাকার তথ্যটি জানতেন দলটির কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো সপরিবারে মালয়েশিয়ায় থাকাকালে তাদের সঙ্গে খায়রুজ্জামানের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। ২০০৯ সাল থেকে বিদেশে পলাতক খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রিটা রহমান বিএনপির নেত্রী।
রিটা দেশে ও মালয়েশিয়ায় মিলিয়ে থাকেন। তার বাবা মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধি ছিলেন। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রীও হন৷ রিটা বিএনপির জোটসঙ্গী ‘ন্যাশনাল পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের’ প্রধান ছিলেন৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি নিজের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন৷ তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন৷
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরাতে মালয়েশিয়ার আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে৷ তিনি ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী হওয়ার কারণে পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে গেছে৷’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, ‘ খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হবে না৷ তিনি সেখানে শুধু অবৈধ অভিবাসী হিসেবে থাকলে দুই দেশের সরকারের সমঝোতার ভিত্তিতে আনা যেত৷ তিনি ইউএনএইচসিআরের স্বীকৃত শরণার্থী৷ সব মিলিয়ে তাকে ফেরত আনা যাবে না, এমনটি বলা যাবে না৷’
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদ্দিন গত ১০ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনুরোধে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিধি মেনেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য তাকে (খায়রুজ্জামান) আটকের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ জানিয়েছিল।’ মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হামজা জয়নুদ্দিন এসব তথ্য জানান বলে নিশ্চিত করে দেশটির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য স্টার’।
এরপর ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে দাবি করে, ‘খায়রুজ্জামানকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। জাতিসংঘের শরণার্থী কার্ড নিয়ে তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ, এটা হবে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। শরণার্থী পুনর্বাসন আইন অনুযায়ী, সরকার কোনো শরণার্থীকে এমন কোনো দেশে পাঠাতে পারে না, যেখান তার জীবন হুমকির মুখে পড়বে। শরণার্থীদের মর্যাদা সম্পর্কিত ১৯৫১ সালের কনভেনশন চুক্তি অনুযায়ী, আইনটি মেনে চলা বাধ্যতামূলক।’
সাবেক সেনা কর্মকর্তা খায়রুজ্জামান গ্রেপ্তার হওয়ার একদিন পর মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করে। দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে সেলাঙ্গর প্রদেশের আমপাং এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তিনি দেশটিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন শেষে এক যুগের বেশি সময় ধরে শরণার্থী হিসেবে পলাতক ছিলেন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত